আদিবাসী

কার্মু-ধার্মুর ভাগ্য জয়

সাঁওতাল গ্রামের দুই শিশু- কার্মু আর ধার্মু। দুই ভাই। বয়স মোটে দশ। সংসারে তাদের খুব অভাব। প্রায়ই না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। দুই ভাই ঠিক করলো, কিছু একটা করতে হবে।

ঘুরতে ঘুরতে এক ধনী বাড়িতে ধান রোয়ার কাজ পায় তারা। কাজে কাজে দুপুর হয়ে যায়। সবাই খেতে বসে। সারির সব শেষে জায়গা পায় কার্মু-ধার্মু। একে একে মুড়ি দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু হায় কপাল! তাদের কাছে আসতে আসতে শেষ হয়ে যায় মুড়ি।

খালি পেটেই দিনভর ধান বুনে তারা।

দিন শেষে মজুরি তোলার পালা। সেখানেও কপাল মন্দ। অন্যদের দিতে দিতেই টাকা যায় ফুরিয়ে।

দুই ভাইয়ের তাই খুব রাগ হলো।

‘চল, যা চারা লাগিয়েছি সব উপড়ে ফেলবো!’ কার্মু-ধার্মু ছুটলো মাঠের দিকে।

ঠিক তখনই হঠাৎ স্বর্গ থেকে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক বুড়ো। চুল-দাড়ি সব ধবধবে সাদা। মুখের চামড়া ভাঁজ ভাঁজ।

বুড়ো বললেন, ‘জালাপুরী দ্বীপে যাও। সেখানে আছে চন্দন পাহাড়। সেই পাহাড়ের জঙ্গলেই থাকেন ভাগ্যদেবতা। তাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই তোমাদের অভাব দূর হবে।’

বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন বুড়ো।

বুড়োর কথায় পথে নামলো দুই ভাই। যেতে যেতে পৌঁছলো উজারডি গ্রামে। হেঁটে হেঁটে তারা বড্ড ক্লান্ত। তাই এক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলো।

হঠাৎ কথা বলে উঠল সেই গাছ, ‘তোমরা কই যাচ্ছো?’

‘ভাগ্যদেবতার খোঁজে?’

কাঁঠালগাছ মিনতি করে বললো, ‘আমার শিকড়ের নিচে বহুদিন ধরে অনেক ধনরত্ন জমা হয়ে আছে। এগুলো আর আমি দেখভাল করতে পারছি না। ভাগ্যদেবতার দেখা পেলে কথাটা তাকে বলো।’

দুই ভাই জালাপুরীর পথ জানতে চাইলো। কাঁঠালগাছ বললো, ‘আগে তো অযোদিয়া গ্রামে যাও।’

বিশাল মাঠ। কার্মু-ধার্মু হাঁটছে আর হাঁটছে। ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে পেট। অযোদিয়া গ্রামে এক গোয়ালার বাড়িতে গিয়ে উঠলো তারা।

ভাগ্যদেবতার কথা শুনে তিনিও বললেন, ‘ভাগ্যদেবতাকে বলো, গোবর ফেলতে ফেলতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমি আর গরু পালতে চাই না।’

জালাপুরী দ্বীপের কথা জানতে চাইলে গোয়ালা বললেন, ‘সে তো বহু দূরের পথ। আগে তো গাঙ পার হও।’

মাঠের পর মাঠ। তারপর ঘন জঙ্গল পেরোতেই সামনে পড়লো খরস্রোতা এক গাঙ। গাঙে এক রাঘববোয়ালের সঙ্গে দেখা।

সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে ভাই?’

‘ভাগ্যদেবতাকে খুঁজতে যাচ্ছি।’

উত্তর শুনে বোয়াল মাছ দুঃখ করে বললো, ‘এ জনমে অনেক কষ্ট পেয়েছি। এবার মুক্তি চাই। যদি ভাগ্যদেবতার দেখা পাও, কথাটা তাকে বলো।’

শেষে কোন দিকে যেতে হবে বাতলে দিলো মাছ।

দিন-রাত পথ চলতে চলতে একদিন তারা পৌঁছে গেলো জালাপুরী। সামনে বিশাল এক সাগর। কূলহারা এই উত্তাল সাগর কীভাবে পাড়ি দেবে তারা। কার্মু ও ধার্মু সাগরপাড়ে বসে কাঁদতে লাগলো।

কান্নার শব্দ শুনে সাগর থেকে উঠে এলো বিশাল এক কুমির। কুমির দেখে ভয়ে একজন আরেকজনকে জাপটে ধরলো। কুমির তাদের অভয় দিলো। বললো, ‘ভয় পেয়ো না বন্ধু। কেন এসেছো এখানে?’

