মুক্তিযুদ্ধ

জাসদের আন্দোলনের ফায়দা লুটেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরাই

সকাল তখন ৭টা। ছয়টা প্লেনে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ওপর বোম্বিং করে। সেসময় চোখের সমানেই শহীদ হন ১৩-১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের বাতাস। নিজেকে বাঁচানোর প্রাণান্তর চেষ্টা করতে থাকি আমরা। পাকিস্তানি সেনারাও আমাদের দিকে এগোতে থাকে। হঠাৎ ওদের টুইঞ্চ মর্টারের গুলি এসে লাগে আমার কলার বনে। আমি ছটকে পড়ি। ক্রলিং করে এগোতে যাব তখনই বাম পায়ের হাঁটুর জয়েটে লাগে আরেকটি গুলি। সারা শরীর তখন রক্তে ভেজা। মরিচের মতো জলছিল শরীর। সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে চিকিৎসা করে ক্যাম্পে।

“কলেরা তখন মহামারি আকারে ছড়াত। একজনের হলে পরিবারের বাকিরাও রক্ষা পেত না। চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল। ফলে এ রোগে গ্রামের পর গ্রাম শেষ হয়ে যেত। আমার নানা-নানি থাকত খালার বাড়িতে। খালাত ভাইয়ের বয়স তখন সাত। নানির আদরের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ও। একবার ওই গ্রামেও কলেরা ঢুকে। খালা, খালু ও খালত ভাই মারা যায় এক রাতেই। চোখের সামনে মেয়ে, জামাই ও প্রিয় নাতির মৃত্যুতে নানি মানসিক ভারসাম্য হারান। অনেক ডাক্তার দেখান হল। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। মাস ছয়েক কেটে যায় এভাবেই। পরে এক ডাক্তার পরামর্শ দেন অন্য কোনো নাতিকে নানির কাছে রাখার। নানা মেহের আলী খন্দকার তখন নিয়ে যান আমায়। আমাকে পেয়ে নানি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। সে থেকেই আমি নানির কাছে। মায়ের স্নেহ তিনিই আমায় বড় করেন।

“তখন খেলার মাঠের অভাব ছিল না। অবসরে বন্ধু কুদ্দুস, ওহিদুল্লাহ, আব্দুল মতিন প্রমুখের সঙ্গে বল খেলতাম। স্কুলে নাটকও করেছি। কলেজে উঠে যোগ দিই ছাত্র রাজনীতিতে। ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়ন তখন শক্তিশালী। দুটি সংগঠনের আদর্শগত মিল ছিল অনেক। তবে ছাত্র ইউনিয়ন করত ভাল ছাত্ররা। তখন চাঁদপুর কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ছিলেন আবুল কালাম ডালি। আমিও যুক্ত হই তাদের সঙ্গে।

পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের গুলিতে আবুল বাসারের ‘কলার বন’ ভেঙে যায়
পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের গুলিতে আবুল বাসারের ‘কলার বন’ ভেঙে যায়

“সারা দেশে আন্দোলন তুঙ্গে। কলিমুল্লাহ ভুইয়া ও ফিরোজ ভাইয়ের মতো নেতারা আসতেন কলেজে। বাঙালিরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি পেত না, বড় বড় সব জায়গা দখল করে রেখেছে পাকিস্তানিরা, আমাদের আয়ের টাকায় উন্নত হত পশ্চিম পাকিস্তান, কাগজ তৈরি হত এখানেই অথচ বেশি দামে কিনতে হত আমাদের– এইসব বৈষম্যের কথা নেতারা বোঝাতেন।

“ওই এলাকায় মুসলিম লীগের প্রভাব ছিল বেশি। সালাম মোক্তার ও আয়েত আলী ভূঁইয়া তখন ভাইটাল নেতা। তারা আমাদের মুভমেন্ট করতে দিত না। মিটিং করতাম গোপনে। পরিবারে প্রবীণরা অধিকাংশই ছিল মুসলিম লীগার। কিন্তু তরুণ ও যুবকদের দল ছিল আওয়ামী লীগ। এ কারণে আওয়ামী লীগকে তারা ঠেকাতে পারতেন না।”

একাত্তর-পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই বলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল বাসার।

তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার তুলপাই গ্রামে। আব্দুর রহমান ও শরিফা খাতুনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বাসার সবার বড়। বাবা ছিলেন সাধারণ কৃষক। বাসারের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি রামছড়ি প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি এসএসসি পাস করেন মতলব নারায়ণপুর হাইস্কুল থেকে। ১৯৭০ সালে মতলব কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। অতঃপর চলে আসেন যশোরে, ফুপুর বাড়িতে। ডিগ্রিতে ভর্তি হন এমএম কলেজে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।

 ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রসঙ্গে আবুল বাসার বলেন:

“দেশ তখন উত্তপ্ত। আমি যশোরে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় সবাই। বিকল্প কেউই নেই। আমরা তাঁর ভাষণটি শুনি রেডিওতে। তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল…, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…।’ আমাদের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। বুঝে যাই রক্ত দিয়েই পরিবর্তন আনতে হবে।”

এরপরই বাসার চলে আসেন গ্রামের বাড়ি, তুলপাইতে।

২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতে ঢাকায় আর্মি নামে। শুরু হয় গণহত্যা। গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার জন্য গঠিত হতে থাকে পিস কমিটি। আবুল বাসারদের পাশের বাড়িতে ছিলেন একজন হিন্দু ডাক্তার। নাম নিত্য হরি। রাতদিন তিনি গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করতেন। জাত বলে তাঁর কাছে কিছু ছিল না। বাপ-দাদার আমল থেকেই নিত্য হরিদের অগাধ সম্পদ ও জমিজমা ছিল। সেসময় মুসলিম লীগ ও পিস কমিটির লোকেরা ফন্দি আঁটে। স্কুল করার নামে তারা হিন্দু বাড়ির সম্পদ লুট করতে থাকে।

ডাক্তার সাহেব স্বাধীনতার কথা বলতেন। তাই এক রাতে তার স্ত্রীকে পিস কমিটির বেলায়েত হোসেন পাটোয়ারি, শামসুল হক, গোলাম আলী, আদম আলীসহ কয়েকজন রেপ করে। সারা জীবন যিনি মানবতার জন্য মানুষের সেবা করলেন, একাত্তরে তিনিই মানবতা পেলে না। মনের দুঃখে নিত্য হরি পরে ভারতে চলে যান।

ওই ঘটনা আবুল বাসারের বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। এভাবে চললে নিচের মা-বোনদেরও রক্ষা করা যাবে না। তাই বন্ধু আবুল খায়ের, বিল্লাল, সালামাতুল্লাহ, আব্দুল মান্নানসহ গোপনে তাঁরা পরিকল্পনা করেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।

এরপর কী হল? সে ইতিহাস শুনি আবুল বাসারের জবানিতে:

“সাংবাদিক আবু তাহের আমাদের সহযোগিতা করেন। কুমিল্লার চান্দিনা ও মুরাদনগর হয়ে আমরা চলে যাই ভারতের কংগ্রেস ভবনে। সেখান থেকে গোকুননগর ক্যাম্পে। কয়েকদিন পিটিপ্যারেড চলে। অতঃপর কর্নেল বাকসি এসে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য শিক্ষিত ছেলেদের তালিকা করেন। আমাদের নিয়ে যান আসাম লোহারবন ক্যাম্পে। ৪২ দিনের ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় থ্রি নট থ্রি, থার্টি সিক্স হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএলআর, স্টেনগান, এলএমজি প্রভৃতি। ওই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন গ্রি। আমি ট্রেনিং করি ‘ই’ গ্রুপে। তাই এফএফ নম্বর ই-৬৬৬৬।”

মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসারের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন
মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসারের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন

ট্রেনিং শেষে আবুল বাসারদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৪ নং সেক্টরে, কৈলাশপুরে। তাঁরা ছিলেন গেরিলা। নির্দেশ ছিল, ‘হিট অ্যান্ড রান’-এর। সাধারণ মানুষ নানাভাবে তাঁদের সাহায্য করতেন। বাসারদের দশজনের দলের সরাসরি কমান্ড করতেন শহিদুল আলম রব। আর কয়েকটি দল একত্রে অপারেশন করলে কমান্ডে থাকতেন সুবেদার হক।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনে রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসার। পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের গুলিতে তাঁর ‘কলার বন’ ভেঙে যায়। গুলি লাগে তাঁর বাম পায়ের হাঁটুর জয়েন্টসহ শরীরের কয়েক জায়গায়। এখনও ডান হাত দিয়ে তিনি স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না। প্রায় রাতেই এই যোদ্ধার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কানে ভেসে আসে সহযোদ্ধাদের আর্তচিৎকার। তখন ঠিক থাকতে পারেন না তিনি। স্বাধীনতার ৪৪ বছর কেটে গেছে। কিন্তু রক্তাক্ত ওই স্মৃতি আজও জীবন্ত হয়ে আছে তাঁর হৃদয়ে।

[  ভিডিও : আহত হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসার ]

কী ঘটেছিল ওই দিনটিতে?

