মুক্তিযুদ্ধ

ওরা কি চাইব এই দেশে শান্তি থাকুক

একাত্তরের ২৫ মার্চ। ঢাকায় মানুষ মারা শুরু হইল। খবরটা আমরা পাই মাইনসের মুহে মুহে। তহনও গ্রামে আর্মি আহে নাই। ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরেই ওরা ক্যাম্প বসায়। দেখতাম আমগো গ্রামের উপর দিয়াই মানুষ সব পলাইতাছে বর্ডারের দিকে। মনডা খুব খারাপ হইত।

মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিনের ডান পায়ে বিদ্ধ গ্রেনেডের তিনটি স্প্লিন্টার
মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিনের ডান পায়ে বিদ্ধ গ্রেনেডের তিনটি স্প্লিন্টার

‘‘গ্রামে গ্রামে তহন শান্তি কমিটি হইল। যুবক দেখলেই জোর কইরা ধইরা প্রথমে শান্তি কমিটিতে, পরে রাজাকারে নিয়া যাইত। কার বাড়িতে সুন্দরী মাইয়া আছে, কার বাড়িতে গরু-ছাগল, সোনাদানা বেশি, কার বাড়ি থাইকা মুক্তিযুদ্ধে গেছে– আর্মিদের এই খবর আইনা দিত আর লুটতরাজ করত শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা। এর মধ্যেই মুক্তিফৌজের লোকেরা গোপনে যুবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। মুক্তিবাহিনীতে যাইতে চাইলেই কোন ঘাটে, কয়টার সময় নৌকা থাকব সব বইলা যাইত। কেউ যেন পলাইয়া মুক্তিযুদ্ধে যাইতে না পারে, এই জন্য শান্তি কমিটির লোকরাও রাতে পাহারা বসাইত। হাঁকডাক দিত,‘বস্তিওয়ালা জাগ রে’।’’

‘‘আফজাল আর আমি আগেই ঠিক করি, যুদ্ধে যামু। গোসলের কথা বইলা বাড়ি থাইকা রোজ একটা একটা কইরা কাপড় নিয়া রাহি আফজালের বাড়িত। একদিন রাইতে বাবারে কইছি কমিটির লগে রাইতে পাহাড়া দিমু। কিন্তু মার দিকে চাইয়া মিথ্যা কইতে পারি নাই। কইছি, ‘তুমি না কইর না। আমার লাইগা দোয়া কইর। আইজই মুক্তিযুদ্ধে যামু।’ মন খারাপ করছে। কিন্তু তবুও মা কইছে, ‘বাবা তুমি যাও। আমি দোয়া করমু।’’’

মুক্তিযুদ্ধে নিজের যোগ দেবার বিবরণ এভাবেই দিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন শাহ। তাঁর সঙ্গে আমরাও স্মৃতির পাতা উল্টে চলে যাই চুয়াল্লিশ বছর আগের সেই দিনগুলোতে।

হাসপাতাল থেকে প্রদত্ত শামসুদ্দিনের ডিসচার্জ সনদ
হাসপাতাল থেকে প্রদত্ত শামসুদ্দিনের ডিসচার্জ সনদ

‘‘নৌকায় সৈয়দ টুলা থেইকা আফজাল, সৈয়দ মিজানুর রহমান, ননী মোহন কর্মকারসহ তালশহর হইয়া আমরা কসবা তিনলাখ পীরের মাজারের কাছে আইসা নৌকা ছাইড়া দেই। সবাই কাপড় খুইলা নামি নদীতে। কথা ছিল, যদি দুইটা ফায়ার দেয় তাইলে ধানক্ষেতে লুকাইতে অইব। সার্চলাইটে যেন দেখতে না পারে। আবার একটা ফায়ার হইলেই তাড়াতাড়ি সিএমবির ব্রিজ পাড় হইয়া ইন্ডিয়া ঢুকতে অইব।’’

