আদিবাসী

ওয়ান্না বা ওয়ানগালা উৎসবের ইতিবৃত্ত

গারো আদিবাসীদের সর্বাপেক্ষা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ওয়ানগালা। এ উৎসবকে এরা বলে ওয়ান্না, ওয়ানাগালা, ওয়ানমা রংচুয়া ও দ্রুয়া ওয়ানবলা। ওয়ান্না বা ওয়ানা শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্য সামগ্রী ও গালা শব্দের অর্থ উৎসর্গ করা। উৎসবের উৎসর্গ পর্বটি গারোদের ধর্মীয় দিক আর ভোজ, নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ ও সম্মিলনের দিকটি সামাজিক দিক। তবে গারোদের কাছে ওয়ানগালার মূল বিষয়টি ধর্মীয়।

মূলত জুমচাষকে কেন্দ্র করেই ওয়ানগালা উৎসব পালিত হয়। কৃষি বর্ষচক্রের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, জুম ক্ষেতের ফসল (কার্পাস ও মরিচ বাদে) তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। গারো আদিবাসীরা ওয়ানগালার আগে নতুন খাদ্যশস্য ভোজন করে না। দেবদেবীর উদ্দেশ্যে শস্যাদি উৎসর্গ ও ধন্যবাদ জানানোর পরেই তারা তা গ্রহণ করে। এ কারণে অনেকেই এটিকে নবান্ন ও ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকে।

ওয়ানগালা উৎসবের নিয়ম অনুসারে জুম ক্ষেতের মাঝখানের কিছু অংশের ধান কাটা হয় সবশেষে। ওই স্থানটিকে গারোরা বলে আ’সিরকার স্থান। ধান কাটা হয় দেবতার উদ্দেশে ধূপ উৎসর্গ করে। অতঃপর গোড়া থেকে কেটে আঁটি বেঁধে এরা ধান নিয়ে আসে বাড়িতে। গারোরা এ সময় সবাই মিলে আনন্দ ধ্বনি করে। এদের বিশ্বাস শেষ ফসলের সঙ্গে তারা ক্ষেতের দেবতাদেরও বাড়িতে নিয়ে আসে।

ধান ঘরে এনে প্রথমে এরা মোরগ উৎসর্গ করে মিসি সালজং বা সূর্য দেবতার নামে। কারণ সূর্য দেবতার নামেই ওই স্থানে ধান বোপন করা হয়েছিল। অতঃপর নতুন ধানের চাল দিয়ে এরা ওয়ানগালার জন্য মদ তৈরি করে। এ অনুষ্ঠানের পর সংনি নকমা (গ্রাম প্রধান) সবাইকে ডেকে সভা করে ওয়ানগালা উৎসবের দিন নির্ধারণ করেন। দিনের সংখ্যা অনুসারে সমতলের গারোরা একটি রশিতে আর পাহাড়ের গারোরা ওমাক বিগিল নামে এক প্রকার গাছের ছাল দিয়ে গিঁট বেঁধে তা ঘরের চালে বেঁধে রাখে। একদিন পাড় হলেই এরা একটি করে গিঁট খুলে দেয়। ওয়ানগালার আগে গারোদের কলার পাতা ছিঁড়ে ব্যবহার করা নিষেধ থাকে। উৎসবের দিন ঘনিয়ে আসার আগেই গ্রামগুলোতে মদ তৈরির ধুম পড়ে যায়। সবাই পূজার স্থান, বাড়িঘর ও গোলাঘর মেরামত ও পরিষ্কার করে। উৎসবের জন্য বাজার থেকে কিনে আনা হয় গরু, শুকর, ছাগল, মোরগ। বাড়ির লোকদের জন্য কেনা হয় নতুন পোষাক ও অলংকারাদি। উৎসবে ব্যবহারের জন্য জোগাড় করা হয় মোরগ ও ডুকুয়া পাখির পালক।

ওয়ানগালার প্রথম দিনের নাম রুগালা। এ দিনটিতে মূলত উৎসর্গের উৎসব হয়। শস্যের জননী ও ভাণ্ডার দেবী রক্ষিমে, গৃহ দেবতা, সূর্য দেবতা প্রভৃতির উদ্দেশে মদসহ উৎসর্গ করা হয় নতুন ধানের ভাত, নতুন ফসলের ফলমূল, শাক-সবজি ও পশু-পাখি। রুগালার দিনে ওয়ানগালা উৎসবের জন্য গরু, শুকর প্রভৃতি মেরে গারোরা সবার মাঝে মাংস বিলি করে।

