মুক্তিযুদ্ধ

কাইয়ার গুদাম স্বাধীন হয় নাই!

১৯৭১ সাল। দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। থানায় থানায় বসেছে পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প। ফেঞ্চুগঞ্জে তারা ক্যাম্প বসায় কাইয়ার গুদামে। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে শান্তি কমিটি ও রাজাকারের লোকেরা। ওরা চিনিয়ে দিত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। বাবা ছিলেন ফরিদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ সভাপতি।

একদিন সন্ধ্যার পর বাবার খোঁজে বাড়িতে আসে পাঁচ-সাতজন রাজাকার। ফরিদপুর গ্রামের রাজাকার মঈন মিয়া, রশিদ মিয়া, মনাই মিয়া, তোতা মিয়া ছিল চেনা মুখ। বাবাকে না পেয়ে ওরা চাচারে ধইরা নিতে চায়। সাহস কইরা আমি সামনে যাই। তখন চাচার লগে ওরা আমারেও তুইলা নিয়া যায় কাইয়ার গুদামে।
ওটা ছিল পাঞ্জাবিদের টর্চারসেল। খুবই অন্ধকার জায়গা। খোদেজা আর মনুসহ ছিল শত শত নারী। মাঝে মধ্যে মানুষের গোঙানির শব্দ পেতাম। সেখানে আমার ওপরও চলে শারীরিক অত্যাচার। এক মাস চলে পালাক্রমে নির্যাতন। দু-তিন দিন পর মন চাইলে এক বেলায় দিত রুটির সঙ্গে একটু ডাল। একদিন শারীরিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যাই। ওরা তখন আমারে এনে ফেলে দেয় মাইজগাঁও স্টেশনের পাশে। ওই কাইয়ার গুদামে টর্চার করেছে আমার চাচাসহ শত শত লোককে। অতঃপর ওরা গুলি করে সবাইরে ফেলে দেয় কুশিয়ারা নদীতে। দেশ তো স্বাধীন হইছে ভাই। কিন্তু কাইয়ার গুদাম কি স্বাধীন হয় নাই? বলছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা লাইলি বেগম।
সিলেট থেকে কুশিয়ারা নদীর ব্রিজ পেরিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের পথে খানিক এগোতেই মিলে কাইয়ার গুদাম। আগে এটি ছিল পাটের একটি গুদাম। সম্মুখে কুশিয়ারা নদী। ফলে নদীপথে অন্যান্য থানার সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল সহজ। তাই পাকিস্তানি সেনারা এটিকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। গুদামটি অনেক বড়। কালচে ছাপ পড়া উঁচু তার দেয়াল। পেছনের দুটি দরজা কাঠ মেরে বন্ধ করা। সামনে একটি রল্ফম্নম ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারি কাজে। বাকি রুম ও গোটা গুদাম তালাবদ্ধ। নদীতীরে যেখানে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানেই মিলে ময়লার স্তূপ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখানে চরমভাবে অবহেলিত, অরক্ষিত।

একাত্তরে ফেঞ্চুগঞ্জের চারপাশের আরও চারটা থানার মুক্তিকামী মানুষকে ধরে আনা হতো কাইয়ার গুদামে। প্রথমে তাদের ওপর চলত টর্চার। এরপর গুদামের সামনেই কুশিয়ারা নদীর তীরে বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। কয়েকশ’ লোককে হত্যা করা হয়েছে এখানে। আর্মিদের এই ক্যাম্পটির দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আনসারী।
ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হলে কাইয়ার গুদামে প্রবেশ করেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের ভাষ্য- ‘আমরা তো গুদামে ঢুকেই ভয় পেয়ে গেছি। রক্তমাখা হাতের ছাপ। মানুষকে ওয়ালে ঝুলিয়ে টর্চার করেছে ওরা। দেয়ালে রশি বাঁধা। প্রথম দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি ঘর। মেঝেতে পা পড়তেই পা আটকে গেল। আঠার মতো কী যেন! মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখি মানুষের রক্ত জমাট হয়ে গেছে। পেছনে ছোট্ট ড্রেনে ছিল রক্ত ভর্তি। বড় ড্রেনটি রক্ত আর মাছিতে ভরা। মানুষের হাড়গোড়ও পেয়েছি অনেক।’

স্বাধীনতা লাভের সাতচল্লিশ বছর পরও কেন কাইয়ার গুদামে পড়েনি শ্রদ্ধার ফুল? কেন নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ? এসব প্রশ্ন আজও ঘুরপাক খায় ফেঞ্চুগঞ্জের মানুষের মনে!

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকালে, প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button