কলাম

লাখো লোকের কর্মহীনতা ও সরকারের উচ্ছেদ অভিযান

এদের মধ্যে অনেকেরই ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। তার অর্থ সরকার ঠিকানা জেনেই তাকে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। সরকারের ভ্যাট ও ট্যাক্সও তারা নিয়মিত পরিশোধ করে আসছে। বলা যায়, সরকারের নজরদারি না থাকায় কিংবা সরকারের নজরদারির মধ্যে থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছে। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান তো একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাজউকের লোকজনের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে। তখন তারা কেন বলল না যে এখানে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না। সে হিসেবে আবাসিক এলাকায় কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার দায় সরকারকেও নিতে হবে।

এক বন্ধু বাস করেন ঢাকার উত্তরায়। আবাসিক এলাকাতে। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরি করেন। সকালে দুজনেই ছুটেন যার যার অফিসে। তার ৩ বছরের মেয়েটি থাকে বুয়ার কাছে। সেটিও সম্ভব হয় যদি বিশ্বস্ত বুয়া মিলে। সারাদিন নানা শঙ্কা আর দুশ্চিন্তায় কাটে তাদের কর্মজীবন।

উত্তরায় বন্ধুটির মতো অনেক পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী। ফলে, পরিবারের শিশুটিকে কোথায় রাখবেন তারা? সারাদিন বাবা-মা বিহীন শিশুটিও কীভাবে বেড়ে উঠবে? কীভাবে শুরু হবে তার শিক্ষাজীবন? এমন নানা চিন্তা থেকে বন্ধুটি একটি বাড়ি ভাড়া করে আবাসিক এলাকায় বসবাসরতদের জন্য গড়ে তোলেন একটি বেবি ডে-কেয়ার ও প্রি- স্কুল। নিজের মেয়েটিও পড়েন সেখানে। সেটিও প্রায় আট বছর আগের কথা। ভালই চলছিল স্কুলটি।

প্রায় পঞ্চাশটি পরিবার তাদের শিশুকে নিশ্চিন্তে রেখে যেতেন সেখানে। পুরো স্কুলে কাজ করত ১৫ জন। অর্থাৎ ১৫টি পরিবার চলত স্কুলের আয় দিয়ে। কিন্তু এই সবকিছুর ছন্দ পতন ঘটে কয়েকদিন আগে। উচ্ছেদ আতঙ্কে প্রতিষ্ঠানটি এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার পর সরকারের নজর পড়ে গুলশান, বনানী, উত্তরা ও ধানমন্ডির আবাসিক এলাকাগুলোতে। ২০ জুলাই আবাসিক এলাকায় থাকা ২ হাজার ৪০০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেয় রাজউক। এরপরই শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। এরই মধ্যে গুলশানের ১২টি রেস্তোরাঁ ও একটি হোটেল, উত্তরায় ১৭টি রেস্তোরাঁ ও পাঁচটি হোটেল, ধানমন্ডিতে নয়টি রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ঢাকা শহরে প্রায় ১৮ হাজার ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার মধ্যে মুদি দোকান, মোবাইল ফোনের দোকান, লন্ড্রি, ফার্মেসি, স্ন্যাকবার, বুটিক শপ, দর্জির দোকান এসব ছোটখাটো দোকান ভাড়া নিয়ে শুরু করা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও রয়েছে। এ উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সব মিলিয়ে ১ লাখ লোক কর্মহীন হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

শুধুমাত্র হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। এমন তথ্য জানিয়েছে, হোটেল-গেস্টহাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। বাকী প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব এখনও জানা যায়নি। তবে তা কয়েক হাজার।

ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকাগুলো যখন গড়ে ওঠে তখন শিক্ষা, চিকিৎসা, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস প্রাপ্তির পরিকল্পনা কতটুকু ছিল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কেননা, মূলত আবাসিক এলাকার মানুষদের চাহিদার দিকটি বিবেচনায় রেখেই গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।