নকমা (গ্রাম প্রধান) নিকটস্থ ঝর্ণা বা খাল বা নদী থেকে দু’টি কাকড়া ধরে এনে একটি পাত্রে রাখেন। ওইদিন দুপুরের আগে তিনি একটি লাল বা সাদা মোরগ নিয়ে জুম ক্ষেতে যান। সেখানে আ’সিরকা স্থানে সেটি মিসি সালজং বা সূর্য দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করে পূজা-অর্চনা করেন। অতঃপর বাড়ি ফিরে তিনি ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের দ্রব্য সামগ্রী সাজান।

ঘরের মাঝখানে কয়েকটা কলার পাতা ইংরেজি ইউ অক্ষরের ন্যায় অথবা বর্গাকারে পেতে তাতে নতুন ধানের ভাত, আদা, নানা জাতের কচু, কুমড়া, সলংগা, তে, চিনারা প্রভৃতি শাক-সবজি, ফলমূল দু’ভাগ করে কেটে সাজিয়ে রাখেন। পাশেই জুম ক্ষেতে ব্যবহৃত কৃষি যন্ত্রপাতি দা, কুড়াল, কোদাল, নিড়ানী প্রভৃতি রেখে কলা পাতায় ঢেকে তার ওপর রাখা হয় কয়েক মুষ্ঠি চাল।

ঘরের মাঝখানে একদিকে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র- দামা, দাদিক, ক্রাম, রাং, নাগরা, আদিল, কাক্ওয়া, খা’আর প্রভৃতি। চালের মটকা বা পাত্রে মালার মতো সাদা সূতা দিয়ে বেঁধে, সূতায় বেঁধে দেওয়া হয় তিনটি তুলার পিণ্ড। অতঃপর তাতে চাল পুরোপুরি পূর্ণ করে তার মধ্যে একটি মুরগির ডিম ও মোরগের পালক গুচ্ছ বসিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামের লোকেরা নকমার বাড়িতে জড় হলে দুপুরের পরেই শুরু হয় ওয়ানগালা অনুষ্ঠান।

নকমা নিজেই বা পুরোহিত লাল বা সাদা রঙের পাগড়ি ও মোরগের পালক গুচ্ছ মাথায় পড়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি চাল রাখার মটকা বা পাত্রে ভাণ্ডার দেবী ও খাদ্য শস্যের জননী রক্ষিমের পূজা-অর্চনা করেন মন্ত্র পড়ে। অতঃপর একটি মুরগি জবাই করে তার রক্ত সূতার মালায় বাঁধা তিনটি পিণ্ডে মাখিয়ে তিনি মটকা বা পাত্রের গায়ে রক্ত ছিটান এবং ভেজা রক্তে মুরগির লোমগুলো লাগিয়ে দেন। এ সময় নতুন মদ ভাণ্ডার দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়।

অতঃপর গৃহ দেবতার উদ্দেশ্যে মন্ত্র পড়ে মদ ও পানীয় উৎসর্গ করা হয়। ঘরের ভিতরে এসে নকমা বা পুরোহিত গৃহ দেবতার উদ্দেশ্যে মোরগ উৎসর্গ করে মন্ত্র পড়ে ঘরের সামনের বেড়ায় মোরগের রক্ত ও লোম লাগিয়ে দেন। একইভাবে ঘরের মাঝখানের খুঁটির জন্যও একটি মোরগ উৎসর্গ করে তার রক্ত ও লোম মাখিয়ে  দেওয়া হয়। এভাবে রক্ত ও লোম লাগিয়ে দেওয়া হয় বাদ্যযন্ত্রগুলোতেও। কলার পাতায় ঢেকে রাখা কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর মন্ত্র পড়ে মদ ঢেলে উৎসর্গ করা হয়। এরপরই শুরু হয় ওয়ানগালার প্রধান পূজা-অর্চনা।

নকমা বা পুরোহিত পেতে রাখা ভাত-তরকারি, ফল-মূল, শাক-সবজি প্রভৃতি সামনে রেখে মন্ত্র পড়ে সারা ঘরে ছিটিয়ে দেন নতুন ধানের চাল বা রান্না করা ভাত। অতঃপর সকালে ধরে আনা কাকড়া দুটির ওপর মন্ত্র পড়ে মদ ঢেলে একটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যটিকে একটি বাঁশের কাঠিতে বিদ্ধ করে কাকড়াটিকে উপরে রেখে ঘরের মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হয়। এই বিদ্ধ কাকড়াটিকেই সূর্যদেবের বিদায় কালের সহযাত্রী হিসেবে মনে করা  হয়।

