আদিবাসী

সাঁওতাল বিয়ের আদি রীতি

তখন শীতকাল। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। ঘন কুয়াশা ঢেকে রেখেছে দিনাজপুর শহরের চারপাশ। আমাদের গন্তব্য একবারপুর। হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের রাস্তাটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে ওইদিকে। প্রত্যন্ত এ গ্রামেই পাড়া করে বাস করছে গোটা সাতেক সাঁওতাল পরিবার। আশপাশের গ্রামেও রয়েছে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসীরা। যারা ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছেন খ্রিষ্টান ধর্ম। ফলে বদলে গেছে তাদের আচার ও রীতিগুলো। কিন্তু একবারপুরের সাঁওতাল পরিবার এখনো আগলে রেখেছেন পূর্ব পুরুষদের আদি ধর্মবিশ্বাসকে।

এ আদিবাসী গ্রামটিতে বিয়ের অনুষ্ঠান আজ। ফিলিপ টুডু ও রান্দন হাজদার মেয়ের বিয়ে। কনের নাম ফুলমনি টুডু। বিয়ে হবে বীরগঞ্জ দক্ষিণ সুজালপুর গ্রামের সকাল সরেনের সঙ্গে। সাঁওতালদের সনাতন বিয়ের খবর পেয়েই আমরা পা রাখি ফিলিপ টুডুর বাড়িতে।
সাঁওতাল বিয়ের আদি আচার চলে সকাল হতে রাত অবধি। খুব কাছ থেকে দেখি বিয়ের আদি রেওয়াজগুলো। সময় সময় ছবি তোলা আর বয়োবৃদ্ধ সাঁওতালদের মুখে শুনি বিয়ের আদি রীতি ও তা নিয়ে নানা বিশ্বাসের মিথগুলো।
বিয়েবাড়ি দূর থেকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে সাঁওতালরা বাড়ির ভেতর উঁচু বাঁশ গেড়ে বাঁশের মাথায় খের দিয়ে তৈরি করা বানরাকৃতি ঝুলিয়ে রাখে। ওটা দেখেই গ্রামবাসী বিয়ের সংবাদটি জেনে যায়। একইভাবে বিয়েবাড়ির সীমার শুরুতেও বেঁধে দেয়া হয় বিশেষ গাছের লতা। তা দেখে সবার মতো আমরাও খুঁজে নিই বিয়ে বাড়িটিকে।
সাঁওতালরা বিয়েকে বলে বাপলা। এ আদিবাসী সমাজে মোট ১২টি গোত্র রয়েছে, যেমন- হাঁসদা, মুরমু, সরেন, হেমব্রম, টুডু, বাস্কে, কিস্কু, বেদেয়া, মান্ডি, বেসড়া, চঁড়ে, পাঁউরিয়া। এদের একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। এছাড়া বেসড়ার সঙ্গে টুডু এবং মান্ডিদের সঙ্গে কিস্কুদের বিয়ে হয় না।
সাঁওতাল সমাজে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয় মেয়ের বাড়িতে। এ সময় শালপাতার বাটি ব্যবহার করা হয়। বাটিতে রাখা হয় কয়েকটি ধাতুর মুদ্রা। বিয়ের আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বাটি জগমাঁঝির কাছেই থাকে। এদের সমাজে কনে পণ দেয়ার রীতি চালু আছে। তবে সেটি খুবই সামান্য। তবে বিয়েতে কনের মা, মাসি ও পিসিদের জন্য পাঁচ থেকে সাতটি শাড়ি প্রদান করতে হয়।
সাঁওতাল বিয়ে সাধারণত তিন প্রকারের। আসলি বা দুয়ার ইতুত, সিঁদুর বাপলা, রাজাবাজি এবং হুরকাটারা বা ইতুত। এছাড়া নিরবোলক, টুংকি, দিলিপ এবং সেতা বাপলা ইত্যাদি বিয়েরও প্রচলন রয়েছে। তবে বর্তমানে এ বিয়েগুলো খুব কমই দেখা যায়। একসময় রাক্ষস বিয়ের প্রচলন থাকলেও এখন তা একেবারেই নেই। আসলি বিয়ে সাধারণত সম্ভ্রান্ত সাঁওতাল পরিবার ও শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। রাজারাজি বিয়েই সাঁওতাল সমাজে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তবে এদের বাল্যবিয়ে নেই বললেই চলে।
