মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানই ছিল মূল শক্তি

দাদা, বাড়ি আমার ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরে, বংশীহারি থানায়। নানাবাড়ি কুসুমণ্ডি থানাতে। পার্টিশনের আগেই বাবা চলে আসেন এ পাশে, দিনাজপুরের বিরলে। তখন তো বর্ডারই চিনা যাইত না। কোনটা পাকিস্তান কোনটা হিন্দুস্থান, বুঝতাম না। এহনও দুইটাই মনে হয় নিজের দেশ। এ পাশে আমরা আর ওই পাশে চাচা-মামারা। শুধু কাঁটাতারের বেড়াই আমগো সম্পর্কের মাঝে বিভেদ টানছে। আমার বয়স তহন দশ। বড় ভাই মঈনুদ্দিনসহ মাছ ধরতে গেছি গ্রামের পাশের খালে। তহন অনেক টাকি মিলত। টাকি থাকে গর্তের মইধ্যে।

বড় ভাই বলেন, “মমতাজ, গর্তগুলা দেখ তো, ভাই।”

আমি গর্তের মধ্যে হাত ঢুকাই আর টাকি মাছ বাইর কইরা আনি। অনেকগুলাই ধরছি। এর মইধ্যে একটা গর্তে হাত ঢুকায়া টাকি মাছও ধরছি। টানছি কিন্তু টাকি মাছ আসে না।

বলছি, “ভাইয়া, টাকি মাছ তো আসে না।”

ভাই বলেন, “টান জোরে টান।”

বলি, “আমি তো পিছলাইয়া যাইতাছি। তুমি আমার মাঝাটা একটু ধরো তো।”

ভাই মাঝা ধরতেই দেই একটা টান। বের হইয়া আসে বড় একটা পানি সাপ। তার শরীরটা আমার হাতটায় পেঁচানো। ভাই বললে ছাইড়া দিস না তুই, শক্ত কইরা ধইরা রাখ। আমিও তাই করি। ওই অবস্থায় বিরল বাজারে আইসা লাফাইতাছি। লোকজনও জইমা যায়। খবর পাইয়া বাবায় আইসা বলে, “বাবা, ছাইড়া দে সাপটারে।”

আমি ছাইড়া দিয়া দেহি সাপটা মইরা গেছে। বাবা বলেন, “সাববাশ! তুই তো দেহি আমার নাম রাখবি।”

ওই দিন থাইকাই মনে হইছে: “আমি অনেক সাহসী।”

দিনগুলা ভালোই যাইতাছিল। বন্ধু কাশেম, বিমল, সাধনের লগে ডাংগুলি, হাডুডু আর বুরচি খেলতাম। পূজা-পার্বণে আমাগো ডাক পড়ত। মুসলমান হয়েও আমরা পূজায় আনন্দ করতাম খুব। নানা কাজে হিন্দুগো সাহায্যও করছি। ধর্ম নিয়া বিরলে সব সময় ঐক্য ছিল। স্কুলের শিক্ষকরা ছিল পূজনীয়। যেমন শাসন তেমন স্নেহ করতেন তারা। বদরুল আজাদ তুফান স্যারের কথা অনেক মনে পড়ে। তুফানের মতোই ইংরেজি পড়াইতেন উনি।

শিক্ষকদের আমরা মান্য করতাম, ভয়ও পাইতাম খুব। যদি শুনছি গ্রামের ওইদিকে স্যার আছে, সারাদিনেও ওই এলাকায় পা রাখতাম না। মুরুব্বি ডাকলে তো শরীর কাঁপত। এহন জবানাডাই তো বদলাইয়া গেছে। মুরুব্বিগো সামনেই সিগারেট খায় ছেলেরা। সামনেই পা তুইলা বইসা থাকে। বেয়াদবিটা এহন স্টাইল হইয়া গেছে। নিচু স্তরের লোকেরা টাকাওয়ালা হইছে। এহন যার যত টাকা সে তত সম্মানী লোক। টাকাই বদলাইয়া দিছে আদব-কায়দা।

শৈশব আর কৈশোরের নানা স্মৃতিচারণে এভাবেই কথা বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।

শামসুদ্দিন আহমেদ ও নুর নাহার বেগমের তৃতীয় সন্তান মমতাজ। বাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বিরল বাজার গ্রামে। বাবা চাকুরি করতেন। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি ছিলেন। মমতাজের লেখাপড়া শুরু বিরল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন বিরল পাইলট হাই স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন ওই স্কুলেরই এসএসসি পরিক্ষার্থী।

