আদিবাসী

পাহাড়িয়া বিয়ে: এ আদিবাসী সমাজে গোলামি বিয়ের প্রচলন ছিল

সূর্যটা ডুবুডুবু। আমরা তখন গোলাই গ্রামে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রাম এটি। ৫০টির মতো পাহাড়িয়া পরিবারের বাস এখানটায়। এরা গোত্র প্রধানকে বলে মোড়ল। এ গ্রামের মোড়ল রঘুনাথ সিং। বয়স ষাটের মতো। পিতা দিয়াঋষি সিং ও মা পদ্যরাণী সিংয়ের আদরের সন্তান রঘুনাথের জন্ম তানোরের কচুয়া গ্রামে। এক সময় সেখানে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে জমি নিয়ে চলে নানা বিরোধ। ফলে নিজ জায়গায় টিকতে পারে না রঘুনাথের পরিবার। জীবনের তাগিদে চলে আসেন গোলাই গ্রামের শ্বশুড়বাড়িতে।

রঘুনাথের সঙ্গেই আমরা ঘুরে দেখছি গ্রামটিকে।

পাহাড়িয়াদের পূর্বপুরুষরা এ অঞ্চলে এসেছে ভারতে মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, মালদহো হতে। গোলাই গ্রাম ছাড়াও রাজশাহীর জামদাহ, কানাপাড়া, খৈড়া কান্দিতে রয়েছে তাদের আরো গ্রাম। এ জাতির নাম আগে পাহাড়ি বা পাহাড়িয়া ছিল না। নাম ছিল ‘তিরিংদাত’। এরা এ অঞ্চলে বসতি গড়ে জঙ্গল পরিস্কার ও রেললাইনের কাজের সূত্রে। সে সময় জমিদাররা তাদের বসিয়ে দেয় বিভিন্ন জায়গায়। তাদের কি নামে ডাকা হবে ? পাহাড় থেকে এসেছে বলে সে সময় তাদের ডাকা হতো পাহাড়ি বা পাহাড়িয়া। আর এভাবেই ডাকতে ডাকতে তিরিংদাত জাতি নাম বদলে হয়ে যায় পাহাড়ি বা পাহাড়িয়া।

এ আদিবাসী জাতির গ্রামগুলো পরিচালিত হয় তাদের গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় পরিষদও আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পাহাড়িয়াদের গ্রামগুলো পরিচালিত হচ্ছে গ্রাম প্রধান বা মোড়ল ও সাকিদার পদ নিয়ে। আদিবাসী গ্রামের সবার কাছে খবরাখবর পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে সাকিদারের। এ ছাড়া পাহাড়িয়াদের জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের নানা আচারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় মোড়লকে।

পাহাড়িয়া গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবক রনজিতের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়। পুরো নাম জানালেন রনজিত কুমার সরদার। অন্যদের নামের শেষে সিং শব্দটি ব্যবহৃত হলেও রনজিতের নামের শেষে সরদার কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি মুচকি হাসেন। অতঃপর জানান নানা তথ্য।

রনজিতের বাবা বিমল চন্দ্র সাওরিয়া আর মা মিনতি রানি। একসময় পাহাড়িয়াদের গোত্র ছিল চারটি। রনজিতের ভাষায়, সাওরিয়া, চেটে, কুমড়ে ও মাল। নামের শেষের টাইটেল দিয়েই পাহাড়িয়াদের গোত্রকে বোঝানো হয়। রনজিতের মা চেটে আর বাবা সাওরিয়া গোত্রের। তাই মায়ের নামের শেষে রানি আর বাবার নামের শেষে টাইটেল হিসেবে সাওরিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সেটিও অনেক আগের রীতি। এখন পাহাড়িয়ারা আর আগের টাইটেলগুলো ব্যবহার করে না। বর্তমানে এরা নামের শেষে টাইটেল হিসেবে সরদার ও সিং শব্দ দুটিই ব্যবহার করে থাকে। আদিবাসী নিয়মে পিতার টাইটেল হিসেবে রনজিতের নামের শেষেও সাওরিয়া যুক্ত থাকার কথা। কিন্তু সবার মতো তিনিও সরদার ব্যবহার করেছেন।

পাহাড়িয়াদের বিয়ের আদ্যপান্ত শুনি গোলাই গ্রামের মোড়ল, রনজিত, শ্যামল কান্ত সিংয়ের জবানিতে।

বিয়েকে পাহাড়িয়া ভাষায় বলে বেঞ্জে। সামাজিক নিয়ম মেনে এদের সমাজে বিয়ের আচারগুলো সমাধা করা হয়। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। ধরে নেওয়া হয় একই গোত্রভুক্ত ছেলেমেয়েরা আপন ভাইবোন। কিন্তু এখন অন্য জাতির সঙ্গেও বিয়ে হচ্ছে পাহাড়িয়া নারী-পুরুষদের। এ আদিবাসী সমাজে তিন বংশগোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ের প্রচলন নেই। বড়চাচা বা ছোটচাচার ছেলে মেয়ের সাথে ভাই-বোনের সম্পর্ক। তাদের দেহে একই গোষ্ঠীর রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তাই এই সম্পর্কে বিয়ে হয় না। কেউ যদি ভুল করে বিয়ে করেন তাহলে তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়। পাহাড়িয়াদের রীতিতে বর-কনের জন্মের দিনে বিয়ে দিন ধার্য করা হয় না। যদি কেউ এ রীতি ভঙ্গ করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে তবে তাকে সামাজিকভাবে জরিমানা করা হয়।