রাজারাজি বিয়ের নিয়মানুসারে সাঁওতালরা হাটবাজার বা মেলার দিনে মেয়ে-ছেলে উভয়েই সেখানে যায়। উদ্দেশ্য অবিবাহিত সেখান থেকে তাদের নিজ নিজ প্রিয়জনকে খুঁজে নেয়া। সাঁওতাল মেয়েরা যখন হাটে বা মেলায় আসে, তখন তাদের সঙ্গে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিও থাকেন। সাঁওতালি ভাষায় তাকে জগমাঁঝি বলে। যদি কোনো সাঁওতাল মেয়ে মেলায় এসে কোনো যুবককে পছন্দ করে ফেলে এবং তাকে জীবনসাথী করতে চায়, তবে সেটি সে অকপটে জগমাঁঝিকে বলে। তিনি তখন ওই যুবকটির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে এবং তার কাছে সবকিছু খুলে বলেন। মেয়েটির নানা গুণাগুণও তার কাছে তুলে ধরা হয়। এতে যুবকটি সায় দিলে তার অভিভাবক ও মেয়ের অভিভাবককে এটি জানানো হয়। অভিভাবকদের কোনো আপত্তি না থাকলে নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের প্রধানদের ডেকে বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত করা হয়।
ওইদিন বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে মুড়ি কিংবা মুড়ির মোয়া উপহার দিয়ে থাকে। এছাড়া ওই দিনই বরপক্ষ কন্যাপক্ষকে বিয়ের পণ হিসেবে দিতে হয় ছয় টাকা থেকে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ টাকা। অতঃপর দিনক্ষণ চিন্তা করে পরের কোনো নির্দিষ্ট দিনে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। তা ঠিক হলেই সকলের সামনে একটি দড়ি বা সুতো এনে যত দিন পর বিয়ে হবে তাতে ততটা গিঁট দেয়া হয়। অতঃপর প্রত্যেক দিন একটা করে গিট খুলতে খুলতে যখন নির্দিষ্ট দিনটি আসে। তখন বরের অভিভাবকরা তাকে হলুদ রঙের কাপড় পরার আদেশ দেয় এবং বাড়িতে তখন থেকেই বিয়ের বাজনা বাজতে থাকে।
সাঁওতাল বিয়ের দিন বরের সঙ্গে তার মা-খালা কিংবা ফুপুও যেতে পারে। বরপক্ষ একটি ঝুড়িতে কাপড়চোপড় ও বিয়ের অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে ঢাকা-ঢোল-কাড়া-নাকাড়ার ধ্বনি দিয়ে সদলবলে কনের বাড়িতে যায়। কনের বাড়িতেই বিয়ে ও কনের বিদায় পর্ব সম্পন্ন হয়। অতঃপর বরপক্ষ মহাধুমধামের সঙ্গে কনেকে নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে। এভাবে সাঁওতালদের রাজারাজি  বিয়ে শেষ হয়।
আবার এ আদিবাসী সমাজে কোনো যুবক যদি কোনো যুবতীর প্রেমে মজে যায়, অথচ যুবতী তাকে মোটেই পছন্দ করে না, তবে সে ক্ষেত্রে যুবক তাকে পাওয়ার জন্য জবরদস্তির আশ্রয় নেয়। তখন যুবকটি আগে থেকেই হাটে বা মেলায় যায় এবং যুবতীটির খোঁজ করতে থাকে। অতঃপর যুবতীর দেখা পেলে সুযোগ বুঝে সে তার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস, অবিবাহিত মেয়ের কপালে সিঁদুর দিলেই তাকে আর অন্যত্র পাত্রস্থ করা যায় না। মেয়েটি তখন অকপটে ব্যাপারটি তার পিতামাতা ও মুরুব্বিদের কাছে খুলে বলে। তারা তখন পরবর্তী হাটের দিন একটি ভাঙা শাখা নিয়ে হাটে গিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতঃপর সকলের সহযোগিতায় মেয়ের বাবা ওই যুবককে পঞ্চায়েতের নিকট হাজির করায় এবং তার বিচার হয়। বিচারে যুবককে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং তা আদায় হয়ে গেলেই তার কাছে মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়। যুবকটি যদি জরিমানা দিতে অস্বীকার করে, তবে সেক্ষেত্রে তাকে সমাজচ্যুত করার রীতিও সাঁওতাল সমাজে চালু আছে। এটিকে হুরকাটারা বা ইতুত বিয়ে বলে।
