আদিবাসী

ওরাওঁ বিয়ে (১): কনেপণ দিতে পাত্রপক্ষ বাধ্য

মধ্য বিকেল। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী টিনপাড়া গ্রামটি প্রায় পুরুষশূন্য। হাঁকডাক দিয়েও ওই ওরাওঁ গ্রামটিতে কোনো পুরুষের দেখা মিলল না। হাট বসেছে পাশের বহবলদীঘি বাজারে। তাই সেখানে নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছেন এ গ্রামের পুরুষরা। কৃষিপেশা তাঁদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। নানা কারণে জমি হারিয়ে জীবিকার তাগিদে তাঁরা অনেকেই এখন যুক্ত হয়েছেন নানা ব্যবসায়।

গ্রামটির বাড়িঘর বেশ পরিচ্ছন্ন। পরিপাটি করে গোছানো। গোবর লেপা উঠোন। একটি বাড়ির এক কোণে মাটি লেপা তুলসীতলা। সেখানে জল ছিটিয়ে গৃহঠাকুরকে ভক্তি করছেন এক বৃদ্ধা। নামটি তিনি নিজেই জানালেন।

মুংলী তির্কী। বয়স আশির মতো। চোখেমুখের চামড়া ভাঁজখাওয়া। ভাঁজের পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। আমাদের চোখ আটকে যাচ্ছিল সেদিকে। তিনি বললেন, সকালে-সন্ধ্যায় তুলসীতলার এমন আচার চলে টিনপাড়ার ওরাওঁ বাড়িগুলোতে।

ওরাওঁরা এ উপমহাদেশের ভূমিজসন্তান। তারা বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে কংকা নদীর উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে কনাটকা হয়ে অমরকণ্টক ফরেস্ট রেঞ্জে এসে পৌঁছায়।
অনেকেই মনে করেন, খ্রিস্ট জন্মের ১৭৫০ বছর আগে হরপ্পা থেকে ওরাওঁরা শাহাবাদের রোহটাস অঞ্চলে চলে আসে, যা বর্তমানে হরিয়ানা ও যমুনার সমতলভূমি হিসেবে পরিচিত। শারীরিক গঠন ও ভাষাগত বিচারে ওরাওঁরা দ্রাবিরিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত। তাদের বসবাস ছিল ভারতের উড়িষ্যা, ছোট নাগপুর ও রাজমহল অঞ্চলের পার্বত্য এলাকায়। দেশ ভাগের আগেও দিনাজপুরে বহু সংখ্যক ওরাওঁয়ের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দলিলে।
১৭৮০-৮২ খ্রিস্টাব্দের কথা। ওই সময় দিনাজপুরের রাজ জমিদারির দেওয়ান ছিলেন দেবী সিংহ। তিনি তাঁর খেয়াল-খুশিমতো ধার্যকৃত খাজনা আদায় করতে কৃষকদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালান। ফলে ওই সময় গোটা উত্তরবঙ্গই কৃষকশূন্য হয়ে পড়ে। এতে অনাবাদি অবস্থায় পড়ে থাকে ফসলি জমিগুলো। দেবী সিংহের পতনের পর দেওয়ান নিযুক্ত হন রাজমাতুল জানকিরাম। তিনি অনাবাদি জমি চাষাবাদের জন্য সাঁওতাল পরগনা, ছোট নাগপুর, দুমকা, রাজমহল প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আদিবাসী কৃষক ও শ্রমিক নিয়ে আসেন এবং তাদের খাজনামুক্ত জমির বন্দোবস্ত দেন। এভাবেই দিনাজপুরে আগমন ঘটে ওরাওঁদের। এ ছাড়া রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর প্রভৃতি অঞ্চলে এদের বসবাস রয়েছে।
সন্ধ্যা হয় হয়। ওরাওঁ গ্রামের পুরুষরাও ফিরতে শুরু করে। গোত্রের মহত বা প্রধান নিপেন টিগ্গা হাসিমুখে সঙ্গ দেন আমাদের। তাঁর মুখে শুনি ওরাওঁদের গ্রাম পরিষদের কথা। একসময় ওরাওঁ গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল তাদের নিজস্ব গ্রাম পরিষদের হাতে। ওরাওঁ ভাষায় এটি ‘পাঞ্চেস’। বয়োবৃদ্ধ সাত-আটজনকে নিয়ে গঠিত হতো এ গ্রাম পরিষদ। প্রতিটি পরিষদে থাকত একজন মহত বা মাহাতো এবং একজন পুরোহিতসহ অন্যান্য পদ। আবার পাঞ্চেস এর ওপরের সংগঠনের নাম ছিল পাঁড়হা। পাঁড়হা সাধারণত  সাত থেকে বারোটি ওরাওঁ গ্রাম নিয়ে গঠিত হতো। এসব গ্রামের মাহাতো বা মহতদের মধ্য থেকে একজন পাঁড়হা প্রধান নিযুক্ত হতেন। ওরাওঁ ভাষায় তাকে বলে পাঁড়হা রাজা। কিন্তু সময়ের হাওয়ায় ওরাওঁদের আদি গ্রাম পরিষদটি এখন আর টিকে নেই। টিনপাড়ার ওরাওঁ গ্রামের পরিষদটি চলছে শুধু মহত পদটি নিয়ে। জন্ম, মৃত্যু ও বিয়েতে নানা আনুষ্ঠানিকতায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় গোত্রের মহতকে। হঠাৎ ঢোল-মাদলের বাদ্যি। উঠোনের এককোণে একদল ওরাওঁ আদিবাসী গাইছে :
‘আরে ও ওরে
রেহি রে রে রে রে রে
দিয়া যে রায়ঝ দিয়ারা রে দিয়ারা
কা করে উরোজনা বাড়িরে
আরে-আগে যে জাগাওয়ে গজোমতি গাহা হো
তোকোর পিছে জাগারো কৃষানোরে।’