প্রশ্ন শুনে খানিক আনমনা ও স্মৃতিকাতর হন এই বীরযোদ্ধা। অতঃপর বলেন, “আমরা তখন ৪ নং সেক্টরের কৈলাশপুরে। পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালি ক্যাম্প ছিল শমসের নগর ভিওপিতে। পরিকল্পনা হয় ওইদিকে অ্যাডভান্সের। আর্টিলারি সার্পোট দিবে ভারতীয় সেনারা। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয় রেঞ্চের মধ্যে চলে যাওয়ার। দশটি গ্রুপে আমরা ১৬০ জনের মতো।

“২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। রাত তখন ২টা। অ্যাম্বুস করে আমরা পজিশনে গেলাম। হাতে থ্রি নট থ্রি। ভারতীয় সেনারা প্রথমে আর্টিলারি ফেলবে। এরপরই আমরা ফায়ার ওপেন করব।

“অপারেশনের শুরুটা সেভাবেই হল। কিন্তু ভারতীয় সেনাদের আর্টিলারি নিক্ষেপের হিসাবটা ছিল ভুল। ফলে সব গোলা গিয়ে পরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পের পেছনের দিকে। আমরা তো হতবাক। কী করব বুঝতে পারছি না। ওদের ক্যাম্প ছিল অনেক উঁচুতে। আমরা ছড়ার মধ্যে পজিশনে। আক্রমণের পরিকল্পনা ওরা টের পেতেই ক্যাম্পের সব বাতি নিভিয়ে দেয়। অন্ধকারে আমরা কিছুই দেখি না। আর্টিলারি বন্ধ হতেই ওরা ফায়ার ওপেন করে দেয়। থেমে থেমে আমরাও গুলি চালাই।

“সকাল তখন ৭টা। ছয়টা প্লেনে পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ওপর বোম্বিং করে। সেসময় চোখের সমানেই শহীদ হন ১৩-১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের বাতাস। নিজেকে বাঁচানোর প্রাণান্তর চেষ্টা করতে থাকি আমরা। পাকিস্তানি সেনারাও আমাদের দিকে এগোতে থাকে। হঠাৎ ওদের টুইঞ্চ মর্টারের গুলি এসে লাগে আমার কলার বনে। আমি ছটকে পড়ি। ক্রলিং করে এগোতে যাব তখনই বাম পায়ের হাঁটুর জয়েটে লাগে আরেকটি গুলি। সারা শরীর তখন রক্তে ভেজা। মরিচের মতো জলছিল শরীর। সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে চিকিৎসা করে ক্যাম্পে।

“ভারতীয় সেনাদের আর্টিলারি নিক্ষেপের ভুল হিসাবের কারণেই ওইদিন বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা শহীদ হন। এ ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধারা ইন্ডিয়ান আর্মিদের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। এ খবর পেয়ে ওসমানি সাহেব এসে সবাইকে শান্ত করেন।”

একমাস চিকিৎসার পর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসার ফিরে আসেন রণাঙ্গনে। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ২ নং সেক্টরের মেলাঘরে। সেখানে ১৩ বেঙ্গলের আন্ডারে ওয়ারলেন্স ট্রেনিং নেন তিনি। অতঃপর কাজ করেন মেলাঘর হেড কোয়ার্টারের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। পরে আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কচুয়ায়। স্বাধীনতার সময় তিনি ছিলেন ওই এলাকাতেই।

স্বাধীনতা লাভের পর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসার শিক্ষকতার পাশাপাশি যুক্ত হন জাসদের রাজনীতির সঙ্গে। চাঁদপুরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কৃষক লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। রাজনীতি করতে গিয়ে পাঁচবার গ্রেপ্তারও হন এই মুক্তিযোদ্ধা। পরে সহকারী শিক্ষা অফিসার হিসেবে চাকুরি হয়ে যায় তাঁর। ফলে রাজনীতি ছেড়ে দেন তিনি।

 যে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার পরে তাঁর বিরুদ্ধেই কেন রাজনীতি করলেন?

মুক্তিযোদ্ধা সনদ
মুক্তিযোদ্ধা সনদ

আবুল বাসার তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:

“মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মিলিশিয়া ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিলাম। কথা ছিল, যারা চাকুরি করতে চায় করবে, লেখাপড়া করতে চাইলে সরকার তারও ব্যবস্থা করবে। আমাদের বুকভরা কত স্বপ্ন। কিন্তু দেড় মাস খাওয়ানোর পরই বলা হল যে যার কাজে ফিরে যাক। আমরা হতাশ হলাম।

“স্বাধীনের পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমার ওখানে নির্বাচিত হল পিস কমিটির কোষাদক্ষ ইদ্রিস মাস্টার। নানাভাবে তিনি আমাদের ওপর মামলা ও অত্যাচার শুরু করেন। আওয়ামী লীগকে তখন পাশে পাই নাই। কমান্ডার ছিলাম। সহযোদ্ধারা আসত পরামর্শ নিতে। কী করবে, কেমনে চলবে তারা। কিছুই বলতে পারতাম না।

