আদিবাসী

মালো বিয়ে: চাদরের আড়ালে বর কনেকে সিঁদুর দেয়

বিয়েতে মালো আদিবাসীরা বাড়ির উঠানে আঁকে নানা রঙের আলপনা। আলপনা আঁকার সময় এরা গান গায় :

মিন্দে কর মাতল পিয়া

সিতলিয়া আনানে

নিদো নাহি এ পিয়া

আয় আধার রাতিয়া করে কর বাজু আখে

গর এ খর বাজু আখে

 কে যে কলি লে লাই পিয়া

আয় আধার রাতিয়া

নিদো নাহি পিয়া

আয় আধার রাতিয়া

ডারাকর পিছু আখে

পিছু আখে ডার আখর

ছো আখে কে যে খলিলে

লাই পিয়া আয় আধার রাতিয়া

নিদ নাহিরে পিয়া

আয় আধার রাতিয়া।

ভাবার্থ : অনেক রাত করে ঘুমিয়েছি বিয়েবাড়িতে, আর কে যে পায়ের নূপুরটাকে নিয়ে নিল তা জানি না। আবার চোখে ঘুমও নেই। কে যে কোমরের বিছাটা নিয়ে নিল খুলে, তাও জানি না…।

অতঃপর কনেকে এনে উঠোনে বসানো হয় পূর্বমুখো করে। নিয়ম মেনে কনের একপাশে বসে বরের ভাই, অন্যপাশে কনের ভাই। সবার উপস্থিতিতে এরা একজন অন্যজনের বুকে পানপাতা ছোঁয়ায়। অতঃপর একে অন্যকে বিয়াই বলে সম্বোধন এবং বিটবিট (কোলাকুলি) করে। চারপাশে তখন মাদল-ঢোলের বাদ্য বাজে। কনে তখন দাঁড়িয়ে সবাইকে প্রণাম করে।

কৈইলনী পর্বের কথা জানতে চাইলে গঙ্গা মুচকি হাসেন। ছোট্ট একটি বাঁশের ঝুড়িতে কিছু মুড়ি এগিয়ে দেন আমাদের দিকে। অতঃপর বলতে থাকেন বিয়ের নানা পর্বের কথা।

মালো বিয়েতে গায়ে হলুদের তিন দিন পর হয় কৈইলনী পর্বটি। এ সময় দিনে ও রাতে উপোস থাকতে হয় কনেকে। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই দুধ আর রুটি। কৈইলনীর দিন খুব ভোরে উঠে জিগা গজ, বাঁশপাতা, ধান, সুপারি, এক টাকা, অরপন, সিন্দুর, ছোট ছোট সাদা কাপড়, সুতা, সঙ্গে নিয়ে কনেকে উঠোনে গিয়ে বসতে হয় মায়ের কোলে। ওই অবস্থাতেই কনে মাটি খুঁড়ে গর্ত তৈরি করে। সঙ্গে আনা জিনিসগুলো গর্তে মাটিচাপা দিয়ে তবেই ভাঙতে হয় উপোস।

মারোয়া পর্বের কথা উঠতেই বাসন্তী গান ধরেন :

‘চারকোনা চারখোট

মাঝে মারোয়া….

এ পর্বে বাড়ির উঠোনে মারোয়া সাজানোর সময় মালো আদিবাসীরা লুচকি নাচ নাচে। মারোয়া সাজাতে কি কি লাগে? গঙ্গার উত্তর, কলা গাছ লাগে চাইরটে, মইধ্যে একটা বাঁশ, ফুল দেইকে ঘেরেক লাগিল। একটি মাটির কলস রাখার জন্য মারোয়ায় তিন চাক মাটি বসানো হয়। বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) ও দিদিরা দলবেঁধে নেচে-গেয়ে মাঠ থেকে কেটে আনে সে মাটি। অতঃপর ঘরের ভেতর রাখা মাটির কলসটা নিয়ে উপোস অবস্থায় বোহনে ও দিদিরা পুকুর বা নদী থেকে কিছু পানি নিয়ে আসে। এটিকে পানিকাটা পর্ব বলে। বাসন্তী বলেন, এরপর যোগপানি উঘাইতে যাবে। বাড়ির বোহনে (দুলাভাই) কনেকে কোলে তুলে নিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। সেখানে ওই বাড়ির মেয়েদের চুল ও কনের চুল একত্র করে পানি ঢেলে সে পানির কিছু অংশ কলসে সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর কলসটা রাখা হয় গোপন একটি ঘরে। বাবা-মা ও বোহনে ছাড়া অন্য কেউ ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ থাকে। মালোরা বিশ্বাস করে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে কনের অমঙ্গল হবে। বিয়ের দিন সবাই উলুধ্বনি দিয়ে প্রথমে কলসটা নিয়ে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে। অতঃপর কলসটিকে রাখা হয় মাটির চাকের বিশেষ জায়গায়।

