মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরের বীরনারী-০১ ‘ইতিহাস জিয়াকে ক্ষমা করবে না’

আমার বড় বোন ছিলেন ডায়নামিক। নাম সালেহা। সবাই ডাকত শেলী ইসলাম বলে। কিন্তু আমাদের কাছে উনি ‘বুবু’। ময়মনসিংহের মুমিনুন্নেসা কলেজে পড়তেন। ইপসু (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন) করতেন। কলেজের ভিপিও ছিলেন। মেয়েদের নিয়ে বড় বড় চিন্তা ছিল তার। ওই আমলেই তিনি রাইফেল সুটিং করতেন, ব্যাটমিন্টনও খেলতেন। আইয়ুব খান যখন পূর্ব পাকিস্তান এলো এর প্রতিবাদে তখন ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ উড়িয়েছিলেন বুবু। আমাদের পরিবারে পলিটিক্সের ধারণা ঢুকেছিল বুবুর মাধ্যমেই।

বুবু এখন পৃথিবীতে নেই। কিন্তু তার সবস্মৃতি এখনও আমাদের মন জুড়ে। উনি আমাদের নাচ শেখাতেন। ‘আজি ধানের ক্ষেতে রোদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা….’। এখনও কানে বাজে সে সুর। মন খারাপ হলেই নানা রকম মুখোভঙ্গি করে হাসাতেন। ভালবাসা দিয়ে তিনিই আমাদের সব শিখিয়েছিলেন।

ভারতেশ্বরী হোমসে আমি ভর্তি হয়েছিলাম কেজি টুতে। ভর্তির খবরটি প্রথম আনেন বুবুই। বাবা-মাও রাজি হয়ে যান। ছোটবোন জলিও নাচছে, সঙ্গে যাবে। আমার সঙ্গে ওকেও নিলেন। ট্রেনে যাচ্ছি মির্জাপুরে। সঙ্গে আনোয়ার ভাই। আমাদের ভাল নাম রেখেছিলেন দাদী। আমার নাম দেলোয়ারা খাতুন আর ছোটবোন মনোয়ারা খাতুন। বুবু বললেন ‘ভাল একটা স্কুলে যাচ্ছ। নামগুলো সেকেলে হলে তো চলবে না।’ ট্রেনে বসেই তিনি চিন্তা করতে থাকলেন। আব্বার নাম যেহেতু মহিউদ্দিন আহমেদ। বুবু তাই আমার নাম ডলি থেকে ডালিয়া আহমেদ আর ছোট বোনের নাম জলি থেকে জুলিয়া আহমেদ রাখলেন। বুবুর দেওয়া ওই নামেই আমরা আলোকিত হয়েছি।’
বড় বোনের স্মৃতিচারণ দিয়েই আলাপচারিতা শুরু করেন একাত্তরের বীরনারী মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ। এক বিকেলে উত্তরায় তার বর্তমান আবাসে বসেই কথা চলে আমাদের।

bir nari
ডালিয়া আহমেদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ

মহিউদ্দিন আহমেদ ও আশরাফুন্নেসার দশম সন্তান ডালিয়া আহমেদ। বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে। বাবা ছিলেন স্টেশন মাস্টার। পরিবারে ছিল এগার ভাইবোন–তিন বোন ও আট ভাই। এগার সন্তানেরই স্বপ্ন দেখেছিলেন মা আশরাফুন্নেসা।
সে কাহিনি শুনি ডালিয়া আহমেদের জবানিতে।

তাঁর ভাষায়–‘ব্রিটিশ আমলের কথা। এগার সন্তানের এক জননী রত্নগর্ভা উপাধি পেয়েছিলেন। সে ছবি ছাপা হয় পেপারে। তা দেখে মায়েরও ইচ্ছা এগার সন্তানের জননী হবেন। হয়েছিলেনও তাই। রত্নগর্ভা   মা। বড় ভাই আরিফুর রহমান, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে চাকুরি করতেন, রাওয়ালপিণ্ডিতে। এরপর আবু ইউসুফ খান (বীর বিক্রম), ছিলেন বিমানবাহিনীতে। তারপরই কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম), এগার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়েই তিনি মেজর থেকে কর্নেল হন। তাঁর ছোট আবু সাঈদ (দাদা ভাই), প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন। এরপরই আমাদের বুবু। তার ছোট ঝন্টু ভাই, ড. এম আনোয়ার হোসেন (মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক), শাখাওয়াত হোসেন বাহার (বীর প্রতীক), ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক), এরপর আমি আর সবার ছোট জুলিয়া আহমেদ।’

bir nari
মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়ার মা আশরাফুন্নেসা ও বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ

বাবার বদলীর চাকুরি। একেক সময় একেক স্টেশনে। ডালিয়ার জন্ম সিলেটে, টিলাগাঁও স্টেশনে। সেখান থেকে তারা আসেন ময়মনসিংহ রোড স্টেশনে। এখানে তাদের একটা ছোট্ট কোয়ার্টার ছিল। ভাইবোন বেশি হওয়ায় বাড়ির বারান্দাটা পার্টিশন দিয়ে ঘর বানানো হতো। তবে এ কষ্টকে তারা কখনও কষ্ট মনে করতো না। বাবার রিটায়ের্ডের পর ডালিয়াদের পরিবার চলে আসে কাজলা গ্রামে। ছুটিতে তখন বাড়িতে আসত কর্নেল তাহেরসহ সব ভাইরা। বাড়ির পরিবেশও সে সময় পাল্টে যেত। বালির বস্তা ঝুলিয়ে ট্রেনিং করানো হতো সবাইকে। আশপাশের মানুষ অবাক হয়ে দেখত সে কাণ্ড। মুচকি হেসে ডালিয়া শোনান সে ইতিহাস–
‘তাহের ভাই আমাদের কমান্ডো প্যারা পিটি শেখাতেন। বালির বস্তার কাছে নিয়ে আমাকে বলতেন ‘আপনিও কিন্তু ঘুষি দিবেন। শক্ত করতে হবে তো হাতগুলোকে।’ বাড়িতে ইন্দারা (কুয়া) ছিল। দড়ি বেঁধে সেখানে নামানো হতো বেলাল ভাই আর আমাকে। কিন্তু বাহার ভাই ছিলেন সবচেয়ে সাহসী। ইন্দারায় তিনি ঝাপ দিতেন আবার একা একা উঠে আসতেন। একটা দড়ি বাধা থাকতো গাছে। সেটা দিয়ে গাছের মধ্যেও উঠতে হতো। শীতের রাতে উঠানপোড়া পিঠা বানানো হতো বাড়িতে। আগুনের চারদিকে বসতাম সবাই। কলাপতায় মোড়ানো পিঠা। আগুনে পুড়ছে। তাহের ভাইজান বলতেন–‘আগুনের ওপর দিয়ে যে লাফ দিয়ে আসতে পারবে সে পিঠা পাবে।’ তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন একটা যুদ্ধ হবেই। তাই নানাভাবে পরিবারের সবাইকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছিলেন। এ কারণেই অন্য ভাইরা মুক্তিযুদ্ধে খুব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পেরেছিল।’
২২ মার্চ ১৯৭১। ডালিয়া তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। দেশের অবস্থা আচ করতে পেরে বড় ভাই আনোয়ার হোমস থেকে তাদের নিয়ে আসে কাজলা গ্রামে। ২৫ মার্চে সারাদেশে গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি আর্মিরা। ময়মনসিংহ থেকে অনেক পরিবারই এসে আশ্রয় নেয় তাদের বাড়িতে। দেশের সঙ্গে বদলে যেতে থাকে পরিবারের চিত্রও।

