মুক্তিযুদ্ধ

ওই ভাষণই জীবনের গতি পাল্টে দেয়

“ঢাকায় তখন আর্মি নেমেছে। ওরা সারাদেশ কব্জায় নিতে থাকে। বিহারিরা ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে। ২৫ মার্চের পর ওরা বেদেরগঞ্জের নদীপথে নৌকায় করে গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা তখন অনেকগুলা নৌকা ডুবিয়ে দিই। মে-জুনে আমাদের ওখানে আর্মি আসে। তার আগেই শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির বড় নেতা ছিল তিনজন– আবদুর রশিদ, রফিক ও টি কে খান। এরা হিন্দু এলাকায় লুটপাট করত বেশি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বললেই তারা পেছনে লাগত। ওদের ভয়ে হিন্দুরা পালাতে থাকে। আমরাও বাড়িতে থাকতে পারি না। একেক রাতে একেক জনের বাড়িতে লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? কিছু একটা করতে হবে।”

“গ্রামের যুবকরা গোপনে সব এক হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা সাজনপুর হাই স্কুলের মাঠে ট্রেনিংয়ের আয়োজন করে। বাঁশের লাঠি নিয়ে সেখানে ট্রেনিং চলে প্রথম। ট্রেনিং নেন শতাধিক যুবক। ট্রেনার ছিলেন আর্মির হাবিলদার মহিউদ্দিন ও বিমান বাহিনীর সার্জন রশিদ।”

“পরে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের বাছাই করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাদারীপুর নাজিমুদ্দিন কলেজে। স্টুয়ার্ড মুজিব ও ক্যাপ্টেন শওকত সাহেব ছিলেন সেখানে। একদিন পরই ভোরে নৌকায় করে হাইমচর হয়ে চৌদ্দগ্রাম দিয়ে ফেনীর আলী আজম হাই স্কুলে আসি। নাওয়া-খাওয়া তখন ভুলেই গিয়েছিলাম। কাঁচা কাঠাল আর মুছি খেয়ে থেকেছি কয়েক দিন। এরপর ভারতীয় সীমান্ত পার হতেই দেখি অপেক্ষা করছে বড় বড় লরি।”

“তখনও জানি না গন্তব্য কোথায়। উঁচু-নিচু পথ দিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের কাঁঠালিয়ায়। সেখানেই জঙ্গল পরিস্কার করে থেকেছি ৭-৮ দিন। ক্যাম্প করার প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি সেখানে বম্বিং করায় তা হয়নি। ফলে আমাদের সরিয়ে নেওয়া হয় আরও দূরে, ভারতের ত্রিপুরার ওমপি নগরে।”

“ওখানে দেড় মাস কঠিন ট্রেনিং হয় আমাদের। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং– ৭২৭৯। রাইফেল, এলএমজি, গ্রেনেড, টুইঞ্চ মর্টার, ডেমুনেশন প্রভৃতি শেখান পাকিস্তানি সেনারা। কষ্ট ছিল খুব। হাত-পা ছিলে যেত। খাওয়ার কষ্টও কম ছিল না। জোঁকের কামড় ছিল নিয়মিত ঘটনা। সব কিছু সহ্য করে খাঁটি যোদ্ধা হয়েছিলাম দেশের টানে। কিন্তু অনেকেই তখন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায়। ৩১ জনের মধ্যে আমাদের ১৪ জনই পালায় ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে। এখন ওরাই বলে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল!”

মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমানের যুদ্ধদিনের স্মৃতি শুনতে ক্লিক করুন:

“ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনার আবদুল সোবহানের কথা খুব মনে পড়ে। বাসুদেব বললেই সবাই তাঁকে এক নামে চিনত। তাঁকে আমি মামু মামু বলে ডাকতাম। আমার কান ধরে একদিন হেসে হেসে তিনি বললেন, ‘শালা, তুম বাপ কো শালা বানাতা হ্যায়’।”

“ইন্ডিয়ান সেনারা আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণ করিয়েছিলেন। দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁরা বলতেন, ‘একদিন তোমাদের দেশ ঠিকই স্বাধীন হবে। তোমাদের দেশ তোমাদেরকেই স্বাধীন করতে হবে’।”

“তাদের ওই কথাই পরে সত্যি হয়েছিল।”

ট্রেনিংয়ের গল্প দিয়েই শুরু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের যুদ্ধকথা।

মতিউর রহমান ও জয়নব বিবির বড় সন্তান তিনি। বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মগর গ্রামে। বাবা ছিলেন খেটে-খাওয়া মানুষ। সামান্য কিছু জমি ছিল তাঁর। তাতে চাষবাস করে যা পেতেন তা দিয়ে পরিবার চলত না। কেননা আতিকুর ছাড়াও পরিবারে ছিলেন তাঁর আট বোন।