“চারদিকে তখন অভাব। রিলিফ কমিটি করে তার প্রধান করা হল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। রিলিফে তারা নানা অনিয়ম আরম্ভ করে। যুদ্ধ করে এসেছি মাত্র। মেনে নিতে পারলাম এ অন্যায়। হতাশও হলাম। একদিন ওহিদুর চেয়ারম্যান আসলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনিও। বোঝালেন, এখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়াই ভাল। প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকেই যোগ দিলাম জাসদে। এভাবেই জাসদের জন্ম তুখোর কিছু মুক্তিযোদ্ধার ফ্রাস্টেশন থেকেই।”

সে সময় জাসদ করার সিদ্ধান্তটি তাঁর সঠিক ছিল না বলে মনে করেন জাসদের এই প্রাক্তন সদস্য। তিনি বলেন:

“বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে শ্রেণিবৈষম্য কমবে। কিন্তু সেটা তো হল না। বরং মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী একটি গ্রুপ মুজিববিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলল। এই সুযোগটি নিল স্বাধীনতাবিরোধীরা। কচুয়াতে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী লোক ছিল বেশি। আয়াত আলী ভূঁইয়ার মতো মুসলিম লীগারও তখন জাসদের পক্ষে ছিল। এটা যে ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে পারিনি। সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর। দেশটাও চলতে থাকে উল্টো পথে। এসব ভেবে এখনও মানসিক যন্ত্রণা হয় আমার। আমি মনে করি, জাসদের আন্দোলনের ফায়দা লুটেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরাই। ইতিহাসের এ দায় জাসদ কোনোদিন এড়াতে পারবে না।”

সপরিবারে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল বাসার
সপরিবারে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল বাসার

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দুঃখ করে বলেন, “১৯৭১ সালে কচুয়ায় ছিল ১৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা। এখন ভাতা তুলেন ৩৬৮ জন। তালিকা বাড়ার জন্য প্রথম দায়ী শনাক্তকারী মুক্তিযোদ্ধারাই। এই তালিকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কলঙ্কজনক। স্বাধীনের পর মিলিশিয়া ক্যাম্পগুলোতে তালিকা করা হয়েছিল। সেটি দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করা যেত। তবে সরকার কঠোর হলে এখনও সম্ভব তালিকা ঠিক করা।”

দেশে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় জঙ্গিবাদের মতো অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসার। এর পেছনে স্বাধীনতাবিরোধীদেরও মদদ রয়েছে। তিনি তাই এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন।

  “বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে মানুষের মনের ভেতর প্রতিষ্ঠা করা অতি জরুরি। এর ফলে প্রজন্মের দেশপ্রেম বাড়বে। তবে শুধু আইন প্রনয়ন করে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।”

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা।

মৃদু হেসে মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসার বলেন, “আগে তো দেশের কোনো লক্ষ্যই ছিল না। ছিল না কোনো স্বপ্ন। এখন আমরা চলছি। স্বপ্নও দেখছি। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ হবে। এটা ভাবলেই মনটা ভরে যায়। কচুয়াতে একসময় নৌকা ছাড়া চলার উপায় ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার এসে প্রতি এলাকাতেই রাস্তা করেছে, গ্যাস দিয়েছে, রাস্তাঘাট, স্কুল হয়েছে। দেখলেই ভাল লাগে।”

খারাপ লাগে কখন?

“অনেককেই দেখি সুবিধার জন্য আওয়ামী লীগ করছে। তাদের লুটপাটের কারণে বদনাম হয় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের। এদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে। নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার মতো সৎ হওয়ার চেষ্টা করলে দেশের চেহারা পাল্টে যেত।”

পরবর্তী প্রজন্ম একসময় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মনেপ্রাণে এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাসরের। নিজের ছেলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন:

“আমার ছেলে নাজমুল আহসান, পুলিশের সার্জেন্ট। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাঁকে সবসময় সৎ থাকতে বলেছি। এখন এটাই যুদ্ধ। আমি বিশ্বাসও করি, সে সৎ পথেই আছে। এ প্রজন্মকেও বলব, প্রতি ক্ষেত্রে সৎ থাকার চেষ্টা করাটাই এখন মুক্তিযুদ্ধ। তোমরা সে যুদ্ধটা চালিয়ে যেও। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা লালন কর। দেশের ইতিহাস না জানলে তোমরা ভবিষ্যতের ইতিহাস গড়বে কীভাবে?”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button