প্রকাশিত গ্রন্থমুক্তিযুদ্ধ

রক্তে সিক্ত মাটির গল্প

দীপংকর গৌতম

১৯৭১ যাঁদের রক্তে সিক্ত এই মাটি

লেখক: সালেক খোকন
প্রকাশক: বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ, মূল্য ৪৬০ টাকা

বাঙালির স্বাধীনতা আকাঙ্খা অনেক পুরানো। টংক, তেভাগা, নানাকার, ফকির -সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কোন কিছুই স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে আলাদা ছিলো না। মানুষ একের পর এক যত সংগ্রাম করে যাচ্ছিলো ততোই একটা ধারনার এসে উপনীত হচ্ছিলো যে, কোন সংগ্রাম বৃথা যায়না।
সংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় ৫২, ৬২, ৬৯ এর পথ পেরিয়ে একদিন আসে সেই মান্দ্রেক্ষণ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ । অজস্র মানুষের আত্মত্যাগ ,এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আর ২লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালি উপনীত হয় জীবনের চুড়ান্ত সংগ্রামে। এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের পেছনে ছিল বহুবিধ ঘটনা, বিরূপ পরিস্থিতি, অসম আর্থিক বণ্টন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বঞ্চনাসহ গুরুতর বিষয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমাবনতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাঙালিদের উপর অপারেশন চালানোর মধ্য দিয়ে তারা প্রতিবাদমুখর বাঙালিকে চিরতরে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক ঐ পরিকল্পনা দিয়ে নারকীয় গণহত্যা চালালেও স্তব্ধ করা যায়নি।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। দেশকে হানাদার মুক্ত করতে মরনপন লড়াইয়ে অংশ নেয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ। পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবেলার জন্য গড়ে তোলে প্রতিরোধ। নয় মাস আতংকিত প্রহর অতিক্রম করে আসে বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করার বেশিদিন পার না হতেই সক্রিয় হয়ে ওঠে এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা পরাজিত শত্র“রা। ১৯৭১ সালে সংঘটিত একটি গণবিপ্লবকে ১৯৭৫ সালের একটি প্রতিবিপ্লব দিয়ে শেষ করে দেয়া হয়। হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রানপুরুষকে তার পরিবার পরিজনসহ। রক্তাক্ত করা হয় সংবিধানকে। বিকৃত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। ঘাতকদের উম্মত্ত মঞ্চে পরিণত হয় দেশ।
আর একাত্তরের যেসব মহানায়কেরা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন তারা হয়ে যায় অপাঙতেয়। মানবেতর জীবন যাপন করে বেঁচে থাকে সব বীর যোদ্ধারা। বেহাত হওয়া বীরগাঁথা ঢাকা পড়ে যায়। বিক্ষত করা হয় সংবিধানকে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হয়ে ওঠে দলীয় ক্যাডারদের আড্ডাখানা। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসকে বিকৃত করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যেসব বীরযোদ্ধারা জীবনকে তুচ্ছ করে দেশমাতৃকাকে হায়নার হাত থেকে রক্ষা করতে মরনপন সংগ্রাম করেছিলো তারা মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। বিশেষ দিবসে এদের ডাকা হলেও এসব বীরদের প্রশ্নে রাষ্ট্র, সরকারের যে ধরনের ভুমিকা রাখার কথা ছিলো তা কোন সরকার করেনি। তালিকার পর তালিকা হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা লজ্জায় আানত চিত্তে তালিকায় নাম উঠাতেও বিরুপ ছিলেন। বীরত্বের চুড়ান্ত জায়গায় অবস্থান করেও তারা বীরের খেতাব পায়নি। সেই যুদ্ধদিনের যুদ্ধাহত বীরদের নিয়ে লিখেছেন লেখক গবেষক সালেক খোকন।
দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ঘুরে তুলে এনেছেন সেইসব বীরদের যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ। সালেক খোকন এক সময় এসব মাটিবর্তী আগুনমুখাদের আবিস্কার করেছেন তাদের কথা শুনেছেন সেগুলো বিভিন্ন কাগজে, পোর্টালে ছেপে প্রথমে জনগনের চোখের সামনে এনেছেন-এসবই বই আকারে প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স। লেখকের কথা’য় তিনি লিখেছেন- ‘বছর সাতেক আগের কথা। বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে দেখা হয় দিনাজপুরের মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাসের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের মাইনের আঘাতে উড়ে যায় তার বাম পা। স্বাধীন দেশে বাড়ি বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। আক্ষেপ নিয়ে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘প্রতিবছর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিতে আসেন মন্ত্রী- এমপিরা। তাদের বলা সমস্ত কথাইপত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের না বলা কথাগুলো অপ্রকাশিতই থেকে যায়। ফলে ইতিহাসের অপ্রকাশিত কথাগুলো ঘুরপাক খায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনের অতলে।’ কথাগুলো প্রবলভাবে স্পর্শ করে আমায়। মূলত তখন থেকেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যে । ইতিহাস সংগ্রহের কাজটি শুরু।’ এই দুরূহ ও মহৎ কাজটির মধ্যদিয়ে উঠে এসেছে জনযুদ্ধের অজস্র গনযোদ্ধারা যারা বীর, যারা পাকসেনাদের সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতে পরিনত হয়েছিলো।
বিনাযুদ্ধে যারা দেশের একমুঠো মাটিও ছাড়তে চায়নি। যারা ১০ খানা টিন ২মন গম বা একটা প্লটের জন্য যুদ্ধ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪৫ বছর পরে তারা বরেছে তাদের কথা। গেরিরা সব আগুনমুখা মানুষেরা যাদের বর্ননা শুনলে এখনও শিহরে উঠতে হয়। অতি সাধারন এরা এখন। আর যাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলো তারা তাদের গাড়িতে এইসব লড়াকুদের রক্তে কেনা পতাকা উড়িয়ে ঘুরেছে। বীরযোদ্ধা তাজউদ্দিনের বর্ননা শুনলেও চোখ ভিজে আসবে-এই সেই মহামানব দেশপ্রেমিক যার দেশের প্রতি কোন চাওয়া নেই। অথচ ঠোটের মাথায় প্রান নিয়ে যে যুদ্ধ করেছে।
-তাজউদ্দিনের বুকে তখন প্রতিশোধের আগুন। যেভাবেই হোক দেশটা স্বাধীন করতে হবে। সে আশাতেই একের পর এক চলছে অপারেশন। কিন্তু এক অপারেশনে হাতে মারা—কভাবে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। রক্তাক্ত সে দিনটির আদ্যোপান্ত বললেন তিনি:
‘‘ফাইট চলছিল মধুপুর আর ময়মনসিংহের মাঝখানে রাঙামাটি এলাকায়। একটা স্কুলে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্প করছে। আশ্বিন মাসের ৮ তারিখ। তিনডা কোম্পানি আমরা রাইতেই পজিশনে গেলাম। সকালে হবে ফাইট। কোম্পানিতে আমরা একশ। ওই সাইড থাইকা পজিশন নেয় নান্টু কোম্পানি। নির্দেশ ছিল অর্ডার দেওয়ার আগ পর্যন্ত ফায়ার না দেওয়ার। আমার স্বাস্থ্য ছিল ভালো। স্যার কইল, ‘এলএমজিডা তোর কাছে রাখ।’ সাইডে স্টেনগানও। আইলের ধার ঘেইষা পজিশনে রইছি। ওগো ক্যাম্প একটু ওপরে। খুব কুয়াশা। কিছু দেখা যায় না। ফজরের আযান দিছে মাত্র। দেখলাম, আমার এলাকার রেজাকার আতিক। হাতমুখ ধুইয়া পাকিস্তানিগো লগে ও বেঞ্চিতে বইসা আছে। ওরাই আমগো গ্রাম জ্বালাইছে। ওরে দেইখাই ঠিক থাকতে পারি না। কমান্ডারের নির্দেশও ভুইলা যাই। ব্রাশ কইরা আতিকসহ সাত আটজনরে ফালায়া দিলাম। শুরু হইল গোলাগুলি।’’
‘‘আমারে ওরা টার্গেট করে। একটা ছাদের ওপর বাঙ্কার কইরা চায়না মেশিনগান ফিট কইরা রাখছিল। মেশিনগান আমার দিকে তাক কইরা বৃষ্টির মতো গুলি করে। আমার সাইডে কাদের। ওর এক পায়ে গুলি লাগছে। নড়তে পারে না। ওরে ধরতে যামু, দেহি, ডান হাতডা নাড়াইতে পারি না। পিছনে চাইয়া দেহি রক্তে ভিজা গেছে আইল। শরীরে গুলি খাইছি পাঁচটা। পায়েরটা কম ক্ষত ছিল। একটা গুলি কখন যে হাতের তালু ভেদ কইরা কনুইয়ের দিকে গেছে টের পাই নাই। গুলিডা ভেতরে আটকাইয়া যায়। গোলাগুলি একটু কমলে অর্ডার আসে ব্যাক করার। সবাই পিছনে চইলা যায়। কিন্তু আমরা দুইজন পইড়া আছি। শরীর তো চলে না। বহু কষ্টে কাদেরকে নিয়া এক দেড়শ গজ পিছনে যাইতেই সাথীরা আমগো তুইলা নেয়।’’