(গানের ভাবার্থ : বাড়িওয়ালা তুমি বাতি জ্বালিয়ে কী করো, কিসের জন্য বাতি জ্বালাও, বাতি জ্বালিয়ে গোয়ালে গরুগুলোকে জাগিয়ে তুলছি এবং পরে কৃষককে জাগিয়ে তুলব পূজার জন্য।)

ওরাওঁ আদিবাসী সমাজে গোত্র রয়েছে ২০টির মতো। এদের একই গোত্রের সবাই সমতুল্য বলেই বিশ্বাস করে। তাই এদের সমাজে একই গোত্রে বিয়ে সম্পন্ন নিষিদ্ধ ও পাপ বলে গণ্য। ওরাওঁদের গোত্রগুলোর নামকরণ করা হয়েছে পশুপাখি ও বস্তুর নামানুসারে। মুংলীর মুখে শুনি গোত্রগুলোর নাম টিগ্গা অর্থ বানর, বান্ডো অর্থ বনবিড়াল, বাড়া অর্থ বটগাছ, বাঁড়োয়া অর্থ বন্যকুকুর, বাখলা অর্থ এক প্রকার ঘাস, বেক অর্থ লবণ, কেরকোটা অর্থ চড়ুই পাখি, কিন্ড অর্থ এক প্রকার মাছ, কিসপট্রা অর্থ শূকরের নাড়িভুঁড়ি, কুজুর অর্থ এক প্রকার লতাজাতীয় গাছ, লাকড়া অর্থ বাঘ, মিঞ্জি অর্থ এক প্রকার মাছ, পান্না অর্থ লোথা, তির্কী অর্থ একজাতীয় মাছ, টপ্প অর্থ একজাতীয় পাখি, খাখা অর্থ একজাতীয় কাক, খালখো অর্থ একজাতীয় মাছ, খেস অর্থ ধান প্রভৃতি। ওরাওঁ সমাজ পিতৃসূত্রীয় হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষরা নারীদের মতামত গ্রহণ করে থাকে। এদের পরিবারে সাধারণত নারী ও পুরুষের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। তারা একে অপরের ওপর নির্ভরশীলও।