দেশ নিয়ে তেমন চিন্তা ছিল না মমতাজের। লোকমুখে শুনতেন বঙ্গবন্ধুর কথা। বড় ভাই মউনুদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেনাবাহিনীতে। তাঁর মুখে শুনেছেন বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়গুলো। এক সময় বড় ভাই বদলি হয়ে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। তাঁর জন্য খুব মন কাঁদত মমতাজের।

দিনাজপুরে বিহারিদের প্রতাপ ছিল বেশি। বিহারি আর মুসলিম লীগার ছাড়া সবাই ছিল মুজিবের পক্ষে। বিরলের ভারাডাংগি ও নানাবাড়িতে মুসলিম লীগের লোক ছিল বেশি। মুসলীম লীগের বড় নেতা ছিল নুরী মাওলানা। দিনাজপুরে তখন আওয়ামী লীগ করতেন নবাব সাহেব, সটি সাহেব, আবদুর রউফ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রমুখ। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়। সবার মনে একই চিন্তা– শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় আনতে হবে। ভোটের সময় মমতাজরা নৌকার ছবি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। কণ্ঠ আকাশে তুলে স্লোগান দিতেন, “তোমার আমার ঠিকানা– পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।”

সত্তরের নির্বাচনে জয় লাভের পরও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। পঁচিশ মার্চ ঢাকায় আর্মি নামে। এ খবর ছড়িয়ে পরে সবখানে। কিন্তু দিনাজপুরে ঘটে অন্য ঘটনা। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল দিনাজপুর শহরের দক্ষিণে, কুটিবাড়িতে। সেখানে বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে পাঠান পাঞ্জাবিরা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে।

চৈত্র মাসের দশ তারিখের কথা। বিরলের পাশেই বড় একটি মেলা বসে। ‘বিরল নয়া মেলা’ নামে সেটি পরিচিত। ডানপিটে মমতাজ মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এ সময় কুটিবাড়ির হত্যাযজ্ঞের খবর আসে। মমতাজ বড় ভাইকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়। সেনাবাহিনীতে চাকুরিরত তাঁর বড় ভাইকেও নিশ্চয়ই হত্যা করেছে পাঞ্জাবিরা। ভাইয়ের জন্যই প্রথম অস্ত্র তুলে নেন মমতাজ।

সে ইতিহাস জানি তাঁর জবানিতে।

মেলায় দেহি তুফান স্যাররে। তিনি বললেন, “তুমি মেলায় আনন্দ করতেছ আর ওইদিকে তোমার ভাইদের পাকিস্তানিরা গুলি কইরা মারতেছে, কুটিবাড়িতেও চলতাছে হত্যা।”

শুইনাই শরীরটা জাড়া দিয়া উঠল। মেলা থাইকা দৌড়ে বাজারে আসি। বিরল থানার অস্ত্র তহন চলে আসে সাধারণের হাতে। স্কুলে সিক্স থাইকা টেন পর্যন্ত সপ্তাহে একদিন সিভিল ডিফেন্স ক্লাস হইত। রাইফেল লোড-আনলোড তহনই শিখে নিছিলাম। বড় ভাইরা তাই একটা রাইফেল দেয় আমারেও। গফুর ভাই, মালেক, মেহেদুল, নুরুসহ শত শত লোক জড় হয় বাজারে। ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের বাঁচাতে তহন বহলা হয়ে চলে যাই কুটিবাড়িতে।

[ভিডিও:হত হওয়ার বর্ণনা করছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ:

কুটিবাড়িতে কী দেখলেন?