গুলিবিদ্ধ হওয়ার কষ্টের চেয়েও ভয়ার্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল তাজউদ্দিনের চিকিৎসার সময়টা। সে কথা বলতে গিয়ে চোখ ভেজান তিনি। বুকের ভেতরকার জামানো কষ্টগুলো যেন ঝরে পড়ে জল হয়ে। তাজউদ্দিনের মতো এক একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গল্প আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, অনেক রক্ত ও আ—ত্যাগের বিনিময়েই স্বাধীন হয়েছিল এই প্রিয় দেশটি।(মানুষের মাংস যে পিপড়ার পছন্দ এইডা একাত্তরে বুঝছি- পৃষ্ঠা-১১)
বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল। তার বর্ননা না শুনলে বোঝা যাবেনা। প্রিয় দেশ, মাটি মানুষের জন্য চুয়াডাঙ্গা শত্র“মুক্ত করতে জীবনকে যেন মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়ে নেমেছিলেন। তার কথার মধ্যে তিনি বাঙালীর আরেকদর বেঈমানের নাম উল্লেখ করেছেন যাদের বিচার আজও পুরোপুরি হয়নি। তারা হলো হানাদার বর্বর বাহিনীর সহযোগী। হানাদারদের বর্বরতাকে যারা আরো বেশী ভয়ংকর করে তুলেছিলো। তারা হচ্ছে-দেশদ্রোহী রাজাকার ,আল শামস, আলবদর। পৃথিবী বদলালেও এই দেশদ্রোহীরা বদলাবে না। এরা বাঙালী নিধনে মেতেছিলো যেমন একাত্তরে তেমনি সক্রিয় এখনও। গোলাম মোস্তফা দুলালদের মতো ত্যাগী যোদ্ধারাই মুক্ত করবে দেশ। গোলাম মোস্তফা দুলালের বিবরনীতে উঠে আসে একাত্তরের বীরগাঁথা-
‘১১ নভেম্বর ১৯৭১। সন্ধ্যাবেলা। কুমার নদীর ওপারে কুঠিবাড়ির কাছে পাওয়ার স্টেশনটি আমরা উড়িয়ে দিই। চুয়াডাঙ্গা থেকে দক্ষিণে যেন কোনো আর্মি আসতে না পারে সে কারণে সেখানকার রেললাইন উড়ানো হয়। এভাবে পরিকল্পনা করে কুষ্টিয়া থেকে আলমডাঙ্গাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আমরা তখন পজিশনে থাকি আলমডাঙ্গার চারদিকে।
‘গেরিলা সেজে শহরের ভেতরটা ‘রেকি’ করতে হবে। তাই ১২ নভেম্বর ভোরে চারজনকে নিয়ে নান্নু ভাই শহরে ঢুকলেন। আমরা তাঁর অপেক্ষায় থাকি। সময় সকাল ৯টা। হঠাৎ গুলির শব্দ। ভেতরে কিছু একটা হয়েছে। নান্নু ভাইকে উদ্ধার করতে হবে। আমরা কুমার নদী দিয়ে আলমডাঙ্গা শহরে ঢুকি। চারদিক থেকে অন্যরাও এগোতে থাকে। সোনালী ব্যাংকের পাশ থেকে চাঁদতারার দিকে ফায়ার দিই আমরা। ওখানে ছিল রাজাকাররা। খানিক এগোতে নান্নু ভাইকে পাওয়া গেল। তাঁর গ্রুপটি আগেই এক রাজাকারকে গুলি করে মেরেছে। চারদিকের আক্রমণে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা আশ্রয় নেয় আলমডাঙ্গা থানাতে। সেখানকার বাংকারে অবস্থান নিয়ে তারা ব্রাশ চালাতে থাকে।
“হান্নান ভাইসহ আমরা তিনজন ছিলাম অ্যাডভান্স পার্টিতে। একটা বাড়িতে পজিশন নিয়ে থানার দিকে দেখে দেখে ফায়ার দিচ্ছি। তখন মধ্য দুপুর। নান্নু ভাই গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু একটি গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়। কয়েকটা ঝাঁকি দিয়েই তাঁর শরীরটা নিথর হয়ে যায়। একইভাবে গুলিতে মারা যান বজলু ডাক্তারও। হাসু ভাই ঢুকছিলেন ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে। ওখানে মিলিশিয়ারা পোশাক ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ধরে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ভেবে তিনি কাছে যেতেই বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে ওরা। আনসার ভাই গুলি খান চাঁদতারার ওখানে। ওটা ছিল একটা আরবান ফাইট।
