কলাম

ওয়াসার লোকেরা কি টেপের পানিই পান করছে

সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আমরা দায়িত্বশীল ও বাস্তবভিত্তিক কথা প্রত্যাশা করি। সরকার নানামুখী উন্নয়ন চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সীমাবদ্ধতার কথাগুলোও যুক্তি দিয়ে তুলে ধরা যায়। কিন্তু কথার ফুলঝুরি আর কিছু কাগুজে রিপোর্ট দিয়ে সত্যকে ঢেকে দেওয়া যায় না। আমরা চাই ওয়াসার সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ হোক। ওয়াসা নগরবাসীর বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করুক। উন্নত বাংলাদেশে ওয়াসার টেপের পানিই হোক নিরাপদ পানীয়।

কৌতূহল আর কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই লেখার অবতারণা। ধরুন, আপনার বাড়িতে ওয়াসা কর্তৃপক্ষের লোকেরা গেলেন কোনো কারণে। প্রচন্ড খরতাপ। তাই তারা তৃষ্ণার্ত হলেন। পানি চাইতেই সরাসরি ওয়াসার টেপের পানিতে গ্লাস ভরে এগিয়ে দিলেন। ঘটনাটি যদি তাদের চোখের সামনেই ঘটে থাকে তবে কি তারা সেই পানি পান করবেন?

যদিও তাদের দাবি ওয়াসার টেপের পানি শতভাগ সুপেয়। সেই সুপেয় পানি তারা নিজেরাই নিজ নিজ বাড়িতে পান করেন কিনা সেটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে যাচাইও করা যেতে পারে। তাহলে হয়তো নাগরিক হিসেবে আমরা আশ্বস্ত হতাম এই ভেবে যে অন্তত ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সকলেই তাদের সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় ভেবেই পান করছেন। সুতরাং আমাদেরও তা পান করা উচিত।

ঢাকার বাসাবাড়িতে পানি ফোটাতে বছরে পোড়ানো হয় ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার গ্যাস। সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে ঢাকা ওয়াসার ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন। আর এই পানি ফোটাতেই বছরে জ্বালানি বাবদ ব্যয় হচ্ছে উল্লিখিত টাকার গ্যাস। অর্থাৎ বাসাবাড়িতে ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ঘনমিটার গ্যাসই পুড়ছে শুধুমাত্র পানি বিশুদ্ধকরণে। ঢাকা ওয়াসার গ্রাহকদের ৫১ দশমিক পাঁচ শতাংশ বলছেন, পানি অপরিষ্কার, ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ গ্রাহক পানিতে দুর্গন্ধ থাকার কথা বলেছেন। আর ৩৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ গ্রাহক বলছেন, সারা বছরই পানি অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধযুক্ত থাকে। টিআইবির প্রতিবেদনের কত ভাগ সত্য আর কত শতাংশ সত্য নয় সেটি প্রমাণ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তাদের প্রতিবদনের বিষয়টি যে মিথ্যা নয় সেটি এই নগরে বসবাসরত প্রায় সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করে নেবে।

এ বিষয়ে মুখ খুলেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষও। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান টিআইবির প্রতিবেদনকে মনগড়া উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি তিনি দাবি করেছেন ঢাকা মহানগরে সরবরাহকৃত ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়। ঢাকা মহানগরের একজন বাসিন্দা হিসেবে তার এই দাবির কথা শুনলে যে কেউই বিস্মিত হবেন। তিনি বলেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের মানদন্ড অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়। ঢাকা শহরে বসবাসরত এক কোটি ৭২ লাখ লোক সবাই পানি ফুটিয়ে পান করেন না। বরং ফুটানোর কোনো প্রয়োজনও পড়ে না।’

২৩ এপ্রিল ২০১৯, দৈনিক দেশ রূপান্তর

ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের মানদন্ডটি কোন সালে প্রদান করা হয়েছিল, সেটি সম্পর্কে আমরা পরিষ্কার ধারণা পাইনি। ওয়াসার পানি যদি শতভাগ সুপেয়ই হয়ে থাকে তবে কি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার নিজ বাড়িতে বা ওয়াসায় কর্মরতরা তাদের বাসাবাড়িতে সরাসরি টেপের পানিই পান করছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরটিও আমাদের জানা প্রয়োজন।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করতে পারতেন ঢাকাতে ওয়াসার পানি ফোটানোর পরিমাণ এখন অনেক কমেছে। কারণ হিসেবে গ্যাসের স্বল্পতা আর ঘরে ঘরে মানুষের ওয়াটার পিউরিফাই ফিল্টার কেনার কথাও উল্লেখ করা যায়। ঢাকাতে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই মিলবে এমন ফিল্টার। এটি কেনা বাবদ নগরবাসীর কত টাকা অপচয় হয়েছে সেই তথ্যও টিআইবির প্রতিবেদনে তুলে ধরা উচিত ছিল। এটাই বাস্তবতা। তাই ঢাকা ওয়াসার পানি ফোটাতে হয় না বরং শতভাগ সুপেয় এই নগরে বসবাসরত যে কোনো নাগরিকের কাছেই এটি ডাহা মিথ্যাচার বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