প্রথমে সার্কিড হাউজে দেখলাম রক্তে রক্তাক্ত। মন আরও খারাপ হইল। কুটিবাড়ি তহন বাঙালিদের কব্জায়। কিন্তু ওগো ওয়ারল্যাস অপারেটর তহনও সরে নাই। সে কুটিবাড়ির দোতলায় বইসা ওয়ারল্যাসে টাইম-টু-টাইম খবর পাঠাইতেছে। ইপিআরের জর্জ ভাই এটা টের পায়। আমি আর সে দোতলার দিকে আগাই। সিঁড়ি দিয়া উঠার সময়ই সে গ্রেনেড চার্জ করে। আমার তো অভিজ্ঞতা নাই। ঢিলের মতো মনে হইল। জর্জ ভাই কইলো, “শুইয়া পড়।”

আমি শুয়ে পড়ার আগেই একটা স্প্লিন্টারিআইসা লাগে ডান হাতে। এহনও ভিতরে রইয়া গেছে। পরে জর্জ ভাই একটা গ্রেনেড খুইলা দেন। বাম হাতে আমি ওইটা দোতলার বেলকনিতে থ্রো কইরা চইলা আসি। সাতদিন পরই পাকিস্তানি সেনারা দিনাজপুর দখলে নিতে শুরু করলে আমরা ফিরা আসি বিরলে।

পাকিস্তানি সেনারা যখন বিরল উপজেলায় ঢুকে মমতাজ তখনও ছিলেন সেখানে। বাজারের পাশে লুকিয়ে থেকে দূর থেকে দেখেন তাদের হত্যাযজ্ঞ। সেনাদের সামনেই থাকত বিহারিদের একটি দল। তারা স্লোগান দিয়ে এগোয়, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘নিউ বিহার জিন্দাবাদ’। পথের ধারের গ্রামগুলো তারা জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। থানার সামনে এসে ওরা দুজন নিরীহ বাঙালিকে গুলি করে মারে। জারপুকুরের বেশিরভাগ লোক তখন ছিল পাকিস্তানিদের দালাল। ওরা হিন্দু বাড়িগুলোতে লুটপাট করতে থাকে। ওইদিনই ডুংডুংগি সীমান্ত পাড় হয়ে মমতাজ চলে যান মামার বাড়িতে, ভারতের কুসুমণ্ডি থানায়।

ট্রেনিং নিলেন কোথায়?

মমতাজের উত্তর: ‘আমার ভাগিনা মোতাহারুল ইসলাম, মামাতো ভাই মজিবরসহ প্রথমে চলে যাই ডালিমগাঁও ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখানে লেফট-রাইট ও বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রশিক্ষণ চলে কিছু দিন। জুনের প্রথম দিকে আমাদের পাঠানো হয় ভারতের শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। দ্বিতীয় ব্যাচে আমরা সেখানে ট্রেনিং নিই আটাশ দিন। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং-১৭৯৯।”

একটা সেনাবাহিনী ও গেরিলাকে যা যা শিক্ষা দিতে হয়, ভারত তাদের সে শিক্ষা দিয়েছিল। এলএমজি, এসএলআর, স্টেনগান শিখাতেন এক শিক্ষক। টুইঞ্চ মর্ডার, গ্রেনেড এক শিক্ষক আর এক্সপ্লোসিভ, ডেমুনেশনের ক্লাস করাতের আরেকজন। প্রশিক্ষক কেডি মজুমদার ও এস কে সিনহার কথা খুব মনে পড়ে মমতাজের। ক্যাম্পে প্রতিদিন জাতীয় সংগীত গাওয়া হত। কষ্ট ছিল কিন্তু তবুও আনন্দে কাটত দিন। মমতাজ বলেন, “হাসতাম, কানতাম, বাংলায় ওস্তাদদের ভেঙ্গাইতাম। বিনোদন ছিল এউডাই। ভাবনা ছিল একটা খালি, দেশটারে শত্রুমুক্ত করতে হবে।”

ট্রেনিং শেষে মমতাজদের অস্ত্র দেওয়া হয় সাত নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুর থেকে। অতঃপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মালন অপারেশন ক্যাম্পে। মমতাজরা ছিলেন গেরিলা। আক্রমণ করেই সরে পড়তেন। নির্দেশ ছিল, ‘ক্ষিপ্রগতিতে আক্রমণ কর, বিদুৎগতিতে পলায়ন কর।’ পাকিস্তান সেনাদের মনোবল ভেঙে দেওয়াটাই ছিল গেরিলাদের কাজ। মমতাজরা এভাবেই অপারেশন করেন সাত নম্বর সেক্টরের বীরগঞ্জ, বহবলদীঘি, বিরল, হিলি ও নওগাঁয় প্রভৃৃতি এলাকায়।