আবার সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত বিরবোলক বিয়ে একবারেই অন্য রকম। কোনো সাঁওতাল যুবতী কোনো যুবকের প্রেমে আত্মহারা হলে তখন সে বিচিত্র নকশা-আঁকা একটি মাটির হাঁড়িতে মদ নিয়ে ছেলের বাড়িতে গমন করে। যুবতীকে দেখামাত্রই যুবকের মা কিংবা মাতৃস্থানীয়রা ব্যাপারটি বুঝতে পারে। তখন তারা যুবতীকে তাড়াবার জন্য নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করে, যেমন : খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ মিশিয়ে দেয়া, যাতে সে সংসারকে তিক্ত মনে করে চলে যায়, একসঙ্গে অনেক শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে ধুঁয়োর মারফত তাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। কিন্তু যুবতী নাছোড়বান্দা। যতই লাঞ্ছনা হোক, সে থাকে অনড়। তখন মুরুব্বিরা তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তবে এ ধরনের বিয়ে বর্তমানে সাঁওতাল সমাজে খুব কমই দেখা যায়।
এরা বিশ্বাস করে, বাল্যকালে যদি কোনো ছেলে বা মেয়ের ওপরের মাড়িতে প্রথম দাঁত ওঠে, তবে সে দেবতার কোপানলে পড়েছে। তাই বয়োপ্রাপ্ত হলে তাদের বিয়ে অসবর্ণ পদ্ধতিতে সমাধা করা হয়। দেবতার অভিশাপ থেকে রক্ষার জন্য ছেলে বা মেয়েকে প্রথমে একটি কুকুর কিংবা শেওড়া গাছ অথবা মহুয়া গাছকে বিয়ে করতে হয়। কুকুর বিয়ে করলে তা শেতা বাপলা, শেওড়া গাছ বিয়ে করলে দাইবান বাপলা অথবা মহুয়া গাছ বিয়ে করলে তাকে মাতকোম বাপলা বলা হয়। এসব বিয়েতে বিশেষ আনন্দ ও নাচ-গানের মাধ্যমে বর ও কনেকে কুকুর, শেওড়া গাছ, মহুয়া গাছের নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। আগে থেকেই তাদের নতুন সাজে সাজানো হয়। এবং বর অথবা কনেকে প্রথমে তাদের যেকোনো একটিকে বিয়ে করে অতঃপর বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরের দিন বর ও কনে স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করার অধিকার পায়।
সাঁওতাল বিয়ের তিনদিন আগে বর বা কনের বাড়ির উঠানের চারপাশে চারটি খুঁটি পুঁতে তার ওপর শাল বা আম বা নিম ডাল দিয়ে তৈরি করা হয় ছামডা। এছাড়া বিয়ের তিনদিন বা পাঁচদিন আগে কোনো কোনো জায়গায় আগের দিন বা বিয়ের দিন জগমাঁঝির মাধ্যমে মারোয়া সাজানো হয় বিশেষ পূজার মাধ্যমে। এই পূজায় তিনটি মুরগি লাগে। মুরগিগুলো বলি দেয়া হয় জাহের এরার থান ও অন্য ঠাকুরের থানে যথাক্রমে জাহের এরা ও মড়েকো তুরুইকোদ এবং মারাঙবুরুর দেবতার নামে।
প্রথমে জগমাঁঝি গ্রামের যুবকদের মারোয়ার মধ্যে একটি মহুয়া গাছের ডাল পোঁতার নির্দেশ দেন। যেখানে ডাল পোঁতা হয় তার ভেতরেই তিনটি কাঁচা হলুদ, পাঁচটি ফুটো কড়ি ও তিনটি দূর্বাঘাসের ডগ এবং বাটা হলুদের সঙ্গে তিনটি আতপ চাল মিশিয়ে এক জায়গায় বেঁধে দেয়া হয়। মহুয়া ডাল পোঁতার পর সে জায়গায়টি মাটি দিয়ে ভরাট করে গোবর দিয়ে নিকিয়ে রাখতে হয়। অতঃপর আঁকা হয় রংবেরঙের আলপনা। মারোয়ার দুপাশে থাকে দুটো জলে ভরা কলসি। সাঁওতালদের কাছে এই কলসি মঙ্গল বা কল্যাণকর। বিয়ের যেকোনো অনুষ্ঠানই মারোয়ার সামনে অনুষ্ঠিত হয়। তাই অঞ্চলভেদে মারোয়া তৈরির ভিন্নতা থাকলেও এটি তৈরি করা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
সাঁওতালরা বিয়ের আগে ‘দা বাপলা’ বা গ্রাম পূজার আয়োজন করে থাকে। একটি মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটি চারকোনা গর্ত করে তার তিন দিকে তিনটি ধনুক দাঁড় করিয়ে সুতার ঘের তৈরি করে সিঁদুর দিয়ে এ পূজা শেষ করতে হয়। গর্তের মধ্যে দিতে হয় ‘সিটাকা (এক টাকার কয়েন’, চাউলি (চাল), দূর্বাঘাস ও হানডি (হাঁড়িয়া) ও পানি। পূজা শেষে গর্তের কিছু পানি একটি কাঁসার ঘটিতে করে নেয়া হয় কনের গোসলের সময় ব্যবহারের জন্য। সাঁওতালদের বিশ্বাস, এ পানি মিশিয়ে গোসল করালে কনে অপদেবতাদের কুদৃষ্টি থেকে মুক্তি পাবে।
