কলাম

সাঁওতাল যুবকের রক্তমাখা জমিতে আখচাষ

যখন লিখছি, গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ চিনিকল কর্তৃপক্ষ তখন ব্যস্ত জমি তৈরিতে। উচ্ছেদকৃত জমিতে তারা পুলিশি পাহারায় আখ চাষের জন্য কলের লাঙল চালাচ্ছে। রাতারাতি আখক্ষেতের জায়গাটিকে চাষ উপযোগী করার প্রাণান্তর চেষ্টা তাদের। অথচ দুদিন আগে এই জমিতেই এবং এই জমির জন্যই দুই সাঁওতাল যুবকের রক্ত ঝরেছে। সেই রক্তের দাগ মুছে দেওয়ার চেষ্টার যেন কমতি নেই। আদিবাসীদের রক্তমাথা জমিতেই আখচাষ করতে হবে। মাটি চাপা দিতে হবে অন্যায়কে!

ঘটনাটি গত রোববারের। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সম্মিলিতভাবে এ উচ্ছেদকাজে প্রথমে অংশ নেয় চিনিকল শ্রমিক ও স্থানীয় বাঙালিদের একটি দল। তারা তিন শতাধিক আদিবাসী পরিবারের বাড়িঘর ভেঙে দেয়। পরে তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সাঁওতালরা। তীর-ধনুক নিয়ে তারাও উচ্ছেদ ঠেকানোর চেষ্টা করে। ফলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে। ওই দিন পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হন শ্যামল হেমব্রম। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু ঘটে। গুলিবিদ্ধ হয় আরো কয়েকজন সাঁওতাল। আদিবাসীদের ছোড়া তীর-ধনুকের আঘাতে আহত হয় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ উভয়পক্ষের অন্তত ৩০ জন। পরে সাঁওতাল যুবক মঙ্গল মাদ্রির লাশও পাওয়া যায় খামারের ভেতরের ধানক্ষেতে।

প্রশ্ন হলো, এ দুই আদিবাসী যুবক নিহত হওয়ার দায় কে নেবে—চিনিকল কর্তৃপক্ষ, নাকি প্রশাসন? উচ্ছেদ করতে গিয়ে সংঘর্ষ এড়াতে না পারা ও গুলি চালিয়ে দুজনকে হত্যার মাধ্যমে প্রশাসনের ব্যর্থতা কি প্রকাশ পায় না? যদি আদিবাসীরা চিনিকল কর্তৃপক্ষের জায়গা দখল করেই থাকে, তবে কেন তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হলো না। কিংবা কয়েক মাস আগেই যখন আদিবাসীরা ঘর তুলছিল, তখন কেন তাদের বাধা দেওয়া হলো না। চিনিকল কর্তৃপক্ষের ওপর কার হুকুম আরোপিত হলো যে আদিবাসীদের হত্যা করে সেখানে আখচাষ করতে হবে? এই প্রশ্নগুলো বারবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়ালের বক্তব্য। তিনি বলেন, চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৯৬২ সালে আখচাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। তখন থেকে এসব জমিতে উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু দুই বছর আগে এসব জমি বাপ-দাদার দাবি করে আন্দোলনে নামে সাঁওতাল লোকজন। আন্দোলনের একপর্যায়ে তারা গত ১ জুলাই প্রায় ১০০ একর জমি দখলে নিয়ে একচালা ঘর নির্মাণ করে। ওই দিন থেকে তারা তীর-ধনুক নিয়ে জমি পাহারা দিচ্ছে।

আবদুল আউয়াল আরো বলেন, ‘১৯৬২ সালে জমি অধিগ্রহণের সময় চুক্তিনামায় বলা হয়, কখনো চিনিকল বা খামার বন্ধ হলে সে ক্ষেত্রে ওইসব জমি সরকারের কাছে চলে যাবে। অথচ এলাকার কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তির উসকানিতে সাঁওতালরা অবৈধভাবে চিনিকলের জমি দখল করে।’

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য পাওয়া যায় ইক্ষু খামার জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সহসভাপতি ফিলিমন বাস্কের। তিনি বলেন, ‘কারো উসকানিতে আন্দোলন করা হচ্ছে না। চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের সঙ্গে সাতটি শর্তে চুক্তি করে। সেখানে কখনো আখ ছাড়া অন্য ফসলের চাষ হলে প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন ধরে ওই সব জমিতে ধান ও তামাক চাষ হচ্ছে। অথচ জমি ফেরত দেওয়া হয়নি। তাই দখলের ঘটনা ঘটেছে।’

দুজনের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট, বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়; বরং এ নিয়ে ঠান্ডা লড়াই চলছে অনেক দিন ধরেই। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে চিনিকল কর্তৃপক্ষ কেন গণমাধ্যমে সে চুক্তিপত্রটি প্রকাশ না করে জোরপূর্বক উচ্ছেদের দিকে গেল?

আবার আমরা শঙ্কিত হয়ে যাই সাহেবগঞ্জ ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী সরকারের কথায়। তিনি বলেন, ‘চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও স্থানীয় কিছু বাঙালি আদিবাসীদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করাতেই এই সংঘর্ষ বাধে।’ যদি এটাই সত্য হয়, তবে প্রশাসন কেন তাদের উচ্ছেদকাজে লাগালেন।
উচ্ছেদকৃত সাঁওতালরা এখন আশপাশের আদিবাসী পাড়াগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ জীবন কাটাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে, অনাহারে-অর্ধাহারে। অনেকের স্কুলপড়ুয়া শিশুটিও স্কুলে যেতে পারছে না। যে আদিবাসী শিশুটি তার চোখের সামনে নিজেদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে দেখেছে, নিজের বাবা-ভাইকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছে—সে শিশুটি কি কখনো ক্ষমা করতে পারবে ওই বাঙালিদের?

সাহেবগঞ্জের ঘটনায় মামলা হয়েছে আদিবাসীদের বিরুদ্ধেই। ৩৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত সাড়ে ৩০০ জন আসামি । মামলায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ দীজেন টুটু, চরণ সরেন ও বিমল কিশকুকে এবং গোবিন্দগঞ্জ থেকে মাঝিয়া হেমব্রমকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া নানাভাবে ভয়ভীতির দেখানো হচ্ছে আশপাশের গ্রামের আদিবাসীদেরও।

কিন্তু যে দুই যুবককে হত্যা করা হলো, তাঁদের পরিবার বেঁচে থাকবে কোন সান্ত্বনা নিয়ে। কার বিরুদ্ধে, কোথায় গিয়ে তারা ছেলে হত্যার বিচার চাইবে?

উচ্ছেদের নামে দুই আদিবাসী যুবক হত্যার বিষয়ে প্রশাসনের স্পষ্ট বক্তব্য আমরা শুনতে চাই। উচ্ছেদের প্রক্রিয়াটি আইনসিদ্ধ ছিল কি না কিংবা কোন ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ গুলি চালাল, সেটিরও বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।

বর্তমান সরকার ও প্রধানমন্ত্রী আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আন্তরিক। এমনটাই বিশ্বাস করেন তাঁরা। কিন্তু যখন আদিবাসী শিশু ধর্ষিত হয়, আদিবাসী নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়, উচ্ছেদের নামে গুলি করে হত্যা করা হয় আদিবাসী যুবককে—তখন কিন্তু আস্থার সংকট তৈরি হতে থাকে সরকারের প্রতিও। তাই আদিবাসী হত্যা ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রকেই দাঁড়াতে হবে তাদের পাশে। তা না হলে মানবতা এ দেশে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হবে!

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমে, প্রকাশকাল: ১০ নভেম্বর ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button