আগস্টের শেষ দিকের ঘটনা। নওগাঁয় রেইকি করতে গিয়ে সেনাদের হাতে ধরা পড়েন মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ। খুব কাছ থেকে তাঁর মাথায় গুলি করে তারা। এতেই ক্ষান্ত হয় না, রাইফেলের বাঁট দিয়ে তাঁর বুকের বাম পাঁজরের একটি হাড় ভেঙে দেয়। মাথার আঘাতে এখনও মাঝেমধ্যেই সেন্স হারিয়ে ফেলেন তিনি। ব্যথা হয় বুকের পাঁজরেও। বয়সের ভারে সব স্মৃতি হারিয়ে গেলেও রক্তাক্ত ওই দিন আজও জীবন্ত হয়ে আছে মমতাজের মনে। আবেগজড়ানো কণ্ঠে সে ঘটনা তুলে ধরেন এই বীর যোদ্ধা।

সাপ্তাহিক রিপোর্ট জামা দিতে তিনি যান হেডকোয়ার্টারে, তরঙ্গপুরে। সঙ্গে ছিলেন মামাতো ভাই মজিবর। ওদের বাড়ি নওগাঁয়। সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান ও এক ডাক্তার মেজর নওগাঁর ম্যাপ দেখছিলেন। আগ্রহ নিয়ে স্যারদের কাছে গেলাম। মামার বাড়ি নওগাঁয় শুনতেই তারা সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বললেন, “নওগাঁ ব্রিজ এলাকায় যাবা বেড়াতে। চোখ আছে দেখবা। মনের মধ্যে নোট করবা। কিছু করতে হবে না। পাকিস্তানি সেনাদের পোশাকে মার্কাটা কী, কী অস্ত্র, কোথায় কীভাবে ব্যবহার করতেছে দেখবা শুধু। পরে এসে রির্পোট করবা।”

পত্মীতলা হয়ে রাঙ্গামাটি ফারসিপাড়া বর্ডার দিয়ে ঢুকেন মমতাজরা। কামারপাড়া অপারেশন ক্যাম্প থেকে যুক্ত হন আরও তিন গেরিলা। ওদের কাছে ছিল পাঁচটি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন। ফারসিপাড়া মেইন রোড দিয়ে ৩-৪ ঘণ্টা পরপর পাকিস্তানিদের জিপ আসা-যাওয়া করত। সে জিপ উড়িয়ে দিতে হবে। এরপরই ওরা নওগাঁয় যাবেন। মমতাজের ভাষায় শুনি বাকিটুকু:

ফজরের আজান দিচ্ছে তখন। আমরা মেইন রোডে মাইন পুইতা রাখি। দুই পাশে দুইটা কইরা। মইধ্যে একটা। পাকিস্তানিদের গাড়ি আসলেই উইড়া যাবে। কিন্তু ঘটল উল্টা ঘটনা। এক লোক গরুর গাড়ি নিয়ে গ্রামের দিকের রাস্তা দিয়ে ওই রাস্তায় উঠে। মধ্যের মাইনে গাড়ির চাকা পড়তেই ধুম কইরা উইড়া যায় গাড়িটা। আমরা তখন নালার পাশে লুকাই। ঘণ্টা খানেক পরেই পাকিস্তানি সেনাদের একটা জিপ আসে। কাছাকাছি আসতেই চারটা মাইনে একসঙ্গে উইড়া যায় তারাও।

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ওই তিন গেরিলা তখন ক্যাম্পে ফিরে যায়। নওগাঁ ব্রিজের চারপাশে সব ডাটা নিয়ে আমরা চলে আসি মামাবাড়ি, মহাদেবপুরে। তিনদিন থাকি সেখানে। ফিরতেছি একাই। হঠাৎ মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আসে। ফারসিপাড়া রাস্তাটার কী অবস্থা দেইখা যাই, এই মনে কইরা সেইখানে যাইয়া বিপদে পড়ি।

পাঁচজন পাকিস্তানি সেনার মুখোমুখি পড়ে যাই। ওরা গ্রামের ভেতর থেকে আসছিল। সবগুলার হাতে চাইনিজ রাইফেল। কী করমু বুঝতে পারি না। দৌড়াতেও পারছি না। ছেলে বয়সী তিন সেনা ছিল পাঞ্জাবি। বাকি দুজন বেলুচি।

পাঞ্জাবি সেনারা বলে, “নাম কিয়া?”

নাম বললাম। “মোকাম কী ধার, মোকাম?”