‘‘ও্ই পাড়ে গিয়াই মুক্তিফৌজের ট্রাক পাই। আমরা যাই কংগ্রেস ভবনে। একদিন পরে পাডায়া দেয় হাপানিয়া রিক্রুটিং ক্যাম্পে। সেখানে সবাইরে বুকে সিল মাইরা ফলিংয়ে পাঠায়। কিন্তু বয়স কম বইলা আমারে নেয় না। আমি বইসা বইসা কানতাছি। এমন সময় রিক্রুটিং অফিসার আইসা বলে, ‘এই ছেলে, তুমি কানতাছ কেন?’ আমি বলি, ‘সবাইরে নিলেন, আমারে নিলেন না? দেশে গেলে তো রাজাকারে ভর্তি হইতে অইব। আমি অহন কী করুম?’ তিনি বলেন, ‘তুমি তো বাচ্চা ছেলে, যুদ্ধ করতে পারবা না।’ আমার খুব রাগ হইল। বললাম, ‘না পারলে কি আর আইছি এহানে? নিয়া দেহেন।’ আমার মনোবল দেইখা তার মন গলে। ‘চল’, বইলাই আমার বাম ডেনা ধইরা তুইলা নেয়।’’

ভিডিও: আহত হওয়ার কথা জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন শাহ  

নবী নেওয়াজ শাহ ও জুলেখা খাতুনের পঞ্চম সন্তান শামসু। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন ‘রমজান’। বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার আলীনগর গ্রামে। অল্প কিছু জমিতে চাষবাস করে পরিবার চালাতেন বাবা। বড় ভাই ফরিদ উদ্দিন শাহ ছিলেন শিক্ষিত। ১৯৬৬ সালেই তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন। মূলত তাঁর ভালোবাসা, মমতা আর শাসনেই বড় হন শামসু। লেখাপড়ায় তাঁর হাতেখড়ি আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ৫ম শ্রেণি পাশের পর তিনি ভর্তি হন সরাইল অন্নদা হাই স্কুলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ওই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র।

সপরিবারে শামসুদ্দিন শাহ
সপরিবারে শামসুদ্দিন শাহ

স্কুলজীবনের স্মৃতির কথা জানালেন শামসু। মোতাবেল, মনির উদ্দিন, ইসমত আলী, এমএল খা, তাজুল, আহাদ, আফজাল ছিলেন তাঁর বন্ধু। হাডুডু, ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট খেলতেন সবাই মিলে। ওদিকে তখন চলছে আন্দোলন। শামসুদ্দিনের ভাষায়:

‘‘ছাত্রলীগের মজনু ভাই, মাহবুব রহমান, হালিম ভাই আমডার ক্লাসে গিয়া কইত, ‘ওই, চল মিছিল হইব।’ আমরা ক্লাস ভাইঙ্গা বাইরে চইলা যাইতাম। ছোট ছোট পতাকা লাঠিত বাইন্দা সারা সরাইলে মিছিল করতাম। স্লোগান দিতাম, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ‘ইয়াহিয়া-টিক্কা, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ ‘ঢাকা না পিণ্ডি, ঢাকা ঢাকা।’’’

পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের বিবরণ দিলেন তিনি। কাগজের মতো এখানে তৈরি অনেক জিনিস পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হত। সেখান থেকে এলে ওই জিনিসই আমাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হত। ওরা বাঙালিদের দেখতে পারত না। যোগ্যতা থাকলেও বাঙালিরা চাকরি পেত না। বড় বড় পদে ছিল ওরা। নেতারা এগুলো নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। সিলেট থেকে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাইলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে একবার ভাষণ দেন। তখন দূর থেকে তাঁকে দেখেন শামসুদ্দিন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি তিনি শোনেন রেডিওতে। তাঁর কাছে এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আর যদি একটি গুলি চলে… প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল… এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ওই ভাষণই শামসুর কিশোর মন ওলটপালট করে দেয়। সশস্ত্র পাকিস্তানি আর্মিদের ঠেকাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রস্তুত হন তারা।

কোথায় ট্রেনিং নিলেন?

তিনি বলেন: ‘‘মে মাস তহন শেষ। রিক্রুটিং ক্যাম্প থাইকা ট্রাকে কইরা আমডারে পাঠায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের লেবুছড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে। ওইখানে পাহাড়ের গাছ কাইটা তাঁবু গাড়া হইল। পাহাড় ভাঙতে এক্সপ্লোসিভ মাইনের বিষ্ফোরণ ঘটাইয়া রাস্তা বানানো হয়। ২১ দিনের ট্রেনিং। আমডারে গ্রেনেড, স্টেনগান, এসএলআর ও রাইফেল চালানো শিখায়। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিল কেবি সিং। একজনকে দুষ্টামি কইরা ডাকতাম, ‘মাংকি টিচার’। ফায়ারের সময় তিনি বলতেন, ‘খোল না, জোর না, ফায়ার।’ আমরা ছোট পোলাপাইন। কিন্তু ১০ রাউন্ডের মধ্যে ১০ রাউন্ডই টার্গেট হইত। এগুলা দেইখা ইন্ডিয়ান আর্মিরা মনে হয় ভয় পাইছিল।’’