তাঁর ভাষায়–‘বাড়িতে অনেক মানুষ তখন। রান্নাবান্না চলছে। তবে যুদ্ধের ভয়বহতা তখনও আমরা বুঝি নি। নানা কাজে ব্যস্ত রেখে আম্মাও বুঝতে দিতেন না। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে শুনি আনোয়ার ভাই নাই। আম্মার কাছে একটা চিরকুট– ‘আম্মা, যুদ্ধে যাচ্ছি দোয়া করবেন।’ কিন্তু আম্মার চেহারায় উৎকন্ঠা নেই। কেমন যেন একটা গর্ব ও আনন্দ দেখতে পেলাম। কিছুদিন পরে বেলাল ভাই আর বাহার ভাইও নাই। একইভাবে তারাও চলে গেছে যুদ্ধে। আমরা নানা খবর শুনতাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। গোটা গ্রামের মানুষ আসত রাতে। চরমপত্র শুনতে বেশি ভাল লাগতো। এভাবে ধীরে ধীরে পরিবারে যুদ্ধের একটা আবহ তৈরি হতে থাকে।’
তখনও কি পাকিস্তানি সেনারা কাজলা গ্রামে আসেনি?
‘না। ওরা মনে করতো কাজলা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। আর আমাদের বাড়িটা হলো তাদের অস্ত্রাগার। ওরা গেরিলা আক্রমণের ভয়ে এদিকে আসেনি। তবে মাঝেমধ্যেই গ্রামে গুজব ছড়াতো– ‘মিলিটারী আইছে, মিলিটারী আইছে’। সবাই তখন দৌড়ে পালাত। আম্মার ভূমিকা দেখেছি ওই সময়টাতে। মাথা ঠান্ডা রেখে তিনি বলতেন–‘তুলা রাখ সবাই।’ যদি ওরা বোমা ফোটায়, গোলাগুলির শব্দে যেন বাচ্চাদের কানের ক্ষতি না হয়। মুড়ি, চিড়া আর গুড় আগেই প্যাকেট করে রেখে দিতে বলতেন।’

যুদ্ধকালীন অবস্থা ও ভারতে যাওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন ডালিয়া আহমেদ:

২৫ জুলাই ১৯৭১। কর্নেল তাহেরসহ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতের দেবীগড় সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। পরে কর্নেল তাহেরকে এগার নম্বর সেক্টরের কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিকে তাহেরের স্ত্রী লুৎফা নিরাপদ ভেবে বাবার বাড়ির থেকে দুই মাসের সন্তান জয়াকে নিয়ে চলে আসেন কাজলায়। কিছুদিন থাকার পরই চারজন মুক্তিযোদ্ধা গোপনে এসে খবর দেন তাদের জন্য কাজলা নিরাপদ নয়। ফলে একরাতে জয়াসহ লুৎফা, তার ভাই সাব্বির, দাদা ভাই, ডালিয়া ও জুলিয়া রওনা হয় সীমান্তের পথে। অতঃপর কী ঘটল সে কথা জানালেন ডালিয়া আহমেদ।