মাটির দেয়াল ঘেরা মুংলীর পাশের বাড়িটি বেশ বড়। ভেতরের ঘরগুলো মাটি আর ছনে ছাওয়া। মুংলীর সঙ্গে আমরা পা রাখি বাড়িটিতে। আমাদের শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন এক বৃদ্ধা।
নাম তাঁর মায়া টিগ্গা। বয়স নব্বই ছুঁইছুঁই। বয়সের ভার এখনো তাঁকে কাবু করতে পারিনি। কিন্তু বয়সের টানে তিনি হারিয়েছেন দুইপাটির দাঁতগুলো। ফোকলা দাঁতে হাসি তুলে তিনি আমাদের বসতে দেন মাদুর বিছিয়ে। খবর পেয়ে আরেক বাড়ি থেকে আসেন তার বোন পারলো টিগ্গাও।
ওরাওঁদের নানা বিষয় নিয়ে চলছে কথোপকথন। হঠাৎ আসরে আসেন এক নারী। কপালে তাঁর লাল টিপ। মাথার সিঁথিতে ভরাট সিঁদুর ও হাতে শাঁখা-খাড়ু। নাম জানালেন মালতি খালকো। মায়া টিগ্গার ছেলের বউ। আমাদের জন্য নিয়ে আসেন চিড়া-মুড়ি। খেতে খেতে কথা হয় ওরাওঁদের বিয়ে নিয়ে। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে মায়া টিগ্গা বলেন ওরাওঁ বিয়ের আদ্যোপান্ত।

ওরাওঁ সমাজে ছেলের বয়স আঠারো ও মেয়ের বয়স বারো হলে বিয়ের উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিয়েতে অভিভাবকরা মতামত দিলেও ছেলেমেয়ের অভিমত ব্যক্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়। ওরাওঁদের বিয়েতে পণপথা চালু রয়েছে। কনেপণ দিতে বরপক্ষ বাধ্য থাকে। পণের পরিমাণ সর্বনিম্ন পঁচিশ টাকা। তবে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে পণের পরিমাণের তারতম্য ঘটে।

চুক্তিবদ্ধ ও প্রেমঘটিত—এ দুই ধরনের বিয়ের প্রচলন রয়েছে ওরাওঁ সমাজে। তবে এদের অধিকাংশ বিয়ে সম্পন্ন হয় চুক্তিভিত্তিক, অর্থাৎ আগুয়ার বা ঘটকের সহযোগিতায়। আবার যদি কোনো যুবক-যুবতী প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের অভিভাবকরা সেটা মেনে না নেয়, তখন তারা গ্রাম থেকে পালিয়ে দূরে কোনো আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়দাতারা উভয় পক্ষের অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিয়ে সম্পাদনের উদ্যোগ নেয়। তবে অভিভাবক রাজি না হলে এ বিয়ে সম্পন্ন হয় না।

ওরাওঁ বিয়েতে কনেপণ দিতে পাত্রপক্ষ বাধ্য থাকে। পণের পরিমাণ সর্বনিম্ন একশ টাকা। তবে স্থান, কাল ও পাত্রবিশেষে এর পরিমাণের তারতম্য ঘটে। বিয়েতে কনেপক্ষকেই বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়। প্রথমে কনেপক্ষ রাজি হলে পাত্রপক্ষকে তা জানানো হয়। এরপর পাত্রপক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে প্রথমে কনেপক্ষের অভিভাবক ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ পাত্রের খোঁজ-খবর নেয়। তাদের পূর্ণ সম্মতি থাকলে পাত্রপক্ষকে জানানো হয়। তেমনিভাবে পাত্রীপক্ষের সম্মতি পেলে বরপক্ষ কনে সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়। উভয় পক্ষের মধ্যস্থতা করে থাকেন আগুয়ার বা ঘটক।

একটি নির্ধারিত দিনে পাত্র দু-একজন বন্ধু-বান্ধবসহ অভিভাবকদের নিয়ে কনের বাড়িতে কনে দেখতে যায়। সব দিক বিবেচনায় কনে পছন্দ হলে তাকে সাধ্যমতো টাকা দেওয়া হয়। কনেপক্ষও তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে। প্রিয় পাণীয় হাড়িয়া দিয়ে আপ্যায়িত করে। একইভাবে কনেপক্ষও পাত্রপক্ষের বাড়িতে গমন করে। ওই দিন উভয়পক্ষের মুরুব্বিরা একত্র হয়ে বিয়ের দিন নির্ধারণ করে। একে ওরাওঁরা কুটমেত অনুষ্ঠান বলে। দিনক্ষণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে পঞ্জিকার সহায়তা নেওয়া হয়। তবে ওরাওঁ সমাজে জন্মদিন, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও একাদশীতে বিয়ে একেবারেই নিষেধ থাকে। আবার চৈত্র ও ভাদ্র মাসে আদৌ বিয়ে হয় না। পৌষ মাসে বিয়ের কথাবার্তা বলা থেকেও ওরাওঁরা বিরত থাকে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

© 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button