অতঃপর নকমা বা পুরোহিত মিসি সালজং বা সূর্যদেবতাকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্র পড়েন। তিনি পং এর মদ সাজানো দ্রব্য সামগ্রী-ভাত তরকারি, কৃষিজাত ফল-মূল, শাক-সবজি প্রভৃতির ওপর এক এক করে ঢালতে ঢালতে দ্রুত আসন থেকে উঠে সম্মুখ দরজা পাড় হয়ে পুনরায় নিজ আসনে ফিরে আসেন। এরপর তিনি ডান ও বাম পাশে রাখা মিল্লাম (গারো দ্বিধার তরবারি) ও স্পি (ঢাল) হাতে নিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে নাচতে আরম্ভ করেন। এ সময় সবাই সাজিয়ে রাখা বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাতে শুরু করে। নকমা বা পুরোহিত নিজ আসনে ফিরে আসলে মদ পান শুরু হয়। মদের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় মাংসের তরকারি। এভাবে গারো গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই রুগালা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

সব বাড়িতে এ অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই আবার নকমার বাড়িতে চলে আসে। রুগালার রাতে গারোরা নাচ-গান, আমোদ-প্রমোদ করে কাটায়। প্রত্যেক বাড়িতে তৈরি হয় পিঠা। যুবক-যুবতিরা খুশি মনে নেচে গেয়ে পরম্পরকে মদ পান করায়। এ সময় এরা পরম্পকে আজেয়া, দরোয়া খাবি ইত্যাদি গান দ্ধারা প্রশ্ন করেন ও উত্তর দেন। প্রশ্নের উত্তর সাধারণত পৌঢ় নর-নারীরা দিয়ে থাকেন। এ উৎসবের মাধ্যমে এভাবেই নবীন বয়সের গারোরা জেনে যায়-সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, দর্শন, পৌরাণিক কাহিনী ও গারোদের অতীত গৌরবময় ঐতিহ্যগুলো।

সাসাত স’আ মানে ধূপ সামগ্রী উৎসর্গ। ওয়ানগালার দ্বিতীয় দিনে হয় এ অনুষ্ঠানটি। ওইদিন খুব সকালে গ্রামের সবাই এসে জড় হয় নকমার (গ্রাম প্রধান) বাড়িতে। নকমা প্রথমে তাঁর সারা ঘরে নতুন চালের ভাত ছিটিয়ে দেন। গারোদের কাছে এ ছিটানো ভাতগুলোই শিলা বৃষ্টির প্রতীক। কৃষি মৌসুমে যেন সুবৃষ্টি হয় এবং ক্ষেতে ফসলের ভাল ফলন ফলে এটি সেই কামনারই বহিঃ প্রকাশ। নকমা নিজে বা পুরোহিত নকমার ঘরের চার কোণে পং-এ মদ নিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে মদ উৎসর্গ করেন ভাণ্ডারে ও মালজুরিতে। অতঃপর তিনি ধূপ পোড়া দিয়ে সূর্যদেবতা বা মিসি সালজংয়ের নামে ‘মন্ত্রপড়ে’ ধূপ উৎসর্গ করে সারা ঘরেই ধোঁয়া ভরিয়ে দেন। ধূপের কালো ধোঁয়া ঘরের বাইরে চলে গেলে আগামী বছর মেঘ এভাবেই ভেসে এসে বৃষ্টি বর্ষন করবে বলে গারোরা বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, সূর্য দেবতা ধূপের সুগন্ধে খুশি হন। এ সময় এরা উঠোনে বৃহৎ বৃত্তাকারে নানা অঙ্গভঙ্গি করে নাচে ও গান গায়। একে সা’আডাল বা মারা রোয়া বলে। এভাবে নাচ-গান ও ভোজন, পান প্রত্যেক বাড়িতেই সম্পন্ন হয়।

‘ক্রাম গগাতা’ মানে নকমার ক্রাম নকমার ঘরে তুলে দেওয়া। আর ‘জল ওয়াতা’র অর্থ শেষ বিদায়। ওয়ানগালার তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠান এটি। ওইদিন সকালে নাস্তা সেরে সবাই নকমার বাড়িতে সমবেত হয়। নকমার বাড়িতে দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে পুনরায় সংক্ষিপ্ত আকারে রুগালা ও সাসাত স’ওয়ার আচারগুলো করা হয়। সারাদিন গ্রামের সব বাড়িতেই এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। নাচ-গান, ভোজন-পান আগের দিনের মতই চলে।