পাহাড়িয়াদের আদিবাসী বিয়ে মূলত পাঁচ প্রকার। যেমন : কথাবার্তার মাধ্যমে বিয়ে, প্রেমের বিয়ে, বদলি বিয়ে, গোলামি বিয়ে, ঘর জামাই বিয়ে। কথাবার্তার মাধ্যমে বিয়ের রীতি অনুসারে সমাজে ছেলে-মেয়ের বিবাহযোগ্য হলে বাবা-মা বিয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। কোনো মেয়ের বিবাহযোগ্য বয়স হলে সর্বপ্রথম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ঘটক মেয়ের বাড়িতে যায়। প্রথমে মেয়ের মা-বাবার কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়। জিজ্ঞেস করা হয় তারা তাদের মেয়েকে বিয়ে দিতে ইচ্ছুক কি না। যদি ইচ্ছে থাকে তখন ঘটক মেয়েকে দেখার দিন ধার্য করে। উভয় পক্ষের দেখা-দেখির আয়োজন করা হয়, দেখার পরে যদি উভয় পক্ষের পছন্দ হয় সেই ক্ষেত্রে বিয়ের কথাবার্তা এগোতে থাকে। পাহাড়িয়া সমাজে বরকে যৌতুক দিতে হয় না। তবে বরপক্ষকে কনে পণ ষোলো টাকা আট আনা দিতে হয়।

আবার ছেলে ও মেয়ের মধ্যে যদি প্রেম ও ভাব-ভালোবাসা হয়ে থাকে এবং দুই পক্ষের মা-বাবা যদি তাতে রাজি না থাকেন, তার ফলে তারা যদি দূরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় বসবাস করে, সেই ক্ষেত্রে পিতা-মাতা বাধ্য হয়ে সামাজিকভাবে এই বিয়ের ব্যবস্থা করে। এটিকে প্রেমের বিয়ে বলা হয়ে থাকে।

পাহাড়িয়া সমাজে বিয়ের কথাবার্তার সময়ে ছেলের হবু শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যদি ছেলের বিয়েযোগ্য বোনকে পছন্দ করেন তখন তাকে বদলি বা পাল্টাপাল্টি বিয়ে বলা হয়। এই বিয়েও ঘটকের সাহায্য নিয়ে করা হয়। এ ছাড়া আদিতে এ আদিবাসী সমাজে গোলামি বিয়ের প্রচলন ছিল। এ বিয়েতে বরকে কনে পণের পরিবর্তে শ্রম বিক্রি করতে হয়। নির্দিষ্টকালের জন্য শ্বশুরবাড়িতে বরকে বিনা পারিশ্রমিকে গোলামি করতে হয়। কোনো কারণে যদি বিয়ে না হয়, তাহলে কনের পিতাকে যে সময়ের জন্য শ্রমবিক্রি করেছে, তা প্রচলিত হারে পারিশ্রমিকরূপে ফিরিয়ে দিতে হয়। সাধারণত বর কনেকে পণ দিতে সমর্থ না হলে এই ধরনের বিয়ে করতে বাধ্য থাকে। বর্তমান পাহাড়িয়া সমাজে এ ধরনের বিয়ের প্রচলন নেই বললেই চলে। আবার যদি কারো একটি মাত্র কন্যা সন্তান থাকে সেই ক্ষেত্রে সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঘরজামাই গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে জামাই কথন পরিবারের পুত্র হিসেবে গণ্য হয়। এ ছাড়া পাহাড়িয়া সমাজে বিধবা বিয়ের প্রচলন রয়েছে।

এ আদিবাসী সমাজে মেয়ে বা ছেলে বিয়ের উপযুক্ত হলে গোত্রের সবাইকে জানানো হয় এবং ঘটক নিয়োগ করা হয়। কোনো পাত্রীর সন্ধান পাওয়া গেলে ছেলের মা-বাবা প্রথমে তাকে দেখতে যান। অতঃপর পাত্রীর গোত্র, জন্মমাস ও অন্যান্য বিষয় যাচাই করা হয়। এভাবে পাত্রী পছন্দ হলে একইভাবে পাত্রীপক্ষও পাত্র দেখতে আসে। অতঃপর বিয়ের দিন নির্ধারণ ও অন্যান্য আলোচনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রপক্ষ পাত্রীপক্ষের বাড়িতে উপস্থিত হয়। এ সময় পাত্রীপক্ষ তাদের সাধ্যমতো সবাইকে আপ্যায়ন করে। এ অনুষ্ঠানে অবশ্যই পাত্রপক্ষকে তাদের প্রিয় পাণীয় হাড়িয়া পরিবেশন করতে হয়। অন্যথায় পাত্রপক্ষকে অসম্মান করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ওইদিন পাত্রের মা পাত্রীকে আশীর্বাদ করেন। অনুরূপভাবে অন্য একদিন পাত্রীপক্ষও পাত্রপক্ষের বাড়িতে উপস্থিত হয়। ওইদিন একইভাবে পাত্রীর মা পাত্রকে আশীর্বাদ করে আংটি পরিয়ে দেন। এ সময় পাত্রীর পণও নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। পাহাড়িয়া বিয়ে রীতিতে পাকা কথার দিনই কনেকে কাঠের মালা ও খাড়– (লোহার তৈরি বালা) পরিয়ে দেওয়া হয়। যাতে গোত্রের যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারে যে মেয়েটির বিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে। বিয়ের দিন নির্ধারণের ক্ষেত্রে ছেলের বাবার ভূমিকা থাকে বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের বিয়ে হয় ফাল্গুন মাসে। কেননা এই মাসে নতুন ফসল ঘরে তোলা হয়। এরা বিশ্বাস করে ভাদ্র মাস বিয়ের জন্য অশুভ।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ০৬ জানুয়ারি ২০১৮

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button