তিনি বলেন–‘প্রথমে শ্যামগঞ্জ থেকে ট্রেনে আসি ঠাকরাকোনায়। অতঃপর নৌকায় কংসনদী পাড় হয়ে ভুরভুরাসুনই নামক জায়গায় আশ্রয় নিই। ওখানে চারদিকে পানি। মাঝখানে বাড়ি। এক সপ্তাহ ছিলাম সেখানে। এরপরই পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা টের পেয়ে যায়। আমরা তখন সরে পড়ি। একদিন পরেই ওরা ওই বাড়িটা পুড়িয়ে দেয়।
রাতের অন্ধকারে মেধাবিল ও মাইসাসুর হাওড় পেরিয়ে আমরা কলমাকান্দা বাজারে এক মাঝির বাড়িতে উঠি। ওখানে তারা আমাদের ভাত খেতে দেয়। কিন্তু কোনো তরকারি নাই। কোথা থেকে যেন একটু চিনি এনে দিয়েছিল। ভোর হতেই বেরিয়ে পড়লাম। বর্ষাকাল। বৃষ্টি হচ্ছে। কাদার পিচ্ছিল পথ। এর মধ্যেই যাচ্ছি। নৌকায় উঠে সামনে একটা ব্রিজ পেরুবো। ব্রিজে পাহারায় রাজাকার আর পাকিস্তানিরা।
নৌকার পাঠাতনে বসা দাদা ভাই আর সাব্বির ভাই। ভেতরে ছইয়ের নিচে জয়াকে নিয়ে ঘোমটা টেনে বসা লুৎফা ভাবী। আমরা বাইরে ছেড়া জামা পড়ে বেচারার মতো মুখ করে দাড়িয়ে। ভয়ে বুক কাঁপছে। ব্রিজের ওপর থেকে পাকিস্তানিরা চিৎকার দিয়ে বলে–‘কোন হে?
মাঝি বলে– ‘হামারা পরিবার’।
কেন জানি ওরা ছেড়ে দিল। তা নাহলে বেঁচে আসতে পারতাম না।
এভাবে বহু কষ্টের পথ পেরিয়ে আমরা বাগমারায় পৌঁছি। সেখানে ছিল একটা চালা ঘর। তার চারদিকে ফাঁকা। এক রাত থাকতে হলো ওখানেই। সকালে উঠে দেখি জয়া নাই। আমরা তো আৎকে উঠি। খুঁজে দেখি গড়িয়ে একটা গর্তের মতো জায়গায় একটা ছাগলের সঙ্গেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে জয়া। অতঃপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় তুরার বিএসএফ ক্যাম্পে।’
তুরাতে পাহাড়ের ঢালে থাকত এক পরিবার। সেখানে দরশনা কুমারী নামে এক মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ডালিয়াদের। ওরা তীর-ধনুক চালোনায় পারদর্শী ছিল। দুই বোন শিখে নেয় তীর-ধনুক চালানো। মাঝেমধ্যে শিকারেও বের হতো। তারা ভাবত এই তীর-ধনুক দিয়েই তারা পাকিস্তানিদের মারবে।

bir nari
স্বামী রানা ঠাকুর (সালাহ্উদদীন রাজ্জাক) ও মেয়ে দামিনী জাকিয়া সালাহ্উদদীন-এর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ

কর্নেল তাহের সপ্তাহে একদিন দেখা করতে আসতেন। একবার ডালিয়া তাকে তার ইচ্ছার কথা জানান। শুনে হাসতে থাকেন তিনি। অতঃপর বোঝালেন যুদ্ধের জন্য লাগবে ট্রেনিং। ডালিয়া বলে–‘আমি যুদ্ধে যাব আমাকে নিয়ে যান।’ তাহের বলেন–‘আপনি যুদ্ধে যাবেন? আপনার তো পোষাকই নেই। কি করে যাবেন? ওটার জন্য তো প্রপার পোষাক দরকার হয়।’ শুনেই মন খারাপ হয় ডালিয়ার।
তারপর কী করলেন?
ডালিয়া বলেন–‘মেজ ভাইজান কিছু কাপড় নিয়ে এসেছিন তুরাতে। সেখান থেকে এক জোড়া  ট্রাইজার আর দুটো টি-শার্ট নিলাম। ওটাকে কেটে ছোট করে আমার সাইজে করা হলো। আগ্রহ দেখে একজোড়া কেইটস জোগাড় করে দিলেন লুৎফা ভাবী। আরেকটা ক্যাপও মিলল। তাহের ভাইজান আসার দিন সেগুলো পড়ে রেডি হয়ে অপেক্ষায় থাকি।
এবার উনি এসে অবাক হলেন। আমার আপাদমস্তক দেখে মুচকি হেসে বললেন–‘নাউ ইউ লুক লাইক এ রিয়েল গেরিলি’। ওইদিনই তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন মাহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে। ওই পাশে ধানুয়া কামালপুর। ভাইজান কী যেন বলে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে গেলেন। কিন্তু আমাকে যেতে দিচ্ছিল না। জানতে চাইছে ‘পাসওয়ার্ড’। আমি তো জানি না ওটা কী। পরে একজন কানে কানে বলে দিলেন। ওইদিনের পাসওয়ার্ড ছিল ‘টুপি’। ওটাই ছিল আমার প্রথম শিক্ষা।

 ট্রেনিং অপারেশনের কথা জানাচ্ছেন ডালিয়া আহমেদ:

পরদিনই ট্রেনিং শুরু হয়। আমার সঙ্গে ট্রেনিং করেছেন ব্যারিস্টার শওকত আলী। উনি ছিলেন টাঙ্গাইলের মানুষ, আওয়ামী লীগের একজন এমএনএ। এক সপ্তাহের মতো ট্রেনিং চলে। প্রথম শিখানো হলো কী করে ক্রলিং করে যেতে হয়। সবচেয়ে ছোট অস্ত্র ছিল এসএমসি (সাব মেশিন কার্বাইন)। যেটা আমি নিতে পারব, সেটাই চালানো শিখালো। নিশানা আমার খুব ভাল ছিল। সবাই বলতো– ‘বাহ! টার্গেট তো ভাল’। এমএমজি সেট করেও চালানো শিখেছি। তবে রাইফেলগুলোতে খুব ধাক্কা খেতাম। ট্রেন্ড মুক্তিযোদ্ধা ও ইন্ডিয়ান কিছু অফিসার ট্রেনিং করায়। একটা মেয়ে ট্রেনিং নিতে এসেছে– এটা দেখতেই আসত অনেকেই।’
ট্রেনিং শেষে কী করলেন?
মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদের উত্তর–‘অপারেশন থাকলে ভাইজান সীমান্তবর্তী জায়গায় আমাকে রেইকি করতে পাঠাতেন। অনেক সময় গাছে চড়ে পাতার ফাঁকে ফাঁকে ক্যামোফ্লাক্স করে থাকতে হতো। আমি খুব আশা নিয়ে যেতাম। ভাবতাম একটা পাকিস্তানিকেও যদি দেখি, গুলি করব। আমাকে চিরকুট দেওয়া হতো। গ্রামের মেয়ে সেজে এক ক্যাম্প থেকে সেটা আরেক ক্যাম্পে পৌঁছে দিতাম। এক বান্কার থেকে আরেক বান্কারেও যেতাম। মাঝেমধ্যে বান্কারেই থাকতে হতো। বলা হতো বের হওয়া যাবে না। গোলাগুলি চলছে। কী বিকট আওয়াজ। কিন্তু তাতেও ভয় হতো না। নিজেকে তখন যোদ্ধা ভাবতে শুরু করেছি। বোমা ও এন্টিপারসোনাল মাইনের বিষয়েও ধারণা হতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের ম্যাগজিনেও গুলি ভরে দিতাম। গানগুলোকে পরিস্কার করে দেওয়ার কাজও করেছি অনেক।
১৪ নভেম্বর ঢুকেছিলাম বাংলাদেশের ভেতরে। আনোয়ার ভাই সঙ্গে ছিলেন। ওইদিন ছিল তাহের ভাইজানের জন্মদিন। তাই ধানুয়া কামালপুর অপারেশনে জয় আনতেই হবে। অন্যপাশে বান্কার থেকে ওয়ারলেসে নানা নির্দেশ দিয়ে তাহের ভাইজান যুদ্ধটাকে পরিচালনা করছেন। একটা ঢালু জায়গায় রাত থেকে আমরা পজিশনে। ওয়ারলেসটা আনোয়ার ভাইয়ের কাছে। সকাল হয় হয়। গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। হঠাৎ ওয়ারলেসে একটা খবর আসে। তাহের ভাইজান আহত হয়েছেন। কিন্তু আশপাশের যোদ্ধারা বলছে কর্তা (কর্নেল তাহেরের ছদ্ম নাম) নেই। আনোয়ার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন–‘তোমাকে এখনই চলে যেতে হবে।’ এরপর আর রনাঙ্গণে ফেরা হয়নি।’
দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আপনি কোথায়?
‘তুরাতেই। সেদিন মনে হয়েছে কখন স্বাধীন দেশে যাব। ভাইয়েরা রণাঙ্গণে। তাহের ভাইজানের চিকিৎসা চলছে পুনাতে। ডিসেম্বরের শেষে একটা খোলা ট্রাকে করে আমরা ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজে এসে একরাত থাকি। অতঃপর চলে আসি কাজলায়। এর কিছুদিন পরেই আমাদের আবার পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতেশ্বরী হোমসে। ততদিনে সবাই জেনে গেছে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তখন সবাই অন্যরকম সম্মান করতো। মুক্তিযুদ্ধের গল্পও শুনতে চাইত।’
যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?