 ‘‘আমডার পাশ থেইকা পাশের পাহাড়ে ওরা তহন তাঁবু গাড়ে। ফায়ারিংয়ে আমি আর আবুল কালাম আজাদ বেশি নাম্বার পাইছিলাম। আমডারে ওরা এলএমজি ইস্যু করে। কিন্তু ৩ নং সেক্টরের হেজামারায় কোরআন শপথের পর যখন দেশের ভেতর পাঠায়, তহন বয়স কম বইলা এলএমজি রাইখা রাইফেল ধরাইয়া দেয়। এই নিয়া খুব মন খারাপ অইছিল।’’

ট্রেনিংয়ের পরে আবদুল্লাহ ভুঁইয়ার নেতৃত্বে শামসুদের ৬১ জনকে পাঠানো হয় দেশের ভেতরে। তাদের এগার জনকে কমান্ড করতেন ননী মোহন কর্মকার। টু-আইসি ছিলেন সৈয়দ মিজানুর রহমান। চম্পকনগর বাজার হয়ে বেড়তলা গ্রামের কালামিয়া চেয়ারম্যানের বাড়িতে তাঁরা আত্মগোপন করেন। সেখান থেকেই অপারেশন করেন বলিবাড়ি, বিটঘর ও সরাইল এলাকায়।

এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গ্রেনেডের স্প্রিন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা শামসু। ডান পায়ের হাঁটুর নিচে একটি স্প্রিন্টার বের করা সম্ভব হলেও বাকি ৩টি রয়ে যায় শরীরের ভেতরে। পায়ের তিনটি রগ কাটা যায় তাঁর। এখনও পায়ের ব্যথায় মুষড়ে পড়েন মাঝে মাঝেই। সিড়ি বেয়ে উঠতে পারেন না একেবারেই।

শামসুদ্দিন শাহর মুক্তিযোদ্ধা সনদ
শামসুদ্দিন শাহর মুক্তিযোদ্ধা সনদ

কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনটিতে?

প্রশ্ন শুনে এই বীর আবেগে আপ্লুত হন। অতঃপর জানান রক্তাক্ত ওই দিনের আদ্যোপান্ত:

‘‘বেড়তলায় এক মাস্টারের বাড়িতে সরাইল থানা আপারেশনের পরিকল্পনা হয়। থানায় পাকিস্তানি আর্মিদের অনেক গোলাবারুদ ছিল। আমরা চাইছিলাম ওই গোলাবারুদ দখলে নিতে। রেইকি হয়। সে অনুসারে স্টপ পার্টি, রিজার্ভ পার্টি, ফায়ারিং পার্টির দিক ঠিক হয়। অ্যামবুশ পাতার নিয়মই ছিল এটা। আমি ছিলাম ফায়ারিং পার্টিতে।’’

‘‘৯ নভেম্বর, ১৯৭১। রাত তখন একটা। পজিশন নিতে গিয়েই রেইকির ভুল ধরা পড়ে। রেইকিতে ফায়ারিং পার্টিকে দেওয়া হয় থানার দক্ষিণ পার্শ্বে। কিন্তু সেখানে খুব লাইটিং করা ছিল। পিঁপড়া ঢোকারও সাধ্য নাই। এই জন্য আমরা চইলা যাই থানার পশ্চিম পাশে, কলার বাগানে। যেখানে ছিল স্টপ পার্টি। কথা ছিল, ননী মোহন গ্রেনেড ছুঁড়লেই ফায়ার ওপেন করতে হবে। আমরা তাই করি। ফলে ফায়ার আসার কথা ছিল দক্ষিণ দিক থেইকা, কিন্তু আসছে পশ্চিম দিক থেইকা। দুই পার্টি তখন এক জায়গায়। পুরা পরিকল্পনাই ভণ্ডুল অইয়া যায়। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছিল। থানার চারপাশে চোখা কইরা বাঁশ গাড়া। কিছু জায়গায় ছিল কাঁটাতারের বেড়াও। আমরা পোলাপাইন মানুষ। তর সইতাছিল না। হেরার সার্চলাইট প্রথম বার্স্ট করি। এরপর আমি আর মণি দৌড় মারি থানার দিকে।’’