নানা মোহন ঢালী আর মামাদের আদর বেশি পেতেন আতিকুর। তাঁরা চাইতেন ছোট্ট আতিকুর লেখাপড়া করুক। ফলে শিশু আতিকুরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সাজনপুরে, নানাবাড়িতে। মামা আবুল হাসান ও শামসুল হক ঢালীর স্নেহে বড় হতে থাকেন আতিকুর। তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি সাজনপুর প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পাশের পরই ভর্তি হন সাজনপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এ স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র।

শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,

1971 muktijodda
পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমানের বাম কানের লতি ছিঁড়ে মাথার পেছনে বিদ্ধ হয়

“খুব দুরন্ত ছিলাম। এমন কোনো কাজ নেই যেটা করতে পারতাম না। বন্ধু সামাদ, কাশেম, রাজ্জাক, জমিরের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম। গরমের সময়টা ছিল অন্যরকম। তখন মজা হত বেশি। কারও গাছের আম-কাঁঠাল পাকলে সেটা আমরা দলবেঁধে চুরি করে খেতাম। এসবই করতাম মজা করে। আবার গ্রামের কেউ বিপদে পড়লে আমরাই আগে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম।”

লোকমুখে আতিকুর শুনতেন বঙ্গবন্ধুর কথা। বাঙালিদের কথা বলতেন তিনি, দেশের জন্য জেল খেটেছেন অনেক বছর। মামারা কলেজে পড়তেন। তারাও দিতেন দেশের প্রতি নানা বৈষম্যের খবর। পাট হত পূর্ব পাকিস্তানে। সে পাট বিক্রির টাকায় উন্নত হত পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতিটা একেবারেই ছিল না। কাগজ তৈরি হত এখানে। অথচ সে কাগজই বেশি দামে কিনতে হত এখানকার মানুষদের। বাঙালিদের চাকরির সুবিধা ছিল খুব কম। বৈষম্যের কথায় আতিকুর ঠিক থাকতে পারতেন না। আবদুর রাজ্জাক, আবেদুর রেজা খান এরা তখন ওখানে আওয়ামী লীগের নেতা। ছাত্রনেতা ছিলেন জয়নাল আবেদীন ও এম এ রেজা। তাঁরা বক্তৃতা দিলেই হাজির থাকতেন আতিকুর।

সত্তরের নির্বাচনে পাড়া-মহল্লায় নৌকার পক্ষে কাজ করেন আতিকুররা। স্লোগান আর পোস্টার নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন গ্রামে গ্রামে। শরীয়তপুরে এমএনএ নির্বাচিত হন আবেদুর রেজা খান। সারাদেশে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করলেও ক্ষমতা দেয় না পাকিস্তানি সামরিক সরকার। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। মিছিল-মিটিংও তখন বাড়তে থাকে।

৭ মার্চ, ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ঢাকায়, রেসকোর্স ময়দানে। সে ভাষণই আতিকুরের মনে প্রবলভাবে রেখাপাত করে। তাঁর ভাষায়,

1971 muktijodda
মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমানের অনুকূলে বঙ্গবন্ধুর পত্র

“ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই ছিল একটা পুকুরঘাট। সেখানে বসে রেডিওতে শুনি ভাষণটি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না…।’ ওই ভাষণই জীবনের গতি পাল্টে দেয়।”

ট্রেনিং শেষে আপনাদের কোথায় পাঠানো হয়?

আতিকুরের উত্তর,

“ছয়-সাত জনের একটা দল করে, একেক দলকে একেক থানায় পাঠানো হয়। শামসুল হক, মতি, আলী আজম ফরিদীসহ আমাদের ছয় জনকে পাঠানো হয় গোসাইরহাট থানায়। প্রথমদিকে অস্ত্রের অভাব ছিল। ছয় জনের জন্য রাইফেল ছিল একটা। দুইটা করে থাকত গ্রেনেড। কমান্ড করতেন আলী আজম ফরিদী। গেরিলা ছিলাম। নির্দেশ ছিল আঘাত করেই সেফ জোনে সরে পড়া। সাধারণ মানুষ আমাদের পাশে না থাকলে এত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পেতাম না। আট নম্বর সেক্টরের অধীনে এভাবেই অপারেশন করি– ভেদেরগঞ্জ থানা, গোসাইরহাট, ডামুরডা, পালং, নড়িয়া প্রভৃতি এলাকায়।”