এ বীরনারী বলেন–‘পাকিস্তান আমলেও সম্প্রীতির মাঝে আমরা বসবাস করেছি। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান কাউকেই আমরা আলাদাভাবে দেখিনি। সব উৎসবই সমান গুরুত্ব পেত। ধর্মটা গুরুত্ব পেত না। স্বপ্ন ছিল অসম্প্রদায়িক দেশ পাব। সেটা হয়নি এখনও। দেখ, আজ চারদিকে এতো হেজাবধারী। আমাদের মায়েদেরকে তো দেখেছি খালি একটা ঘোমটা দিতে। তখন বোরখা নিয়েও মাতামাতি ছিল না। তাদের মধ্যে তো শালিনতা ছিল। তাহলে এখন এ কোন সংস্কৃতি শুরু হয়েছে দেশে!’
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন–‘একাত্তরে নারীরা যে কত রকমভাবে সাহায্য করেছে চিন্তা করা যাবে না। আম্মা রাতভর রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে, শুকনো খাবার দিয়ে তাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দিতেন। এরকম সাহায্য তো ঘরে ঘরে মা-বোনেরা করেছেন। দেশ থেকে সবাইতো যুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু মায়েরা, বোনেরা এই অবরুদ্ধ বাংলায় চরম নিরাশ্রয় অবস্থায় ছিল। হানাদারদের কাছ থেকে নিজেদের ও শিশুদের বাঁচানোটাই ছিল তখন আরেকটা যুদ্ধ। সে ইতিহাসের কথা কিন্তু তেমন তুলে ধরা হয়নি।’
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ। তাঁর ভাষায়– ‘নারী মুক্তিযোদ্ধার আলাদা করে কোন লিস্ট করা হয়নি। একাত্তরে যারা ধর্ষিত হয়েছেন, বলা হয় তারা সম্ভ্রম ও ইজ্জত হারিয়েছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন এ কথা। এটা তো ঠিক কথা নয়। তারা কেন সম্ভ্রম হারাতে যাবেন? বরং যারা নাকি তাদেরকে নিগৃহীত করলো তাদেরই সম্মান হানি হয়েছে। আমাদের নারীরা তো অত্যাচারিত হয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন। তারা একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। অনেক পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাও এটাকে বড় করে দেখতে চায় না। তিন দশক ধরে সমাজ তাদের স্থান দেয়নি। পরিবারও তাদের বিতাড়িত করেছে। অনেকেই নিজের কথা এখনও বলেনি। একাত্তরের নারীদের নিয়ে গবেষণাও কম হয়েছে। এই কাজগুলোও তোমাদের করতে হবে। তা না হলে তো পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হবে না।’
স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন ভারতীশ্বেরী হোমসে। সেখানে ব্যারিস্টার শওকত আলী ডালিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ‘মাই গ্রেট সিস্টার’ বলেই বঙ্গবন্ধু তার হাত দুটি বুলিয়ে দেন ডালিয়ার কপালে। জাতির পিতার সে স্নেহের স্পর্শটা আজও অনুভব করেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরে স্কুলে বসেই খুব কেঁদেছিলেন ডালিয়া।
অনেকেই বলেন জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ তৈরি করেছিল, আপনার মত কি?
দৃঢ় কন্ঠে তিনি বলেন–‘এটা একদমই ভিত্তিহীন কথা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাহের ভাইজানকে টেলিফোনে কথা বলতে দেখেছি অনেকবার। ভাইজানকে বঙ্গবন্ধু খুব স্নেহ করতেন। সে সময় দেশ চালানোর পদ্ধতি নিয়ে বিরোধিতা করেছিল জাসদ। কিন্তু তাই বলে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলবে- এটা তাদের চিন্তার মধ্যেও ছিল না। মোসতাক তো ছিলই, বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে ছিল জিয়াউর রহমানের হাত।’

পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে বলছেন মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ

কর্নেল তাহেরকে হত্যায় জিয়াউর রহমানের বিচার করতে না পারায় বুকে জমে থাকা কষ্টের অনুভূতির কথা জানান এই বীর যোদ্ধা। খানিকটা নীরব থেকে তিনি বলেন–
‘সোনার বাংলা গড়তে হবে’ শিরোণামে কর্নেল তাহের একটা লেখা লিখেছিলেন। কিছু লেখা ভাইজান বলতেন, আমি লিখতাম। ওইটা মেনে যদি দেশ চলত তবে বাংলাদেশটা সুন্দর হতো। জিয়া এই আইডিয়াগুলো নিয়েই পরিবর্তন করে প্রয়োগ করেছে। জিয়াকে কর্নেল তাহের চিনতে পারেন নি। তাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছিলেন তিনি। ৭ নভেম্বরে উনিই জিয়াকে উদ্ধার করেন। অথচ প্রহসনের বিচার করে কর্নেল তাহেরকেই ফাঁসি দিয়েছিল জিয়াউর রহমান। শত শত মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যকে সে হত্যা করেছে। কষ্ট হলো, জীবনদশায় আমরা জিয়ার বিচার করতে পারিনি। তবে ইতিহাস জিয়াকে ক্ষমা করবে না। দেশের সর্বোচ্চ আদালতই বলেছে– জিয়া ঠান্ডা মাথার খুনি আর কর্নেল তাহের খাটি দেশপ্রেমিক।’

দেশ কেমন চলছে?
মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া বলেন–‘উন্নতি হচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এ সরকার আরো থাকুক আমি চাই। তবে যারা এ সময় দুর্নীতি করছে, শেখ হাসিনা যদি একটু সাহস নিয়ে তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করতো, খুব ভাল হতো।’
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ– এমনটাই মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া আহমেদ। কিসের বিনিময়ে, কোন বলিদানে আমরা দেশটা পেলাম সেই সঠিক ইতিহাসটাও প্রজন্মকে জানতে হবে। তবেই তৈরি হবে দেশের প্রতি মমতাবোধ। সলিল চৌধুরীর ‘চাবি’ কবিতা আবৃতির মাধ্যমে কবিতার কথাগুলোই তিনি নিবেদন করেন পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে–
‘উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি শুধু একগুচ্ছ চাবি
ছোট-বড়, মোটা-বেটে নানা রকমের, নানা ধরনের চাবি
মা বললেন, যত্ন করে তুলে রেখে দাও।
তারপর যখন বয়স বাড়লো
জীবন ও জিবিকার সন্ধানে পথে নামতে হলো
পকেটে সম্বল শুধু সেই একগুচ্ছ চাবি।
ছোট-বড়, মোটা-বেটে নানা রকমের, নানা ধরনের চাবি।
কিন্তু যেখানেই যাই সামনে দেখি প্রকা- এক দরজা
আর তাতে ঝুলছে প্রকা- এক তালা,
পকেট থেকে চাবিরগুচ্ছ বের করি
এ চাবি সে চাবি
ঘোরাই ফেরাই
লাগে না, খোলে না
শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফেরি।
মা দেখেন আর হাসেন
বলেন-ওরে, তোর বাবার হাতেও এই চাবি দিয়ে, ওসব দরজাগুলো খুলে নি
শুনেছি নাকি তার বাবার হাতে খুলতো।
আসল কথা কি জানিস–
এসব চাবি হলো সততার, সত্যের, যুক্তির, নিষ্ঠার
আজকাল আর এসব দিয়ে কোন দরজা খোলে না।
তবুও তুই ফেলে দিস না
যতœ করে তুলে রেখে দিস।
তুইও যখন চলে যাবি
তোর সন্তানদের হাতে দিয়ে যাস সেসব চাবিরগুচ্ছ।
হয়তো তাদের হাতে আবার একদিন– ওইসব চাবি দিয়ে,
ওইসব দরজাগুলো খুলে যাবে।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৯ মে ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button