শত্রুপক্ষ তখন থার্টি সিক্স গ্রেনেড চার্জ করে। হঠাৎ মাটি কেঁপে ওঠে। স্প্রিন্টার লেগে ডান পাটা চিনচিন করে উঠল শামসুদ্দিনের। প্রথমে ভাবলেন, বোম্বিং হচ্ছে। পায়ে যে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার লেগেছে তার খোঁজ নেই। মাত্র ১০০ গজ দূরে থানা। তিনি একটা গোবর টালে গিয়া পজিশন নিয়ে ফায়ার করেন। খানিক পরেই তাঁর মনে হল, পা জ্বলছে। হাত দিতেই দেখেন রক্ত বেরুচ্ছে সেখান থেকে। ফায়ার করতে করতে শরীর তখন ভীষণ দুর্বল। তাই ধীরে ধীরে পিছনে ব্যাক করেন।

শামসুদ্দিনের পায়ের একটা স্প্রিন্টার বের করে আনেন ওই এলাকার ইউনিসেফের চিকিৎসক ডা. হারুন। বাকি তিনটা ভেতরেই রয়ে যায়।

তবে ওই দিন মুক্তিযোদ্ধারা থানার দখল নিতে পারেননি। সহযোদ্ধা মনিরের তলপেটেও স্প্রিন্টার লেগেছিল। শামসুদ্দিনের পায়ের তালুতে সব সময় জ্বলত। মুক্তিযোদ্ধারা ওদের দুজনকে তেলিকান্দি নিয়ে যান। ওখানে বাড়ি বাড়ি লুকিয়ে রাখতেন। এ প্রসঙ্গে বললেন শামসুদ্দিন:

‘‘নবী, রাসেদ, মদন, মতি মিয়া অনেক কষ্ট করছে। গ্রেনেড জিনিসটা ছোট অস্ত্র। কিন্তু খুবই পয়জোনাল। আমার সমস্ত শরীর মাঝে মাঝেই পয়জন হইয়া যাইত। নৌকায় বইসা তহন পা পানিতে রাখতাম। একবার পায়ে গরম পানি পড়ছিল, কিন্তু ঠোসা তো দূরের কথা, কিছুই অনুভব করি নাই। এমন বিষাক্ত জিনিস গ্রেনেড। ৮ ডিসেম্বর সরাইল মুক্ত হইলে আমরা বাড়িতে ফিরা যাই। ঢাকায় মুভ করার সময় আমিন আহম্মেদ চৌধুরী, এজাজ আহম্মেদ চৌধুরী সরাইলে আমারে দেখতে আসেন।’’

পাকিস্তানি সেনাদের স্প্রিন্টার এখনও মুক্তিযোদ্ধার পায়ে, এটি মেনে নিতেই কষ্ট হয় মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন শাহর। তিনি বলেন:

‘‘কষ্ট তো লাগেই। কিন্তু দেশ তো স্বাধীন। যুদ্ধ করতে গেছি। আমরা তো আর বাঁচার জন্য যাই নাই। কখন দেশ স্বাধীন অইব কেউ কি জানত? নয় মাসে দেশ স্বাধীন অইব এইডা জানলে অনেকেই তো মুক্তিযুদ্ধে যাইত।’’

কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। এই সূর্যসন্তান অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত:

‘‘বঙ্গবন্ধুর সময় থাইকা ভাতা পাইতেছি। অথচ কালকাই ইন্টারভিউ দিয়া আসলাম। এইবার বলছি, ‘মুক্তিযুদ্ধ কইরা কি পাপ করছি! মৃত্যুর পরও কি আল্লাহ আমডার ইন্টারভিউ নিব?’ যাদের নেওয়া দরকার তাদের ইন্টারভিউ নিলেই তো হয়। আমডার তো লোভ লালসা বাইড়া গেছে। পচাঁত্তরের পর থাইকা তালিকায় ভুয়া বাড়তে থাকে। এর জন্য আমি দায়ী করি মুক্তিযোদ্ধা সংসদরেই।’’

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা শামসু বলেন:

‘‘অহন শেখ হাসিনা যেই নিরাপত্তার মইধ্যে থাকেন সেইটা যদি বঙ্গবন্ধু করতেন তাইলে কোনোদিনও তাঁরে মারতে পারত না। তিনি তো সেইটা চান নাই। তিনি মানুষের কাছে থাকতে চাইছেন। বঙ্গবন্ধু না থাকলে কি এই দেশ স্বাধীন অইত? বঙ্গবন্ধুবিহীন কি বাংলাদেশের জন্ম হইত? তাঁরে কোনো বাঙালি মারতে পারে এইটা তিনি চিন্তাও করেন নাই। আর এই বেইমান জাতি বঙ্গবন্ধুরে মাইরা ফালাইল! একটুও হৃদয় কাঁপল না! বেইমান জাতের ওই বংশধররা তো অহনও আছে এই দেশে।’’

