কীর্তিমান বাঙালি

কবি শহীদ কাদরী: বাংলা কবিতার অন্যতম কিংবদন্তি

এ যাবৎ প্রকাশিত শহীদ কাদরীর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চারটি: ‘উত্তরাধিকার’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা , ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও। নিউইয়র্কে অবস্থানকালীন সময়ে প্রবাসে রচিত কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। অন্য তিনটি গ্রন্থের কবিতাগুলো তিনি রচনা করেন দেশছাড়ার আগেই অর্থাৎ ১৯৭৮ সালের মধ্যেই। এই চারটি গ্রন্থে সন্নিবেশিত কবিতার সংখ্যা ১২২টি। এর পরে তিনি আরও চারটি কবিতা লিখেন। সব মিলিয়ে তার কবিতার সংখ্যা ১২৬টি।

বাংলা কবিতার অন্যতম কিংবদন্তি কবি শহীদ কাদরী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলিতে যখন কলকাতার আকাশে গর্জন করছে বোমারু বিমান। সেসময় ১৯৪২ সালের ১৪ অগাস্ট তাঁর জন্ম কলকাতার পার্ক সার্কাসে। চল্লিশের দাঙ্গায় সন্ত্রস্ত কাদরী পরিবার কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন অনেকদিন।

পরে দেশভাগে ভাগ হয়ে যায় তার শৈশবও। পরিবারের সঙ্গে জীবন স্থানান্তর ঘটে বালক শহীদ কাদরীরও। ১০ বছর বয়সে শহীদ কাদরী চলে আসেন ঢাকায়। তবে শৈশবের কলকাতা পরিণত জীবনেও হাতছানি দিত তাকে। দেশভাগের যন্ত্রণা, ’৭১ এর মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ আর ’৭৫ এর হত্যাযজ্ঞের অভিজ্ঞতায় বারবার বাস্তুচ্যুত কবির জীবনের শেষ সময় কেটেছে সুদূর নিউ ইয়র্কে। মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থে তিনি দাঁড়িয়েছেন বাংলা কবিতার হৃদপিণ্ডে।

১৯৫৩ সালে, মাত্র এগারো বছর বয়সেই, ‘পরিক্রমা’ শিরোনাম দিয়ে তিনি একটি কবিতা লিখে ফেলেন, যেটি ছাপা হয় মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘স্পন্দন’পত্রিকায়। এরপর লিখেন, ‘জলকন্যার জন্য। সেটিও স্পন্দনেই ছাপা হয়। এভাবেই শুরু। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার বের হয় ১৯৬৭ সালে। তখন তাঁর বয়স ২৫ বছর। ‘উত্তরাধিকার’এ সংকলিত কবিতাগুলো কৈশোর এবং প্রথম যৌবনে রচিত হলেও ম্যাচিউরিটির কোনো অভাব নেই তাতে।

শহীদ কাদরী ছিলেন একজন পরিপূর্ণ নাগরিক কবি । প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ জীবনের স্বাদ গ্রহণ বা অভিজ্ঞতা অর্জনের কোনো সুযোগই তিনি পাননি। যে কারণে তার কাব্যভাষাটিও হয়ে উঠেছে শহুরে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কাব্যভাষা তৈরির জন্য অভিজ্ঞতা লাগে, বই পড়ে নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি হয় না।’ তাই তার কবিতায় শরৎ এসেছে নাগরিক দ্যোতনা নিয়ে।

একজন কবির বয়স যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ কবি শহীদ কাদরী। কবি শহীদ কাদরীর কবিতায় শরতের উপস্থিতি শরৎ ঋতু-বৈশিষ্ট্যের আবহে অবস্থান করেই তা কখনো বিপ্লবী, কখনো মানবিক আবার কখনো স্বপ্নচারী।’নশ্বর জ্যোৎস্নায় কবিতায় তিনি একটি সময়ের কথা বলেছেন যে সময় এখনো আসেনি। কবিতাটিতে তিনি যে চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন তা বাংলার শরৎ ঋতুরই ছবি।

এ যাবৎ প্রকাশিত শহীদ কাদরীর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চারটি: ‘উত্তরাধিকার’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা , ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও। নিউইয়র্কে অবস্থানকালীন সময়ে প্রবাসে রচিত কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। অন্য তিনটি গ্রন্থের কবিতাগুলো তিনি রচনা করেন দেশছাড়ার আগেই অর্থাৎ ১৯৭৮ সালের মধ্যেই। এই চারটি গ্রন্থে সন্নিবেশিত কবিতার সংখ্যা ১২২টি। এর পরে তিনি আরও চারটি কবিতা লিখেন। সব মিলিয়ে তার কবিতার সংখ্যা ১২৬টি।

আজন্ম নাগরিক কাদরী তার জীবনবোধে তিরিশ উত্তর আধুনিকতাকে সঞ্চারিত করে বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন নতুন স্পন্দন। নগর জীবনের নৈকট্য ও দূরত্বকে ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যে ঋদ্ধ করেছেন তিনি। শহর এবং সভ্যতার বিস্বাদ ও বিচ্ছিন্নতাও উঠে এসেছে তার কাব্যে।

তিনি বলেছেন:

“আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ।

আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ।”

কলকাতার পর ঢাকার আবাস ছেড়ে জার্মানির কোলন শহর, আমেরিকার বোস্টন ঘুরে শেষ আবাস নিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কে। বারবার বসত বদলানো কবির অভিমানের কথা পরিষ্কার করে আসেনি তার কোনো লেখায় বা বক্তব্যে।

তিনি শুধু লিখেছেন:

“হে আমার শব্দমালা, তুমি কি এখনও বৃষ্টি-ভেজা

বিব্রত কাকের মতো

আমার ক্ষমতাহীন ডাইরির পাতার ভেতরে বসে নিঃশব্দে ঝিমুবে।”

১৯৭৮ সালে জার্মানিতে যান শহীদ কাদরী। বছর চারেক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেশে এসে দৈনিক সংবাদ- এ কাজ শুরু করেন। ১৯৮২ সালেই আবার পাড়ি জমান লন্ডনে। সেখান থেকে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০ বছর বস্টনে থাকার পর ২০০৪ সাল থেকে নিউ ইয়র্কে বাস করছিলেন তিনি।

১৯৭৩ সালে বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য তিনি `বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ অর্জন করেন। ২০১১ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।

২৮ আগষ্ট ২০১৬,রোববার, সকাল ৭ টায় নিউইয়র্কের নর্থ শোর ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে কবি শহীদ কাদরী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত

তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ২৪.কম (ফয়সাল আতিক), প্রথমআলো ( নিউইয়র্ক প্রতিনিধি)

 

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button