সন্ধ্যার ঠিক আগে সবাই বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে হাজির হয় নকমার বাড়িতে। নকমা তখন শেষবারের মতো সবাইকে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বলেন। বাদ্যযন্ত্রে সুর উঠতেই নকমা তাঁর ঘরের মালজুরিতে সূর্য দেবতা ও রক্ষিমের উদ্দেশ্যে শেষ রুগালা ও সাসাত স’ওয়া করে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। অতঃপর তারা যেন আগামী বছর আবার এসে আশীর্বাদ করে সে আবেদন জানিয়ে খুশি মনে তাঁদের বিদায় দেন। দামা, ক্রাম, রাং প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রগুলো নকমার ঘরেই জমা থাকে। এভাবেই গারোদের ওয়ানগালা উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

বর্তমানে গারো আদিবাসীদের প্রায় অধিকাংশই খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী। ফলে ওয়ানগালা উৎসবটি এখন আর আদি ঐতিহ্য অনুসারে গারোরা পালন করে না। এখনকার গারো সমাজে ওয়ানগালা শুধুমাত্র নাচ-গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

ওয়ানগালা উৎসব নিয়ে গারো আদিবাসীদের মাঝে প্রচলিত আছে বেশ কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনী বা মিথ। ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি কাহিনীটির ভাবার্থ -‘প্রাচীনকালে মানব জাতি বনের আলু, কচু, গাছের ফল-মূল, লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করতো। ধান, জোয়ার, ভুট্টা ইত্যাদি খাদ্য-শস্য সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’ ছিলেন সেই সময়কার লোক। পৃথিবীতে তখন ধন-সম্পদ, মণি-মানিক্য, খাদ্য-শস্য প্রভৃতির একটি বিরাটকায় বৃক্ষ ছিল। এটি ছিলÑ‘সিলচি রিংরেরাম গিতল টিংটৎরাম দকাৎচি নাংরোরাম্ রিক্গিত্তক নাংসাৎরাম মাৎমা অংতুরুরাম কিৎমা বালগিতরাম মংমা দাংতরাম মাৎচু কিন্মা অনরাম উদারে জাক্ব্রি মেগংমা কলাৎচি’ দেশের ‘গিতিং দিংএ রানে দিংজের’ আজারেক চিজাপা নামক এক সুন্দর বাগানে। বৃক্ষটিকে সবাই ডাকতÑ‘গিসিল বল গিতল বল রিক্গে সামল জাপাং মনল’ নামে। এর শাখা-প্রশাখা চারদিকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একটি শাখায় ছিল ধান ও অন্যান্য খাদ্য-শস্যের প্রচুর ফল। কিন্তু মানুষ তো দূরের কথা, দেবতারাও তা আহরণ করতে পারতেন না।

বায়ু দেবতা ‘জারু মে আ জাবাল পান্থে অক্কুয়াংসি জাপাৎ চং সি’ পরিকল্পনা আটেন ওই বৃক্ষ থেকে খাদ্য-শস্যের বীজ পাবার। এ কারণে তিনি বন্ধুত্ব করেন ঝড় ও শিলা বৃষ্টির দেবতা ‘মিক্কা টেম্মা স্টিল রংমা’র সঙ্গে। তাঁর সহায়তায় তিনি ওই বৃক্ষে ভীষণ জোরে নাড়া দেন। এতে  ধান ও অন্যান্য খাদ্য-শস্যের বীজ মাটিতে পড়ে যায়।

কিন্তু বায়ু দেবতা ধানের বীজ না কুড়িয়েই বাড়ি চলে যান এবং মনের সুখে বাঁশি বাজিয়ে বিভোর হয়ে থাকেন। এ সুযোগে ‘আ’ নিং নসিকসক চিনিং নমিনদিল আ নিং দিপেরি চিনিং দিপেরা’ ধানের বীজগুলো কুড়িয়ে তার ক্ষেতে বপন করেন। পরবর্তীকালে সূর্য দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তাঁর কাছ থেকে ধানের বীজ নিয়ে নিজের ক্ষেতে বপন করেন এবং সর্বপ্রকার খাদ্য-শস্যের একচেটিয়া অধিকারী হন। তিনিই ছিলেন আকাশ ও উর্বরতার দেবতা।