দুই ভাই কুমিরকে তাদের পোড়া কপালের কথা সব খুলে বললো।

সব শুনে কুমির বললো, ‘আমিই তোমাদের এই সাগর পার করে দেবো।’

শুনে কার্মু-ধার্মুর কী আনন্দ! কুমিরের পিঠে চড়ে বসে দুই ভাই। যেতে যেতে নিজের অনেক দুঃখের কথা বললো কুমির। বললো, ‘অনেক দিন ধরে খেতে পাই না। কিছু ধরতে গেলেই পালিয়ে যায়। এভাবে না খেয়ে থাকলে আমি মারা পড়বো। ভাগ্যদেবতাকে বলো, শিকার যেন আর আমার মুখ ফসকে যেতে না পারে।’

গল্প করতে করতে জালাপুরী সাগরের আরেক তীরে এসে পৌঁছে যায় কার্মু-ধার্মু। সামনেই একটা সবুজ পাহাড়। কুমির বললো, ‘এই তো চন্দন পাহাড়।’

পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ভাগ্যদেবতার প্রাসাদে পৌঁছে যায় তারা। ক্ষুধার্ত দুই ভাইকে দেখে ভাগ্যদেবতার দয়া হয়। এতো কষ্ট করে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে শুনে সিংহাসন থেকে নেমে আসেন। খেতে দিলেন সুমিষ্ট ফল। প্রতিশ্রুতি দিলেন, আবারও তাদের কাছে ফিরে যাবেন।

শুনে কার্মু-ধার্মু তো মহাখুশি। তারপর, এক এক করে কাঁঠালগাছ, গোয়ালা, বোয়াল আর কুমিরের নিবেদন শুনে মুচকি হাসেন ভাগ্যদেবতা।

বললেন, ‘কাঁঠাল গাছের নিচে পুঁতে রাখা ধনরত্ন তোমরাই নিও। গোয়ালাকে বলে দিও, আর একবার যেন সে ঝাটা দিয়ে গোয়াল পরিস্কার করে, তারপর তার মুক্তি। ওই গরুগুলোও তোমরা নিও।’

কার্মু-ধার্মু রাঘব বোয়ালের মুক্তির উপায় জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘তাকে বলে দিও, তারও আর কোনো দুঃখ থাকবে না।’

কুমিরের দুঃখের কথা শুনে ভাগ্যদেবতা বললেন, ‘আজ থেকে ও কোনো কিছু ধরতে গেলে আর পালাতে পারবে না। সেই হবে জালাপুরীর রাজা।’

ভাগ্যদেবতার থেকে বিদায় নিলো দুই ভাই।

পথে প্রথমেই কুমিরের সঙ্গে দেখা। দুই ভাই বললো, ‘তোমার মুখ থেকে আর শিকার ফসকাবে না। তুমিই হবে জালাপুরীর রাজা।’

বোয়াল মাছকে জানালো তার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। গোয়ালাকে বললো, ‘তুমি আর একবার ঝাড়ূ দিয়ে সব পরিস্কার করো। তারপর গোয়াল ছেড়ে চলে যাও।’

গোয়ালা চলে গেলে গরুগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আবার বাড়ির পথ ধরলো কার্মু-ধার্মু।

হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছালো উজারডি গ্রামে। সেই কাঁঠাল গাছের ছায়ায় আবার বসলো তারা। ভাগ্যদেবতার কথা শুনে শিকড়ের নিচের ধনরত্ন সব দুই ভাইকে দিয়ে দিলো গাছ।

এতো এতো টাকা-পয়সা, ধনসম্পদ আর গরু-বাছুর পেয়ে কার্মু-ধার্মুর সব অভাব দূর হয়ে গেলো।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সমকাল-এর ঘাস ফড়িং পাতায়, প্রকাশকাল: ৩০ জানুয়ারি ২০১৮  

  বই সংবাদ:

chondon pahara
চন্দন পাহাড়ে
প্রচ্ছদ ও অাঁকা: শামীম আহমেদ
প্রকাশক: ইকরিমিকরি ( বইমেলায় স্টল নম্বর-৫৩১)

ছোটদের জন্য এই গল্পটি আরও বিশদভাবে ‘চন্দন পাহাড়ে’ নামে বই আকারে প্রকাশ করেছে ইকরিমিকরি। বইমেলায় গ্রন্থটি পাওয়া যাবে ইকরিমিকরি’র ৫৩১ নম্বর স্টলে।

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button