এদের বিয়ের আগের দিন বর ও কনে উভয়ের বাড়িতে তেলাইদান নামক একটি অনুষ্ঠান পালন করে। তেলাইদানের আগে কমপক্ষে তিনজন সধবা মেয়ে পুকুর থেকে কলসভর্তি জল এনে বরকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়। একই নিয়ম মেনে কনের বাড়িতেও কনেকে স্নান করানো হয়। এই জল আনারও বিশেষ নিয়মও থাকে। যেমন, বিধবা বা অবিবাহিতা মেয়েরা জল আনতে পারে না, কলসির সামান্য অংশ খালিও রাখা যায় না। আবার জল আনার সময় পেছন থেকে ডাকা একেবারেই নিষেধ থাকে।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে স্নানের মাধ্যমে শরীরকে পবিত্র করা হয় যাতে অপদেবতার কোনো দৃষ্টি না পড়ে। জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করার মধ্যেও একই বিশ্বাস রয়েছে। অতঃপর বর ও কনেকে যার যার বাড়িতে নতুন কাপড়, রুপার অলঙ্কার পরানো হয়। ওইদিন থেকেই শুরু হয় নাচ-গান আর আনন্দ-ফুর্তি।
সাঁওতালরা বিয়ের দিন একই নিয়মে বর ও কনেকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়।
তেল-হলুদ মাখানোর সময় এরা সাঁওতাল ভাষায় গান গায় :
সুনুম সাসাং অজঃ মড়ে দিন পাহিল খন
দং বুন এনেচ আঃ ঝামর ঝামর।
সুনুম সাসাং পে অজঃ কেদিঞ।
ভিতির বলন পে মানা কেদিঞ।
ডুলৗ পাড়ন রিঞ ফাঁসি গজুঃ

ভাবার্থ :
গায়ে তেল হলুদ পাঁচ দিন আগে থেকে
দং নাচ হবে ঝামর ঝামর করে।
তেল হলুদ মাখাল
ভিতরে ঢুকতে মানা করল।
দে মা এক টুকরো দড়ি
পিঁড়িতে ঠেস দিয়ে ফাঁসি দিয়ে মরি।

স্নানের পর বর-কনের হাতে আম পাতায় বাঁধা একটি পোঁটলা বেঁধে দেয়া হয়। পোঁটলায় থাকে কমপক্ষে তিনটি দূর্বাঘাস, নখে খুঁটে সাতটি আতপ চাউল এবং তিন টুকরো কাঁচা হলুদ। অতঃপর বরপক্ষ কনের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে।
এ সময় কনের বাড়িতে বরকে নিয়ে নানারূপ কৌতূহলদীপ্ত গান গাওয়া হয়।
তেমনি একটি গান-
‘নাইন নুতুম দো বাবা বারঘরে মাছ ওয়া-এ পে
গুরিচ মন্দরে খুনতি বিদ মে,
নাইন নুতুম বারিয়াদ কো
হোর রে গে দরম কোপে
নাইন রেঁ জুরি দো নাতো রে গে।’
ভাবার্থ :
বাবা, মাঠের মধ্যে শামিয়ানা টানাও,
সেই শামিয়ানা যেন থাকে বাড়ির খুব কাছে,
এবং সে শামিয়ানার খুঁটি পুঁতে দিও গোবরের ঢিবিতে,
বরযাত্রী যখন আসবে তখন তাদের বাধা দিও,
বাবা, আমার হৃদয় রয়েছে তোমাদের কাছে।

যেদিক দিয়ে বরপক্ষ কনের গ্রামে প্রবেশ করবে সেদিকে কনেবাড়ির একজন মুরুব্বি আগে থেকেই জলভর্তি একটি কলস নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। বরপক্ষ আদি নিয়ম মেনে ওই কলসে একটি ছোট্ট লাঠি দিয়ে আঘাত করে গ্রামে প্রবেশের ইঙ্গিত দেয়। অতঃপর তাদের কনের বাড়ি থেকে একটু দূরে কোনো গাছের নিচে বসানো হয়। এ সময় কনের বাড়িতে প্রবেশ করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ থাকে। গাছের নিচে বরপক্ষকে কোনো কোনো সময় একদিনের বেশি সময়ও থাকতে হতো। এখানে থাকাকালীন তাদের খাওয়া-দাওয়ার যাবতীয় খরচ নিজেদেরই বহন করতে হতো।
গ্রামে বর পৌঁছানোর খবর পেয়েই কনে বাড়িতে প্রথম কনেকে স্নান করানোর ধুম পড়ে যায়। এই সময় একদল কুমারী মেয়ে আঁচলে মুড়ি বেঁধে বাজনা ও নৃত্যের তালে তালে পুকুর ঘাটে যায় এবং কলসভর্তি জল এনে কনেকে মই পেতে গোয়াল ঘরে বসিয়ে স্নান করায়। কোনো কোনো অঞ্চলে কেবল মইয়ের ওপর বসিয়েই স্নান করানো হয়ে থাকে।