একদিন সূর্য দেবতা বাজারে যাচ্ছিলেন কয়েকজন দাসকে সঙ্গে নিয়ে। তাদের সামনে দিয়ে বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল এ জগতের এক লোক। তার শরীর ছিল ময়লামাখা। পরনে নোংরা পোশাক। থলেতে খাবারের আলু। পেছনে সূর্য দেবতাদের মতো সুপুরুষদের পরিচ্ছন্ন পোশাকে দেখে সে লজ্জায় মস্ত বড় এক পাথরের আড়ালে গিয়ে লুকালো। সূর্য দেবতা তা খেয়াল করলেন। তিনি কাছে গিয়ে তাঁকে বেরিয়ে আসতে বললেন। লজ্জায় ও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে লোকটি বেরিয়ে এলো। নাম জানতে চাইলে, তিনি নাম বললেন ‘আনি আপিলপা চিনি গালাপাও।’

নামে নামে মিল দেখে সূর্য দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়লেন এবং গাছের ছায়ায় একসঙ্গে খাবার খেতে বসলেন। তিনি দেখলেন তাঁর বন্ধু খাচ্ছেন বনের আলু। তার খুব মায়া হলো। তাঁকে নিজের ভাত ও সুস্বাদু মাছ-মাংসের তরকারি খেতে দিলেন। অতঃপর জানতে চাইলেন, ঝুম ক্ষেতে ধান ও অন্যান্য খাদ্য-শস্যের বীজ তিনি বপন করেন কিনা?

উত্তরে বন্ধুটি বললেন-‘ধান কি, তা তিনি দেখেন নাই। তাই ধানের চাষ তিনি করেন না।’

শুনেই সূর্য দেবতার দয়া হলো। তিনি বললেনÑ ‘আমি তোমাকে ধানের বীজ পাঠাব। তুমি ঝুম চাষ করে ঝুম ক্ষেতে ধান বুনবে। যখন ধান পাকবে ও ঘরে তুলবে, তখন আমাকে স্মরণ করবে। তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব, মধুর সম্পর্ক অটুট রাখবে। প্রত্যেকবার ফল দিয়ে আমাকে আগে স্মরণ করে সমাদর করবে, আমার আর্শীবাদে, আমার দানে আনন্দ করবে, আমার কাছে প্রার্থনা জানাবে। আমি প্রতিবছর তোমাকে ও তোমার পরিবার পরিজনকে আশীর্বাদ করবো, তোমাদের মঙ্গল করবো। এ আমার প্রতিশ্রুতি।’

বাড়ি ফিরে সূর্য দেবতা প্রতিশ্রুতি মতো তাঁর দাস ‘নক্কল জসিকসক ররি জবংবং’-কে দিয়ে বন্ধু ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’কে ভালো ধানের বীজ পাঠালেন।

ওই দাস ছিল খুব ঈর্ষাপরায়ন। ভালো বীজগুলোকে সে ভেজে নষ্ট করে সূর্য দেবতার বন্ধুর হাতে তুলে দিলেন।

সরল বিশ্বাসে ভালো বীজ মনে করে তিনি ঝুমক্ষেতে তা বুনলেন। দখিনা বাতাস এলো। বৃষ্টিও হলো। কিন্তু বীজ থেকে কোনো চারা গজালো না। তা দেখে বন্ধু বিষন্ন ও হতাশ হলেন। সূর্য দেবতা তাকে ঠকিয়েছে ভেবে কষ্ট পেলেন। একদিন সূর্য দেবতার অন্য দাসদের পেয়ে তিনি ক্ষিপ্ত হলেন। ক্রোধে তাদের বেঁধে রাখলেন।

দাসদের কান্নায় আকাশ থেকে নেমে আসেন সূর্য দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’।

বন্ধুর কাছে তিনি অনুনয় করে বললেন ‘আমার এ দাসদের কোনো দোষ নেই। তাদের কান্নায় আমি থাকতে পারছি না। অন্যায় করেছে আমার দাস ‘নক্কল জসিকসক ররি জবংবং’। আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। তুমি এদের ছেড়ে দাও। আমি পুনরায় তোমাকে উত্তম ও সতেজ ধানের বীজ পাঠিয়ে দেব।’

সূর্য দেবতার অনুরোধে তাঁর দাসগণ মুক্ত হলেন। তিনি তার কথা মতো বন্ধু ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’ কাছে নতুন বীজ পাঠালেন।