মালোদের বিয়ের মূল পর্বটিকে বলে বিহা। ওইদিন বাড়িতে নাপিত ডেকে প্রথমে কনেকে শুদ্ধি করানো হয়। কনের কানি আঙুল সামান্য কেটে আমবা (আম) পাতায় রক্ত নিয়ে তা বেঁধে দেওয়া হয় কনেরই হাতে। বরপক্ষ এলে কনের মা ও কাকিরা কুলাতে গোবর গুলি, গুড়ের গুলি, দূর্বাঘাস, আতপ চাল, মিষ্টি, পানি, পানপাতা, প্রদীপ বা বাত্তি নিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে নেয় বরকে। অতঃপর কনের ভাই বরকে গামছায় টেনে পাঁচ পাক ঘোরায় মারোয়ার চারপাশে। এরপর বর-কনেকে বসানো হয় মারোয়ায়। শুরু হয় দানপর্ব। আত্মীয়স্বজন তাদের আশীর্বাদ করে নানা উপহারে। দান শেষে বর-কনেকে মারোয়ার চারপাশে পাঁচ পাক ঘুরে পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়। এ সময় একটি শাড়ি বা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয় দুজনকে। চাদরের আড়ালে থেকে বর কনেকে সিঁদুর দেয়। গঙ্গার ভাষায়, কনিকাকে সিন্দুর পরাবে দুলা বাবু। অতঃপর বর-কনে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে  ফিরে সবাইকে প্রণাম জানায়। বিয়ে শেষে রাতভর চলে নাচ-গান আর হাড়িয়া খাওয়া। বিয়ের আট দিন পর মেয়ে আবার বাবার বাড়িতে আসেন। একে মালোরা আটমাংলা বলে।

মালোদের বিয়েতে কনে শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, বিভিন্ন অলংকার পরিধান করে। ছেলেরা ধুতি, পাঞ্জাবি ও মাথায় মুকুট পরে থাকে। পূর্বে মালো সমাজে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি ছিল। তবে বর্তমানে তা বদলে গেছে। এখন একক পরিবারের সংখ্যাই বেশি। এ আদিবাসী সমাজে বা পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা মূলত পুরুষের। পারিবারিক সম্পাত্তির ওপর নারীর কোনো অধিকার থাকে না। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থাকে ছেলে সন্তানের ওপর। তখন মা সাধারণত বড় ছেলে বা ছোট ছেলের কাছে থাকেন। তবে বর্তমানে মালোদের সমাজে সচেতনতা বেড়েছে। ফলে পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদেরও অংশগ্রহণ অনেক বেশি।

মালো সমাজে বিয়েবিচ্ছেদ নেই বললেই চলে। তবে কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হলে উভয়পক্ষের আত্মীয়স্বজন ও গ্রামপরিষদ তা মীমাংসার চেষ্টা করেন। তা না হলে সকলের উপস্থিতিতে বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটানো হয়। মালো সমাজে স্বামী স্ত্রীকে অত্যাচার করলেও পরিবার ও সমাজ চেষ্টা করে সংসারটিকে টিকিয়ে রাখতে। এসব বিষয় তারা খুব গোপন রাখেন। এ ছাড়া মালো সমাজে বহু বিয়ে একেবারেই নেই।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিই। মারিয়ার বাবা ভরত মালো আগ্রহ নিয়ে জানালেন মেয়ের বিয়ের খবরটি। নিমন্ত্রণও করলেন। কয়েক মাস পরেই মারিয়ার বিয়ে। ছেলে রংপুরের এক ওরাওঁ পরিবারের।

ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে মালো আদিবাসী সমাজে আজ শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা। এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। পাশাপাশি এরা নিঃশব্দে হারিয়ে ফেলছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পূর্বপুরুষদের আদি রেওয়াজগুলো। ধর্মান্তরিত হওয়ায় অন্য আদিবাসী জাতির সঙ্গে বিয়ে নিষিদ্ধের আদি বিশ্বাসটিও টিকে থাকেনি এ মালো পরিবারটিতে। এখন অন্য জাতি হলেও মালোদের মূল পরিচয় তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। ফলে বিয়ের সম্পর্ক করতেও নেই কোনো বাধা।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button