সন্ধ্যার দিকে বাড়ির সেই মুরুব্বি এক ঘটি জল নিয়ে বর ও বরপক্ষকে বাড়ি আসার আমন্ত্রণ জানাতে রওনা হয়। এ সময় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি দল বাজনা নিয়ে বরকে বরণের অপেক্ষায় থাকে বাড়ির বাইরে। এই দলে দুটি কলসভর্তি পানি নিয়ে দুজন মহিলা এবং কনের মায়ের হাতে থাকে গুড় ও মিষ্টির একটি থালা। বর এসে প্রথম কনের মা, বাবা ও মুরুব্বিদের প্রণাম করে। কনের মা তখন জল নিয়ে নতুন জামাতার পা ধুইয়ে দেয় এবং কোলে বসিয়ে মুখে গুড় তুলে খাওয়ায়। একে ‘গুড় খিলা’ বলে।
যখনই বরপক্ষ বাড়ির ভেতর দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখনই কনেপক্ষের নৃত্যদল বরপক্ষের সঙ্গে আসা নৃত্যদলকে ভেতরে আসতে বাধা দেয়। এই বাধা চলে নাচ ও ধাঁধার মাধ্যমে। যতক্ষণ নাচ ও ধাঁধা চলতে থাকে ততক্ষণ বর গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে জল, গুড় ও মিষ্টি খেতে থাকে।
বরপক্ষ বাড়ির ভেতর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে বরের বাবা কিছু চাল, মুড়ি ও পয়সা প্রদান করে। এরপর কনের বড় বোন বরকে নতুন কাপড় পরাবার জন্য এগিয়ে আসে। এ সময় বরকে স্নান করানো এবং নতুন কাপড় পরানো হয়। একইভাবে কনের ভাই অপেক্ষায় থাকে বরপক্ষের কাছ থেকে কনের নতুন কাপড় নিতে। অনেক সময় বর নিজ হাতেই এই কাপড় প্রদান করে। বর নতুন কাপড় কনের ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়ার সময় উভয়ে কিছু আতপ চাল বদল করে পরস্পরের মুখে তুলে দেয়। কনের নতুন কাপড়ের সঙ্গে কনের মায়ের জন্য একজোড়া শাড়িও থাকে। সাঁওতালরা একে মারাংবুড়ো শাড়ি বলে থাকে।
সিন্দুর ঘানডি বা সাঁওতাল বিয়ের কাপড় থাকে হলুদ রঙের। কাপড়টি তৈরি করা হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। বাজার থেকে কিনে আনা ১২ হাত সাদা কাপড় কিনে সেটিকে কাঁচা হলুদে ডুবিয়ে এবং পরে শুকিয়ে তৈরি করতে হয় বিয়ের কাপড়।
নতুন কাপড় দেয়ার পর কনের বাবা বরের বড় ভাই বা ভাই সম্পর্কের পাঁচজন লোককে ঘরে আসার অনুরোধ জানায়। তবে এদের প্রত্যেককেই বর থেকে বয়সে বড় হতে হয়। অতঃপর গ্রামের মাতব্বর বা মুরুব্বিরা বিয়ের নতুন কাপড় পরীক্ষা করে। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, কাপড় নেড়েচেড়ে দোষ না ধরলে সংস্কার অনুযায়ী বিয়ে শুভ হয় না। কাপড়ে দোষ পেলে বরপক্ষকে জরিমানা বা দোষযুক্ত কাপড় অনেক সময় পাল্টেও দিতে হয়।
বিয়ের কাপড় চূড়ান্ত হলে মেয়ের মা নতুন কাপড় নিজে এবং মেয়েকে পরিয়ে দেয়। এরপর মা মেয়ের পা ধুইয়ে দেয়। পা ধুইয়ে দিলেই আগে থেকে রাখা বাঁশের ঝুড়িকে মেয়ে এসে ভক্তি দেয় এবং মেয়েকে ওই ঝুড়িতে বসিয়ে দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে বরের ওই পাঁচজন বড় ভাই এসে ঝুড়ি সমেত মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কনেপক্ষ সহজেই নিতে দেয় না। শুরু হয় ধাঁধার বাধা। এই বাধার সময় ঝুড়ি মাটিতেও পড়তে পারবে না আবার দরজার সঙ্গে স্পর্শও করানো যায় না। অন্যথায় বরপক্ষকে জরিমানা দিতে হয় যা কনেপক্ষের মেয়েরা আনন্দ করে ভাগ করে নেয়।