যদি ধরে নেওয়া হয় ওয়াসার এমডির দাবিটিই সঠিক। ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয় ও নিরাপদ। তাহলে, প্রশ্ন আসে এই ঢাকাতেই সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতিদিন শত শত অনুষ্ঠান, সভা, সেমিনার, কর্মশালা, মতবিনিময় প্রভৃতির আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সাংসদ, সচিব ছাড়াও বিশিষ্ট্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন। সেই অনুষ্ঠানে টেবিলে সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয় মিনারেল ওয়াটারপূর্ণ বোতল। কেন? অন্তত সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে কেন সুপেয় টেপের পানি রাখা হয় না? ওয়াসার পানি যদি শতভাগ নিরাপদ আর বিশুদ্ধই হয়ে থাকে তাহলে কেন এই মহানগরে মিনারেল ওয়াটারের ব্যবসা রমরমা হবে? সরকারিভাবে তো এগুলো বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। সেটি তো ঘটেনি। উল্টো ওয়াসা কর্তৃপক্ষই ‘শান্তি’ নামে মিনারেল ওয়াটার বাজারে ছেড়েছে।

নিরাপদ পানির জন্য এখন ঢাকার প্রায় অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলোতেই পানি পিউরিফাই ফিল্টার বসানো হয়েছে। যদি ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ ও সুপেয়ই হয়ে থাকে, তবে তো সরকারি অর্থ অপচয় করে পিউরিফাই ফিল্টার বসিয়ে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন পড়ত না। আর এতে তো এটাই প্রমাণিত হয় যে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই ওয়াসার পানির ওপর ভরসা রাখতে পারছে না।

সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসার এমডি দাবি করেছেন গত বছরের ১১ নভেম্বর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসার ১০টি মডস জোনের আওতাভুক্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৪৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরপর ই-কোলাই, কলিফর্মসহ অন্যান্য জীবাণুবিষয়ক ও ভৌত রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পরীক্ষার ফলাফলে ওয়াসার পানিতে কোনো ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া যায়নি। আবার ই-কোলাই পরীক্ষায় গভীর নলকূপে শতভাগ, সরবরাহ লাইনে ৮৪.৩৮ শতাংশ, গ্রাহকের জলাধার ৬০.২৮ শতাংশ সন্তোষজনক অবস্থায় পাওয়া গেছে।’ এসব গবেষণা কারা করছেন সে বিষয়েও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

নগরবাসীর বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করাই ঢাকা ওয়াসার কাজ। কিন্তু সেটি কি তারা করছে? আমার বাসা ঢাকা মহানগরের কাফরুল এলাকায়। এখানে দুবছর ধরে পানির সংকট। গরমের সময় এটি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ওয়াসার লাইনে দিনে একবার পানি দেওয়া হয়। যেটুকু পানি আসে তাও দুর্গন্ধযুক্ত ও দূষিত। পানি ধারণের পাত্রগুলোতে চোখ পড়লেই দেখা যায় অজস্র পোকা ঘুরছে।

দূষিত এই পানি ফোটানো ছাড়া পান করার উপায় নেই। সেটিও এখন করা যায় না গ্যাসের স্বল্পতায়। কেউ কেউ খাওয়ার পানি হিসেবে বাধ্য হয়ে বাজার থেকে কিনে আনছেন মিনারেল ওয়াটার। পানি না পেলেও পানির বিল যেমন কাফরুলবাসীকে পরিশোধ করতে হচ্ছে তেমনি বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি সংগ্রহে প্রতি মাসেই মানুষের জীবনযাপনের খরচ ক্রমাগত বাড়ছে। এছাড়া ডায়রিয়া ও চর্মরোগেও আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। এই সমস্যার কথা বহুবার ওয়াসাসহ সরকারের ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে বলা হয়েছে। স্থানীয় কমিশনার ও সরকারি দলের নেতারাও উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচারিতও হয়েছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধানের তেমন উন্নতি ঘটেনি।

যখন লিখছি তখনো নিজ ঘরে জমিয়ে রাখা ওয়াসার পানি দুর্গন্ধ ও ময়লাযুক্ত। নগরের অনেক জায়গাতেই ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির একই অবস্থা। ওয়াসার এমডি হয়তো সে খবর রাখেন না। তিনি যদি কাফরুলে এসে সরবরাহকৃত টেপের সুপেয় পানি খেয়ে আমাদের আশ্বস্ত করতেন, আমরা ধন্য হতাম।

সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আমরা দায়িত্বশীল ও বাস্তবভিত্তিক কথা প্রত্যাশা করি। সরকার নানামুখী উন্নয়ন চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সীমাবদ্ধতার কথাগুলোও যুক্তি দিয়ে তুলে ধরা যায়। কিন্তু কথার ফুলঝুরি আর কিছু কাগুজে রিপোর্ট দিয়ে সত্যকে ঢেকে দেওয়া যায় না। আমরা চাই ওয়াসার সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ হোক। ওয়াসা নগরবাসীর বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করুক। উন্নত বাংলাদেশে ওয়াসার টেপের পানিই হোক নিরাপদ পানীয়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল; ২৩ এপ্রিল ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button