‘প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। আমাদের দৃষ্টি থানার দিকে। কিন্তু ডানে পোস্ট অফিসের কাছে যে একটা বাংকার আছে সেটা বুঝতেও পারিনি। ওরা ওত পেতে ছিল। আমাকে টার্গেট করেই ওরা গুলি ছুড়ে। আমিও পাল্টা জবাব দিব। হঠাৎ মনে হলো ধাক্কা খেলাম। হাত থেকে এসএলআরটাও পড়ে গেল। গুলি আমার মুখে লাগার কথা। কিন্তু তখন ম্যাগজিনটা কাট করছিলাম। এসএলআরটা মাঝখানে থাকায় গুলিটা প্রথম লাগে এসএলআরের বডিতে। অতঃপর স্প্রিন্টার ঢুকে যায় ডানহাতের কব্জিতে। ফলে হাড্ডি ভেঙ্গে মাংস বেড়িয়ে যায়। চামড়া ঝলসে গিয়ে রগগুলো গাছের শিকড়ের মতো ঝুলতে থাকে। রক্তে ভিজে যায় গোটা হাতটিই।”
তখনও জ্ঞান ছিল মুক্তিযোদ্ধা দুলালের। জীবন বাঁচানোর প্রাণান্তকর সংগ্রাম তখনও শেষ হয়ে যায়নি। বরং নিজেকে বাঁচানোর সে কাহিনি বড়ই করুণ, বড়ই কষ্টের। সেসময়ই চুয়াডাঙ্গা থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে ছুড়তে আলমডাঙ্গার দিকে চলে আসে। গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত দুলাল তখন আশ্রয় নেন আলমডাঙ্গার এক কবরস্থানে। পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে পুরনো একটি কবরে সারা রাত লুকিয়ে রাখেন নিজেকে। শুধু মৃত মানুষই নয়, একাত্তরে জীবিত মানুষেরও ঠাঁই নিতে হয়েছিল কবরে!
সে স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে চোখ পানি আসে দুলালের। বলেন, “হাতের ব্যথায় আমি গোঙাচ্ছিলাম। পরে নওশের আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যায় এরশাদপুর গ্রামে। সেখানেও ডাক্তার নেই। আমার হাত গামছা দিয়ে বাঁধা। সহযোদ্ধারা মসজিদের খাটিয়ায় তুলে নেয় আমায়। সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকে খাটিয়াটি। যেন লাশ আমি। পরে বেলগাছির ওহাব মেম্বারের বাড়িতে মিলে গ্রাম্য চিকিৎসা। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। পরে গরুর গাড়িতে করে নেওয়া হয় পাচুরিয়া গ্রামের বিলে। আমার হাত তখন পঁচতে শুরু করেছে। গন্ধে কেউ সামনে আসে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন লালচান আর শহিদুল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা পালকিতে করে আমায় বর্ডার পার করে আনেন। চিকিৎসা হয় করিমপুর ফিল্ড হাসপাতালে। আমার হাতে গ্র্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। হাতের দিকে চোখ পড়লে এখনও একাত্তরটা মনে পড়ে যায়।”
মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার । মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গর্ব। এই অলস পলির মায়ায় বিধৌত দেশকে রক্ষা করতে এইসব দেশ প্রেমিক একদিন জীবন বাজী রেখেছিলো। আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত বাংকারকে উড়িয়ে দিয়ে ছোট খাট অস্ত্র আর দেশপ্রেমের মনোবল দিয়ে। যেসব বীরেরা এসব দঃসাহসী বীরগাঁথার নির্মাতা আজও তারা গ্রামের মাটিতে মিশে গেছে জীবন সংগ্রামের তাগিদে। এসব মানুষকে মাটিবর্তী জীবনের ভেতর থেকে তুলে এনেছেন লেখক গবেষক সালেক খোকন। সালেক খোকনের সংগ্রহের ভাণ্ডার থেকে মাত্র ২১ টি যুদ্ধ কাহিনীর বর্ননা এই বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
একুশটি দুস্তর যুদ্ধবীরদের বনর্না ২১ টি মহাকাব্যকে হার মানায়। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস। কাজটি মুক্তিযুদ্ধে চেতনা জাগানিয়া সাড়া জাগানো একটি কাজ। এই বাংলাদেশের নরোম সবুজ নিসর্গ আর অলস পলির মায়ায় বিধৌত মৃত্তিকা আমার বাংলাদেশ। এই বইটি বাংলাদেগশের ইতিহাসের একটি অংশ। এ বইটিকে লক্ষ্য করে রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে তুলে আনতে পারে সেইসব বীরদের যাদের আাত্মদানে এদেশ স্বাধীন। সে ক্ষেত্রে বইটি হতে পারে মাইলফলক।

রিভিউটি প্রকাশিত হয়েছে বইনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২০ মার্চ ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button