পাঁচজন বড় ভাই অথবা কনের ভাসুর যখন ঝুড়ি উঁচু করে মারোয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন বরের ভগ্নিপতিরা বরকে কাঁধে নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠ অঙ্গুলি একত্র করে কৌটা থেকে তিনবার সিঁদুর তুলে কনের কপালে পরিয়ে দেয়। সিঁদুর-দান অনুষ্ঠান হয়ে গেলেই ধরে নিতে হয় তারা স্বামী-স্ত্রী। উপস্থিত সবাই তখন আশীর্বাদ জানায়।
সিঁদুর দান পর্বটি শেষ হলেই শুরু হয় কনের মা ও কনের মধ্যকার একটি বিশেষ আচার। মেয়ের মা সিঁদুর, তেল, হলুদ, চালের গুঁড়ো মেয়ের মুখমণ্ডল, কপাল ইত্যাদিতে মাখিয়ে দেয় এবং মেয়েও তার মাকে মাখিয়ে দেয়। তখন মেয়ের বড়বোন একটা লাঠির মাথায় পাতায় করে বেঁধে আগুন এনে মায়ের হাতে দেয়। মা সে লাঠি একবার বাম হাতে নিয়ে ডান হাত আকাশের দিকে তোলে। একইভাবে ডান হাতে নিয়ে বাম হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে। এভাবেই এ পর্বটি শেষ হয়। অতঃপর বড়বোন এসে জল ঢেলে ওই আগুন নিভিয়ে দেয় এবং মা-কনে ও জামাতাকে মিষ্টি ও জল খাইয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়।
সাঁওতাল সমাজে কনে বিদায়ের আগে বর পক্ষের কিছু লোক এবং কনে পক্ষের কিছু লোকসহ কনের বাবা মিষ্টি ও জল হাতে নেয়। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকে গ্রাম্য মোড়ল। সবার মধ্যে তখন মিষ্টি ও জল খাবারের পালা চলে। কনেপক্ষ তখন বরপক্ষকে তাদের মেয়েকে সুখে-শান্তিতে রাখার অনুরোধ জানায়। অতঃপর উভয়পক্ষ নবদম্পতির সুখময় জীবনের জন্য মারাং বুড়োর কাছে প্রার্থনা করে। এরপরই শুরু হয় কনে বিদায়ের অনুষ্ঠান। এ সময় সাঁওতালরা বিদায়ের গান ধরে :

আতো গাতি কুড়ি কোড়া
মায়া জালাং ছাড়া ফিঁদেই
ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে
ঈং রেনাং মায়া জালা মিনা
আনাং মেন খান।
কাদাম বাতে চাপা দিন পে
ত্রিয়ে ডুচিয়ে তে গেদু জিন পে
দেউড়ে চিতাং কুলি শহর নূর।

ভাবার্থ :
গ্রামের যত যুবক যুবতী আছে
মায়ার জালে আটকা তাদের কাছে
ছিলাম আমি। এখন বোঙ্গার জালা
ছিঁড়লো মায়া, আমার যাওয়ার পালা
কদম ফুলে ইশারায় দিস্‌ ডাক
আসবো আমি, মিথ্যা নয় এ হাঁক।

কনে নিয়ে বর গ্রামে এলে প্রতি বাড়ি বাড়ি চলে বর ও বধূকে মিষ্টি খাওয়ানোর পালা। এ সময় ধান, দূর্বা, চাল, সিঁদুর দিয়ে নবদম্পতিকে বরণ করা হয়। অতঃপর দুজনকে একত্রে বসিয়ে যে ঝুড়িতে কনেকে আনা হয়েছে সেই ঝুড়ি দুজনের ওপরে সাতবার ঘোরানো হয় এবং আগুনের তাপ দিয়ে হালকা সেঁক দেয়া হয় তাদের গাল ও মুখে। এভাবেই সাঁওতাল বিয়েতে বর-কনেকে বরণ করে নেওয়া হয়।
সাঁওতালরা কনে দেখা থেকে শুরু করে বিয়ের শেষ পর্ব পর্যন্ত হাড়িয়া (প্রিয় পানীয়) ব্যবহার করে থাকে। হাড়িয়া ছাড়া এ আদিবাসী জাতির বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানই সম্পন্ন হয় না। এটি তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। কনের বাড়িতে বরপক্ষকে হাড়িয়া দিয়ে বরণ না করলে তা অপমানের সমতুল্য হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া বিয়েবাড়িতে শূকর বা ছাগলের মাংস, গুড়-ভাত, আম, কলা প্রভৃতি খাবার খাওয়ানোর রীতি চালু রয়েছে।
বিয়েবাড়িতে এরা ধামসা, মাদল, বাঁশি, বানাম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। তবে অনেক জায়গায় কাঁসার থালাকেও বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। বিয়েতে ছেলেরা বাদ্য বাজায় আর মেয়েরা অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে মাদলের ছন্দে ছন্দে নাচতে থাকে। একের বাহুতে এরা বেঁধে নেয় অন্যের বাহু। সাঁওতালরা একে দোন বা ঝিকানৃত্য বলে।