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান রাজাকারদের নিয়ে সরকার গঠন করেন। বাতিল হয় দালাল আইন। ফলে বন্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর সময়ে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে রাজকারদের গাড়িতে। সেই সময়কার একটা ঘটনার কথা বলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

‘‘প্রধানমন্ত্রী হইয়া কলেজগেটে মুক্তিযোদ্ধা বিশ্রামাগারে এক অনুষ্ঠানে জিয়ার সঙ্গে আসে রাজাকার শাহ আজিজ। মামুন নামে এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা খাবার টেবিলে শাহ আজিজের প্লেট ভাইঙা দিছিল। কষ্ট নিয়া সেইদিন সে বলছিল, ‘মুক্তিযোদ্ধারা কখনও রাজাকাররে খাওয়াইতে পারে না।’ সেদিন জিয়া বলছিল, ‘সে আমার মেহমান। তোমরা না দিলেও আমি দিব।’ জিয়া সেদিন নিজ হাতে রাজাকার শাহ আজিজকে খাওয়া তুলে দিছিল। সে ও তার দলই জামাতকে প্রশ্রয় দিয়া মাথায় তুলছে। অহন তো মনে হয়, বিএনপির পরামর্শদাতা একমাত্র জামাত। বিএনপিরে অর্থ দেয় জামাত। জামাত ছাড়া কি বিএনপি চলতে পারব?’’

যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে দেশ পাননি সেটা মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এ দেশ ঠিকই সোনার বাংলা হত, ঘুষখোরদের দেশ হত না বলে মনে করেন তিনি। এটা সত্য যে, শেখ হাসিনা চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুর্নীতিবাজ আমলা আর রাজনীতিবিদরা যদি এক পথে হাঁটে তবে তো দেশ চালানো কঠিন। আবার বিএনপি-জামায়াতের আমলা আর পুলিশ-আর্মি কি নেই? ওরাও আছে। ওরা এখনও দেশটা পেছনে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। ওরা চায় সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিক, যেন সমস্যায় পড়ে। এদের ব্যাপারে সজাগ থাকা দরকার।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত কার্যকরের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন দাবি জানান জামায়াত নিষিদ্ধের। তাঁর মতে, ‘ওরা দেশ স্বাধীন হোক চায় নাই। ওরা কি চাইব এই দেশে শান্তি থাকুক? ওরা তো বাংলাদেশ চায় নাই। জামাত ক্ষতিকর। একটা বিষাক্ত পয়জন। খবরে দেহেন নাই ওগো কমান্ডো বাহিনী আছে। তাই জামাত নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।’’

দেশে মুক্তমনা লেখক ও প্রকাশক, পুলিশ এবং বিদেশি নাগরিক হত্যা প্রসঙ্গে এই যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তিনি বলেন:

‘‘আইএস হচ্ছে রাজনৈতিক চাল। সরকারের উচিত সবার নিরাপত্তা দেওয়া। একটার পর একটা হত্যা যদি চলতেই থাকে তাইলে আর নিরাপত্তা রইল কই? নিরাপত্তা বাহিনীর লোকদের উচিত কথা কম বইলা কাজ বেশি করা। আর বিচার করতে হবে কঠোর ও দ্রুত।’’

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে মুচকি হেসে এ্ই মুক্তিযোদ্ধা জানান, রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি থাকে তখন তিনি তৃপ্ত হন। আর খারাপ লাগে যখন দেখেন স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশে বুক ফুলিয়ে রাজনীতি করছে, আন্দোলন করছে মানুষ মেরে, তখন।

বুকভরা আশা নিয়ে পরবর্তী প্রজম্মের উদ্দেশে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন শাহ শুধু বললেন, ‘‘তোমরা সৎপথে সৎভাবে চইল। একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধীরা কী করছে সেই ইতিহাস জাইনা রাখবা। নিজেদের সুশিক্ষিত কইরা গড়ে তুল। মনে রাখবা, শিক্ষা ছাড়া এই দেশের পরিবর্তন সম্ভব হইব না।’’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৮ নভেম্বর, ২০১৫

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button