নব উদ্যমে পরিশ্রম করে বন্ধুটি ঝুমক্ষেতে ধানের সে বীজ বুনলেন। দখিনা বাতাস এলো। বৃষ্টিও হলো। সতেজ বীজ থেকে ধানগাছ গজিয়ে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠল। তা দেখে বন্ধু ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’র মনে আনন্দ দোল খায়।

ধান পাকছে। কয়েকদিন পরেই কাটতে হবে। এমন সময় ঘটল আরেকটি ঘটনাটি! দেবতার অন্য কয়েকজন দাস গোপনে ক্ষেতের কিছু ধান কেটে চুরি করে নিল। হিংসা বশত তারা সূর্য দেবতার কাছে তার বন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেÑ ‘দেখ, তোমাকে আগে না দিয়েই পাকা ধানগুলো সে কেটে নিজেই খেয়েছে। তোমাকে সে উপেক্ষা করেছে, অসম্মান করেছে।’

শুনেই সূর্য দেবতা তাঁর পার্থিব বন্ধু ‘আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা’র ওপর রাগান্বিত হলেন। অতঃপর বন্ধুর পুত্র ও দাসদের ধরে এনে তিনি বন্দী করে রাখলেন।

এ সংবাদ শুনে আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা বিচলিত হন। সূর্য দেবতার কাছে ছুটে এসে তিনি অনুনয় করে বলেনÑ‘ আমি এখনো ঝুমক্ষেতের ধান কাটিনি। তোমাকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করে নিজে আগে খাই নি। তোমার প্রতি আমি বিশ্বস্ত আছি। কে বা কারা যেন কিছু পাকা ধান চুরি করে কেটে নিয়েছে। তারাই তোমার কাছে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছে। অনুগ্রহ করে আমার পুত্র ও দাসদের ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে সম্মান করি ও করব।’

সব শুনে দেবতার মন গলে। বন্ধুর পুত্র ও দাসদের তিনি মুক্ত করে দেন। নতুন করে তারা আবার বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ হন।

বন্ধু আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা  তখন মনের আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় মংরে পর্বতের (মন্দর পর্বত) চেন্দেন শিখরে দেবতার উদ্দেশে নতুন শস্য, নতুন মদিরা ও ধূপ প্রভৃতি উৎসর্গ করলেন। এভাবে মংরে পর্বতে প্রথম ওয়ানগালা উৎসব অনুষ্ঠিত হলো।

আকাশ, সূর্য ও উর্বরতার দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’ তখন খুশি হয়ে আর্শীবাদ করলেন ‘এ ব্যক্তি ও তার বংশধরগণের ভবিষ্যতেও ভালো ফসল হোক। তারা চিরকালের জন্যে আর্শীবাদযুক্ত হোক। প্রতি বছর ফসল কাটার ঋতুতে আমি পৃথিবীতে ফিরব আর্শীবাদ করতে। তখনো এভাবেই ধন্যবাদের পর্ব-উৎসব পালিত হোক।’

এভাবে আ’নি আপিলপা চিনি গালাপা প্রতি বছর ঝুমচাষ শেষে দেবতার আর্শীবাদে ওয়ানগালা করে ধন্যবাদের দান উৎসর্গ করেন। ফলে দিনে দিনে তিনি আরো ধনী ও সম্পদশালী হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর পুত্র-কন্যাদেরও জুমচাষে উৎসাহ দিলেন। আবার সাবধানও করলেন। আকাশ, সূর্য ও উর্বরতার দেবতা ‘মিসি আপিলপা সালজং গালাপা’কে তারা যেন ভুলে না যায়। তাঁকে যেন যথাযোগ্য সম্মান দান করা হয়। এভাবেই যুগ-যুগান্তরে বংশপরম্পরায় গারোদের ওয়ানগালা উৎসব পালন হয়ে আসছে।

সৃষ্টিকর্তার প্রতি উৎসর্গ নৈবদ্য না করে অর্থাৎ ওয়ান্না’র আগে চাষাবাদের কোন ফসলাদি-ই খাওয়া যায় না। তাই শুধু আমোদ-প্রমোদ, খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গান-ই ওয়ান্না উৎসবের মূখ্য বিষয় নয়, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ফসলাদির নৈবদ্য উৎসর্গ করে খাওয়ার রীতি-ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ-ই গারোদের ওয়ানগালা উৎসবের প্রধানতম বিষয়।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক মানবজমিন ঈদসংখ্যা-২০১৬ তে।

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button