সাঁওতালরা মনে করে সিঁদুর দান থেকে একটি সুখী পরিবার তৈরি হয়। বাঙালি হিন্দু সমাজে সিঁদুরের ব্যবহারটি এসেছে মূলত আদিবাসী সমাজ থেকেই। হিন্দুদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থ পুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ প্রভৃতিতে ঘট স্থাপনের কথা বলা হলেও কোথাও সিঁদুরের উল্লেখ নেই। বাংলার ভট্টভবদেব এবং পশুপতি পণ্ডিতসহ অনেকেই সিঁদুরদানের বিষয়ে পৌরাণিক কোনো শাস্ত্র খুঁজে পায়নি। ফলে সর্বপ্রথম পালযুগে ভট্টভবদেব এবং পশুপতি ভদ্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত প্রথানুসারে শিষ্ট সমাচারাৎ মারফত সিঁদুরদানের স্বীকৃতি দেয়। অথচ তারও বহু আগে থেকে স্বীকৃতি ছাড়াই আদিবাসী সমাজে সিঁদুর জনপ্রিয় ছিল। সিঁদুরের প্রচলন নিয়ে সাঁওতাল সমাজেও খুঁজে পাওয়া যায় নানা কাহিনী।
সাঁওতাল পরিবারগুলোতে স্বামীকে দেবতাতুল্য মনে করা হয়। তাদের গানেও এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে। যেমন :

নিঞগাঁ নাপুন সারি কান্দো বড়বারি
গতেঞ তালুক তুকু-এ বরোবারিক;
জিয়ী বো গে বারিক গাতিং গে নাতাঁ
জিয়ী বোগে বারিক গোতিং তিঙগুন
নিনান জিয়ী দোরো গতেন তাই রে।

ভাবার্থ :
পিতা আর মাতা দেবতা সদৃশ;
কিন্তু স্বামীর সমকক্ষ কে আছে?
জীবনের সকল সুখ এবং দুঃখ
একমাত্র স্বামীই ভাগ করে নিতে পারে;
একমাত্র স্বামীই বিপদ রুখে দাঁড়াতে পারে
আমার গোটা জীবন স্বামীর হাতেই নির্ভরশীল।

সাঁওতাল আদিবাসীরা বিশ্বাস করে জলের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। যে অর্থে জলের অপর নাম জীবন সে অর্থে জলে রয়েছে অতিমাত্রায় জীবনসার। এরা মনে করে, জীবনসার দিয়েই জীবনকে দীর্ঘায়ু করা যায়। এ কারণেই বিয়ের আচারে জলের ব্যবহার বেশি। বিবাহ-অনুষ্ঠানে কুলোতে ধান-দূর্বা, আতপ চাল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। সাঁওতালরা মনে করে কুলো লক্ষ্মীর শূর্প অর্থাৎ যাতে সৌভাগ্য আসে। ধান-দূর্বা দীর্ঘায়ু ও নবদম্পতির সুখী জীবনের চিহ্ন বহন করে। আবার আতপ চাল, মিষ্টি ইত্যাদি অপদেবতাদের খাবার। সাঁওতাল বিয়েতে কনের আঁচলে যে ধান ও আতপ চাল গচ্ছিত রাখা হয় তা পরে ঘরের চালে ছিটিয়ে দেয়া হয়। অপদেবতার খোরাক হিসেবেই তাদের কোপানল থেকে বাঁচতেই এমন আচার পালন করা হয়ে থাকে।
এ আদিবাসী বিয়েতে সিঁদুরদান উৎসবের পর বর ও কনে একত্র বসে খায় এবং একজনের মুখের খাবার মুখ থেকে বের করে আর একজনকেও খাওয়ানো হয়। এরা বিশ্বাস করে, এতে দুজনের আত্মা এক হয়ে যায়। তবে তাদের সমাজে স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসে খাওয়া সেটিই প্রথম এবং শেষ। কেননা, এদের সমাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে খাওয়ার রীতির প্রচলন নেই। এছাড়া সিঁদুরদান উৎসবে রব ও কনে পরস্পরের কনিষ্ঠ আঙ্গুল থেকে রক্ত বের করে সিঁদুরের সঙ্গে মিশিয়ে কিছুটা জিহ্বায় দেয় এবং বাকি অংশ কনের কপালে পরিয়ে দেয়। কেননা, এদের কাছে সিঁদুর যৌনতা ও বিজয়ের চিহ্ন।
সাঁওতালরা বিয়ের নির্ধারিত দিনে যদি জ্বালানি কাঠভর্তি গাড়ি কিংবা কোনো শিয়ালকে ডানদিক থেকে বামদিক যেতে দেখে তবে সেদিনের জন্য যাত্রা বন্ধ রাখে। এছাড়া কোনো গাভীর মৃতদেহ দেখলেও এরা তখন আর যাত্রা করে না। তবে কোনো লোকের মৃত্যু সংবাদ শুনলে কিংবা ভরা কলসি দেখলে যাত্রা শুভ বলে মনে করা হয়।