চুপ থাকি। আবার বলে, “কাহা রেহ তা হ্যায়?”

হাত দিয়ে দূরের একটা গ্রাম দেখাই। ক্রলিংয়ের দাগ রয়েছে কিনা ওরা হাত-পায়ের জয়েন্টে হাত দিয়ে চেক করল।

এরপর বলল: “মুক্তি কী ধার হ্যায়?”

বলি: “হাম মুক্তি কো নেহি পেচান্তে।”

ওরা বিশ্বাস করে না। ওই পাঞ্জাবি তেড়ে এসে বলে: “এ মুক্তি হ্যায়। হাম গুলি করে গা।”

পাঞ্জাবি দুজনই গুলি করতে চায়। কিন্তু বেলুচিরা গুলি করতে দিবে না। ওদের মধ্যে লেগে যায় ঝগড়া। শেষে আমাকে এক বেলুচি ডেকে নেয় সামনে। যেতে যেতে আস্তে করে সে বলে: “মুক্তি হো আর চুক্তি হো, আতা হ্যায় তো পাকড়া কিউ যাতা হ্যায়। আপনা ওকান্তাকে লেহে লাড়তা হ্যায় তো কিউ পাকড়া যাতা হ্যা।”

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ফিসফিস করে সে বলে, “তোমারে গুলি করবো। গুলি লাগবে। রক্তও ঝরবে। কিন্তু তুমি মরবা না।”

তখনই বুঝেছি সে আসলে ইনজুরি করবে কিন্তু আমাকে প্রাণে মারবে না। দূরে বসিয়েই মাথা নিচু করে বিশেষ কৌশলে মাথায় গুলি করে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দেয় সে। গুলিটি মাথার বাম সাইড দিয়ে শুধু চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে যায়। রক্ত ঝরছিল তখন। কিন্তু পাঞ্জাবি সেনারা তাতেও সন্তুষ্ট হয় না। একজন দৌড়ে এসে ‘মাদারচোদ’ বলে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার বুকের বাম পাশের পাঁজরে হিট করে। ফলে পাঁজরের একটা হাড় ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে। আমি উপুড় হয়ে পড়ে রই। এরপর আর জ্ঞান ছিল না।

বিকালে হালকা বৃষ্টির পানির স্পর্শে জ্ঞান আসে। তখন বহু কষ্টে ফিরি কামারপাড়া ক্যাম্পে। রক্তাক্ত অবস্থা তখন। অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে পাঠানো হয় প্রথমে তরঙ্গপুরে এবং পরে ভারতের রায়গঞ্জ হাসাপাতালে। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসি। কিন্তু কষ্টগুলো এখনও যায় নাই। হাতটায় ঝিম ঝিম করে। মাথাটায় এক-দেড় সেকেন্ড সেন্স থাকে না। পাঁজরে ব্যথা হয় প্রায় সবসময়।

যুদ্ধবিধস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়তে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু তখন নিজের লোকদের সহযোগিতা তেমন পাননি তিনি। তখন কেউ কারও কমান্ড শুনছিল না। রিলিফ ভর্তি গোডাউন। কিন্তু তা বিতরণ করেনি চেয়ারম্যানরা। ফলে অনেক চেয়ারম্যানকে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এসব ঘটনার দায় এসে পড়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপর। বঙ্গবন্ধু জোর করে কাউকে কিছু বলতেন না। তাঁর ছিল দয়ার শরীর। সেই সুযোগটাই নিয়েছিল অনেকেই। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এমনটাই মত মুক্তিযোদ্ধা মমতাজের।

মমতাজের স্বপ্ন ছিল, দেশ স্বাধীন হবে, সবাই সুন্দরভাবে চলবে। কিন্তু স্বাধীন দেশে তেমনটা হল না। স্বাধীনতাবিরোধীরাই ধীরে ধীরে ক্ষমতাধর হতে থাকে। তখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই চোর-ডাকাত বলে মুক্তিযোদ্ধাদের জেলে দেওয়া হত। স্বাধীনতাবিরোধী নুরী মৌলভীর লোকেরাও তেমনিভাবে জেলে দেন মুক্তিযোদ্ধা মমতাজকে। ফলে জীবনের হিসাব তিনি মিলাতে পারেন না। স্বপ্ন ভুলে ১৯৭২ সালে জেল থেকে বেরিয়েই চাকুরি নিয়ে তিনি চলে যান সৌদিতে। কয়েক বছর পর ফিরে এসে ঠিকাদারদের অধীনেই কাজ করে পরিবার চালাতেন। বর্তমানে এ যোদ্ধার পরিবার চলছে সরকারি ভাতা আর রেশনের ওপর।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে এ বীর যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:

“মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৃত্যু হয়েছিল পনের আগস্ট। তাঁর মতো নেতা দেশে বারবার জন্মায় না। এর চেয়ে মর্মান্তিক হত্যা পৃথিবীর কোথাও হয়নি। হত্যার কারণ তো বলতে পারমু না। তবে এটা বুঝি স্বাধীন দেশে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিল জাসদ। জাসদ যদি সৃষ্টি না হইত তাইলে হয়তো বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ তৈরি হইত না। যারা তাঁরে হত্যা করছে তারা তো মানুষ না।”

স্বাধীন দেশে রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি তিনি ইতিহাসের লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে অবহিত করে বলেন:

“জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী বানিয়ে পুরো জাতি আর ইতিহাসরে কলঙ্কিত করেছেন। এখনও তার দল রাজাকারদের পাশে রাখছে। ক্ষমতার লোভ আর স্বার্থ জিয়াকে অন্ধ কইরা দিছিল। ফলে রাজাকারদের সাথে হাত মিলাইতেও তার লজ্জা হয় নাই।”

কিন্তু তিনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?

মুক্তিযোদ্ধা মমতাজের উত্তর:

“দেখেন, সাত নম্বর সেক্টরের ছয় নম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন এস শাহরিয়ার সাহেবও তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অথচ তিনিই বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত খুনি। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বদলাই নাই, ভাই। আদর্শ বদলাইলে তো সে আর মুক্তিযোদ্ধা থাকে না। সেনাবাহিনীর বড় বড় মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই স্বার্থের কারণে আদর্শ বদলাইছে বারবার।”

জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে এই সূর্যসন্তান বলেন:

“জামায়াত-শিবির থাকলে জঙ্গিবাদ থাকবেই। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের পরপরই কেন শুরু হইল জঙ্গি সমস্যা? জঙ্গিবাদ শুধু প্রশাসন দিয়া নির্মূল হইব না। সবাইকে সচেতন হইতে হবে। ধনী আর প্রভাবশালী ঘরের ছেলেমেয়েরা কেন জঙ্গিতে যুক্ত হচ্ছে এটাও বাইর করতে হবে।”

দেশ কেমন?

“বিরাট বড় প্রশ্ন। দেশ খুব ভালো চলছে। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরাই এখন সমস্যা। বাঙালি যে মানবতার পক্ষে থাকে এটা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট। আমি মনে করি মানুষের পাশে যে দাঁড়ায় আল্লাহও তার পাশে থাকে। তাই বিশ্বাস করি শেখ হাসিনা সরকারেরও মঙ্গল হবে।”

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো ও খারাপ লাগার অনুভূতি জানালেন মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ। বললেন:

“দেশের উন্নতি দেখলে ভালো লাগে। কিন্তু প্রতিহিংসা আর দলের লোকদের দুর্নীতি দেখলে খুব খারাপ লাগে। তৃণমুলে যাচাই-বাছাই কইরা সঠিক লোককে দায়িত্ব দিতে হইব। সরকারের কাজগুলোরও প্রচার চালাতে হইব। দলে নেত্রীকে আরও কঠোর হইতে হবে।”

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে না বলে মনে করেন স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়া এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর পরামর্শ:

“সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে জানলেই দেশের ইতিহাস জানা যাবে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা চোখের সামনে ‘জয় বাংলা’ বলেই গুলি খাইয়া মইরা গেছে। একাত্তরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানই ছিল মূল শক্তি । তাই এই ‘জয় বাংলা’কেও প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”

পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি বুকভরা আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ উদ্দিন আহমেদের। দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:

“তোমরা যদি সত্যিকারের মানুষ হইতে চাও, তবে দেশের ইতিহাস পড়। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাস জান। তুমি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ যে কোনো ধর্মবিশ্বাসী হইতে পার, কিন্তু তারও আগে তুমি বাঙালি। তাই সর্বপ্রথম তোমাদের বাঙালি হইতে হবে।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৬ নভেম্বর ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button