এদের মধ্যে অনেকেরই ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। তার অর্থ সরকার ঠিকানা জেনেই তাকে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে। সরকারের ভ্যাট ও ট্যাক্সও তারা নিয়মিত পরিশোধ করে আসছে। বলা যায়, সরকারের নজরদারি না থাকায় কিংবা সরকারের নজরদারির মধ্যে থেকেই এসব প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছে।

তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান তো একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাজউকের লোকজনের চোখের সামনেই গড়ে উঠেছে। তখন তারা কেন বলল না যে এখানে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না। সে হিসেবে আবাসিক এলাকায় কমার্শিয়াল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার দায় সরকারকেও নিতে হবে।

সরকার জঙ্গিবাদ ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। সেটিকে আমরাও সাধুবাদ জানাই। প্রসঙ্গ হচ্ছে নিরাপত্তা। উচ্ছেদ নয়। তাহলে প্রশাসন কী এইসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ, নাকি নিরাপত্তা প্রদানে প্রস্তুত নয়! জনমনে এমন নানা প্রশ্ন আসাটা অবান্তর নয়।

নিরাপত্তার নামে আবাসিক এলাকার হাজার হাজার ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াটাই একমাত্র সমাধান নয়। তাতে লাখো মানুষ যেমন কর্মহীন হয়ে পড়বে তেমনি আবাসিক এলাকার মানুষেরাও নানা সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের ডেকোরেশন, অ্যাডভান্স ভাড়া ও পণ্যের ক্ষতি মিলিয়ে লাখ লাখ টাকার লোকসানের মুখে পড়বে।

বাংলাদেশে বিদেশি মিশনগুলোর অধিকাংশই এখন গুলশানে। এসব মিশনের কর্মকর্তারা কর্মস্থলের পাশে গুলশানে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তারাই ছিলেন গুলশানের রেস্তোরাঁগুলোর প্রধান ভোক্তা। গুলশান হামলার পর বিদেশিরা এমনিতেই বেশ আতঙ্কিত। এরপর অভিযান চালিয়ে হোটেলে থেকে বের করে দিলে তারা তো এদেশে থাকতেই চাইবে না।

এছাড়া এসব আবাসিক এলাকায় যে পরিমাণ মানুষ বসবাসের পরিকল্পনা ছিল বাস্তবে বসবাস করছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। আবাসিক এলাকার নাগরিকদের জন্য কয়টি স্কুল থাকবে, কয়টি হাসপাতাল, কয়টি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থাকবে সেটিও বাস্তবভিত্তিতে নির্ধারিত নয়। যদি তাই হতো তাহলে ধানমন্ডির মতো আবাসিক এলাকায় ইবনেসিনার মতো কর্মাশিয়াল হাসপাতাল বা শত শত স্কুল গড়ে উঠতে পারত না। গুলশানে কীভাবে গড়ে উঠল মানারতের মতো প্রতিষ্ঠান।

তাই নিরাপত্তার ইস্যুতে আবাসিক এলাকায় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করাই সমাধান নয়। তাতে লাখো লোক যে কর্মহীন হয়ে পড়বে সেটিও সরকারের খেয়াল রাখা প্রয়োজন। তবে যদি সরকার সত্যিকারভাবেই চায় আবাসিক এলাকায় কর্মাশিয়াল প্রতিষ্ঠান না রাখতে তবে তা করতে হবে ধীরে ধীরে, একটি বিকল্প প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

আমরা যেমন চাই জঙ্গিবাদ মুক্ত হোক এ দেশ। তেমনি চাই নিরাপত্তা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রত্যেক পরিবারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির। তাই আমরাও চাই, উচ্ছেদের নামে লাখো লোককে কর্মহীন করার প্রচেষ্টাও বন্ধ থাকুক।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, প্রকাশকাল: আগস্ট ২৩,২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button