নবদম্পতির দাম্পত্য জীবন সুখের এবং পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে সাঁওতালরা পালন করে একধরনের রীতি। বিয়ের পর কনে যখন শ্বশুরবাড়ি রওনা হয় তার আগে তাদের যেতে হয় পার্শ্ববর্তী নদী বা পুকুরে স্নান করতে। কনে যাবে আগে এবং বর তার পেছনে। বরের হাতে থাকবে তীর ধনুক। নববধূ স্নান সেরে কলসিভর্তি পানি নিয়ে ডাঙ্গায় উঠে এবং বর তার কাঁধে আস্তে করে হাত রেখে তীর ছুড়বে সামনের দিকে। অতঃপর দুজন হাঁটতে হাঁটতে আসে তীরের কাছে। কনে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে তুলে সেই তীর দেয় স্বামীর হাতে। পানিভর্তি কলস তখনো থাকে কনের মাথার ওপরে। সাঁওতাল সমাজে এ নিয়মের দুটো বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, তীর ছুঁড়ে অপদেবতার চক্ষু নষ্ট করে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত নববধূ যে স্বামীকে হাত, পা ও মাথার সাহায্যে আজীবন সহায়তা করবে তার প্রমাণ মাথায় কলস ভরা জল, হাত দিয়ে কলস ধরে রাখা এবং পা দিয়ে স্বামীকে তীর তুলে দেওয়া।
এ আদিবাসী সমাজে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ব্যক্তিগত কারণে বিবাদ তৈরি হলে তালাক প্রথা চালু রয়েছে। স্ত্রীকে স্বামী তালাক দিতে চাইলে তাকে কুড়ি টাকা জরিমানা প্রদানসহ বিশেষ আচারের মাধ্যমে তালাক দেওয়া হয়। পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে স্বামী-স্ত্রী উপস্থিত হয়ে স্বামী তালাক ঘোষণা করেন এবং শালপাতা টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে একটি পানিভর্তি কলসি উপুড় করে ফেলে দেন। শালপাতা ছিড়ে ও পানি ফেলে মূলত প্রতীকী অর্থে সম্পর্কচূতি ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
একইভাবে যদি স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতে চায় তবে গোত্র প্রধান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে তাকে পণের সমস্ত টাকা পরিশোধ করে এবং একই রীতি অনুসরণ করতে হয়। যদি স্বামী জরিমানার টাকা কিংবা স্ত্রী পণের টাকা পরিশোধ করতে না পারে সেক্ষেত্রে কারো তালাক সম্পন্ন হয় না।
সাঁওতাল সমাজে বিধবা নারী ও তালাকপ্রাপ্তদের দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রচলন রয়েছে। আবার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে ছোট ভাই বিয়ে করতে পারে। আবার অবিবাহিত যুবক যদি বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করতে চায় তবে তাকে প্রথমে একটি ফুলকে বিয়ে করতে হবে। অতঃপর সেই ফুলটি সিঁদুররাঙা করে মহিলাকে দিতে হবে। তবেই তারা স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করতে পারে।
এদেশে বসবাসরত সাঁওতালদের অধিকাংশই আজ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ফলে বদলে গেছে সাঁওতাল বিয়ের রীতিগুলো। যারা সনাতন ধর্মকে আগলে রেখেছেন, দারিদ্র্যসহ নানা কারণে তারাও টিকিয়ে রাখতে পারছেন না বিয়ের আদি আচারগুলোকে। ফলে এভাবেই লুপ্ত হচ্ছে সাঁওতাল বিয়ের আদি আচার ও রীতিগুলো।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক মানবজমিনে, প্রকাশকাল: ঈদ সংখ্যা-২০১৭ তে

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button