এক অপারেশনে রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমান। পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি তাঁর বাম কানের লতি ছিঁড়ে মাথার পেছনে বিদ্ধ হয়। এছাড়া আরেকটি গুলি তাঁর গলার ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেদিনের কথা মনে হলে ঠিক থাকতে পারেন না তিনি। আজও মনে ঝড় ওঠে।

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনে? সে ইতিহাস শুনি আতিকুরের জবানিতে।

তাঁর ভাষায়,

“সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। আমরা ছিলাম ভেদেরগঞ্জ থানায়। খবর আসে বেলুচ রেজিমেন্টের কয়েকজন আর্মি পালং থানায় ঢুকেছে। ওরা ফেরার পথেই আমরা আক্রমণ করব, এমন ছিল পরিকল্পনা। আমরা আঙ্গারিয়া ঘাটের পাশে বসে আছি। নৌকা নিয়ে এ পথেই যেতে হবে তাদের। দিন শেষ হয়ে রাত আসে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি। মধ্যরাতে মনে হল ওরা হয়তো আসবে না। সহযোদ্ধারা আমায় রেখে অন্যত্র চলে যায়। আমার চোখ তখনও নদীর দিকে স্থির থাকে।”

“খুব ভোর তখন। সূর্য উঠে-উঠে ভাব। দেখি দুইটা নৌকা যাচ্ছে। আর্মিদের নৌকা মনে হল না। ‘কাদের নৌকা’ বলে ডাক দিতেই ওরা নৌকা থেকে আমার দিকে ফায়ার করে। আমিও প্রতুত্ত্যর দিই। ওরা ঘাটের অন্য পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে রাস্তার দিকে উঠে যায়। আমি ঘাটে থাকা থানার একটা স্পিড বোট দিয়ে ও পাড়ে গিয়ে ওদের পিছু নিই। পাকিস্তানি সেনারা আশ্রয় নেয় কাশিপুর স্কুলে। স্কুলের কাছাকাছি একটা তাল গাছের পাশে আমি পজিশনে যাই। এ সময় অন্য একটা গ্রুপ থেকে কাঞ্চন নামের এক মুক্তিযোদ্ধা আমার সাথে যোগ দেয়। সে ছিল মেডিকেলের ছাত্র। তার কাছে ছিল একটা স্টেনগান।”

“আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের তুমুল গোলাগুলি চলছে। হঠাৎ মনে হল বাম কান দিয়ে রক্ত ঝরছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। গুলিটা তাল গাছের গুঁড়ি ভেঙে বাম কানের লতি ছিঁড়ে মাথার পেছনে বিদ্ধ হয়ে ভেতরে রয়ে যায়। আরেকটি গুলি গলার ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যায় বাম দিক দিয়ে। গলা দিয়ে পিনপিন করে রক্ত বেরুচ্ছিল। পাশ থেকে কাঞ্চন তার গামছা দিয়ে আমার গলা বেঁধে দেয়। আমি শুয়ে তখনও গুলি করে সাপোর্টিং ফায়ার দিই। সে সুযোগে কাঞ্চন স্কুলের পেছনের সুপারি গাছ বেয়ে ছাদে উঠে আসে। সেখান থেকে গুলি করে সেনাদের ওপর।”

1971 muktijodda
অস্ত্র জামাদানের প্রামাণ্য দলিল

“অপারেশন শেষে একটা নৌকায় করে আমাকে নেওয়া হয় বুড়ির হাটে। সেখানে একটা বাড়ি থেকে কাঁথা সেলাইয়ের সুই এনে তা দিয়েই আমার কানে সেলাই করে দেয় কাঞ্চন। মাথার ভেতরের গুলিটিও বের করে আনে ছুরি দিয়ে। সেখান থেকে প্রথমে ডামুড্যায় এবং পরে চিকিৎসার জন্য আমাকে পাঠানো হয় ভারতের বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে সপ্তাহ খানিক পরেই আবার ফিরে আসি রণাঙ্গনে।”

দেশ যখন স্বাধীন হয় আতিকুর তখন ছিল নড়িয়াতে। অস্ত্র জমা দেন মাদারীপুরে। অতঃপর লেখাপড়া শেষ করে তিনি ব্যবসার মাধ্যমে জীবন চালান।

যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?

মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর বলেন,

“দেশ তো পেয়েছি। কিন্তু সোনার বাংলা পাই নাই। ধনী-গরিবের বৈষম্য কমেনি এখনও। যাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি স্বাধীন দেশে সেই বঙ্গবন্ধুকেই বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। স্বাধীনতা লাভের পর সকল মুক্তিযোদ্ধাকে দেশগড়ার কাজে লাগাতে পারলে দেশটা অন্যরকম হত।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। তিনি এসে দালাল আইন বাতিল করেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ ও মন্ত্রী বানান মাওলানা মান্নানকে। পরবর্তীতে তারা দলের হাত ধরেই মন্ত্রী হন যুদ্ধাপরাধী ও বদর নেতা মতিউর রহমান ও আলী আহসান মুজাহিদ। স্বাধীন দেশের পতাকা যখন রাজাকারের গাড়িতে তখন মরে যেতে ইচ্ছে করত মুক্তিযোদ্ধা আতিকুরের। বললেন,

“মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় তখন দিতাম না। নীরবে কেঁদেছি অনেক। কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারি নাই, ভাই। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলে রাজাকাররা তখন মুখ টিপে হাসত। এটা ছিল আমাদের পরাজয়। ইতিহাস কলঙ্কিত করার নায়ক ছিলেন জিয়া। এই দায় তিনি বা তার দল কখনও এড়াতে পারবে না।”

স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কেন বাড়ে?

মুচকি হেসে তিনি বলেন,

1971 muktijodda
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমান

“স্বাধীনের পরপরই এ তালিকা চূড়ান্ত করা যেত। আমাদের গ্রামে অস্ত্র জমা দিয়েছে ৬৪ জন। এখন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তোলে সাতশর মতো। এর জন্য আমরা সবাই কমবেশি দায়ী। দুজন মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত না করলে তো মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায় না। এটা করেছে কিছু অর্থলোভী থানা কমান্ডার। কষ্ট করলাম আমরা, এখন মজা মারতাছে ভুয়ারা। মুক্তিযুদ্ধ করে নাই, ওরাও এখন মুক্তিযুদ্ধের চাপাবাজি করে। এই কষ্টের কথা বলে লাভ কী বলেন?”

দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন আতিকুর। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে চিঠি লিখেও আর্থিক সাহায্য করেছেন। অথচ তিনি যুদ্ধাহত কিনা সে যাচাইয়ের সাক্ষাৎকার এখনও তাঁকে দিতে হয়। সে কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন এই বীর যোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধা আতিকুরের বড় মেয়ে নাহিদ আক্তার নিশু। শিক্ষকতা করছেন একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। কথা হয় তার সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা পিতা সম্পর্কে তিনি অকপটে বললেন,

“বাবা মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন, আমাদের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় গৌরবের। অনেক কষ্ট করে বাবা আমাদের লেখাপড়া করিয়েছেন। নিজে টিউশনিও করেছি। কিন্তু তবু আমাদের আফসোস নেই। আমরাও বাবার আদর্শ বুকে নিয়ে সততা, পরিশ্রম আর নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের জন্য কাজ করব।”

তিনি আরও বলেন,

“সরকারের উচিত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া। সেটি কিন্তু এখনও তেমন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস না জানলে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তৈরি হবে না।”

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতির কথা জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই সূর্যসন্তান বলেন,

“আমার দেশের ছেলেমেয়েরা যখন সফলতার সাথে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে ধরে, জাতীয় দিবসে যখন সবখানে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে, তখন বুক ভরে যায়।”

খারাপ লাগে কখন?

“এদেশে বসবাস করে, সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যখন রাজাকার সমর্থকরা একাত্তরে গণহত্যা হয়নি বলে আওয়াজ তুলে, যখন কেউ প্রকাশ্যে দেশটা পাকিস্তান থাকলেই ভালো হত বলে আফসোস করে, তখন খুব কষ্ট লাগে। এদের তো এদেশে থাকার কোনো অধিকার নাই ভাই।”

দেশে শত সমস্যা আর বাধা থাকলেও তা সরিয়ে দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজম্ম, এমনটাই মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকুর রহমান। চোখে মুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন,

“তোমরা তোমার মাকে ভুলে যেও না। সে দরিদ্র হলেও তাঁর পাশে থেক। দেশটাও মায়ের মতো। তার প্রতি দায়িত্বটাও তুমি পালন কর। তা না হলে তোমার সকল অর্জনই বৃথা হয়ে যাবে।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১১ ডিসেম্বর ২০১৭

বই সংবাদ:

rokto makha juddo kotha
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ

এই লেখাটিসহ আরও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসীক কাহিনি নিয়ে সময় প্রকাশন ‘১৯৭১: রক্তমাখা যুদ্ধকথা নামক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি আকরগ্রন্থ প্রকাশ করছে। ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় গ্রন্থটি পাওয়া যাবে সময় প্রকাশনের স্টলে।

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button