আদিবাসী

ভিন্ন জাতির ভিন্ন উৎসব

আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে নানা ধরনের উৎসব। যার অধিকাংশই তাদের সনাতন ধর্মবিশ্বাসকে ঘিরে। এ ছাড়া ঋতুভেদে এরা পালন করে নানা ধরনের অনুষ্ঠান। এসব উৎসব ও অনুষ্ঠানই তাদের মিলনমেলা।’

প্রথমেই জানাচ্ছি সাঁওতালদের একটি মিলনমেলার কথা। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এরা একত্রিত হয় বাহাপরব-এর অনুষ্ঠান ঘিরে। এটি তাদের আদি রীতি। সাঁওতালি ভাষায় বাহা মানে ফুল আর পরব মানে অনুষ্ঠান বা উৎসব। বসন্তে ফোটে শাল, শিমুল, পলাশ, মহুয়া, চম্পা ফুল। তখন বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয় প্রকৃতি। এ অনুষ্ঠানটির মধ্য দিয়ে সাঁওতালরা শালফুলকে বরণ করে নেয়। বাহাপরবের আগে এদের ফুল ব্যবহারের নিয়ম থাকে না।

বাহাপরব উৎসবটি তিনদিনের। তবে প্রথমদিনের অনুষ্ঠানই প্রধান। এ উৎসবের মূল উদ্দেশে জাহের এরা, গোসায় এরা, মরেকু, তুরইকু নামক দেবতা বা বোঙ্গার সন্তষ্টি লাভ।

পরবের একদিন আগে জাহের থান ও মাঝি থান নানাভাবে সাজানো হয়। নতুন সবুজ পত্রপল্লবে সেজে ওঠা ধরণী সাঁওতালদের কাছে পবিত্র কুমারী কন্যার প্রতীক। পরব শুরুর পূজায় দেবতাকে শাল ও মহুয়া ফুল উৎসর্গ করা হয়। অনুষ্ঠানে সাঁওতালরা শালফুলকে বরণ করে নেয় নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। এর পরেই সাঁওতাল মেয়েরা খোঁপায় রং-বেরঙের ফুল পরতে পারে।

গ্রামের এক প্রান্তে নির্দিষ্ট জায়গাতেই এ পূজার আয়োজন চলে। এ উপলক্ষে নির্দিষ্ট দিনে জাহের থানে শালগাছের খুঁটি দিয়ে অন্যান্য দেবদেবীর জন্য প্রতীক হিসেবে ছোট ছোট কয়েকটি চালাঘর তৈরি করা হয়। সাধারণত গ্রামের যুবকরাই জঙ্গল থেকে শালগাছ কেটে আনে এবং চালাঘর তৈরিতে সাহায্য করে। পূজার জায়গাটি ভালোভাবে নিকানো হয় গোবর দিয়ে। চালের গুঁড়ো দিয়ে আঁকা হয় আলপনা।

পূজা উপলক্ষে পুরোহিতকে উপোস থাকতে হয়। আগের রাত্রে তাকে থাকতে হয় মাটিতে। পূজার জন্য দেবতার আসন প্রস্তুত করেন তিনি। পূজার উপকরণ হিসেবে ফলমূল, চাউল, সিঁদুর, ধান, দূর্বা ঘাস আর  নানা সামগ্রী তিনি কুলায় সাজিয়ে রাখেন। একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেড়ে দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়া হয়।

পূজা উপলক্ষে পুরোহিত বা মহতকে তাঁর বাড়ি থেকে বন্দনা করে পূজাস্থলে নিয়ে আসা হয়। এ সময় তিনি উচ্চকণ্ঠে মন্ত্র পড়েন- জোহার এবে খানদো, মরেকু তুরেকু, আলেয়া আতু নুতুমতে ..।

অতঃপর বলি দেওয়া হয় কয়েকটি লাল মুরগি বা পশু। পুরোহিত গ্রামের কল্যাণের জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন। পরে বলি দেওয়া পশুর মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো হয়।

বাহারবে শালফুলকে ভক্তি করছেন এক সাঁওতাল
বাহারবে শালফুলকে ভক্তি করছেন এক সাঁওতাল

পূজা হয়ে গেলে বিকেলে গ্রামের পুরোহিতকে সঙ্গে করে সবাই দলবেঁধে গ্রামে ফিরে আসে। এ সময় মহিলারা পুরোহিতকে ঘিরে গোল হয়ে নাচতে থাকে। পুরোহিতের মাথায় থাকে শাল ফুলের ডালা। তার সঙ্গে এক যুবক মাটির কলসিতে এক কলসি পানি ভরে মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি চলতে থাকে। একেকটি বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গৃহস্থ নারীরা ওই পুরোহিত ও যুবকটির পা ধুইয়ে দেন। এরাও প্রত্যেক গৃহস্থকে ঝুড়ি থেকে পবিত্র শালফুল দেন। অনেক অঞ্চলে পূজাস্থল থেকেই গৃহস্থ নারীরা শালফুল গ্রহণ করেন পরম ভক্তির সঙ্গে। অতঃপর শুরু হয় আনন্দ নৃত্য। পুরুষরা বাজায় মাদল-ঢোল। তালে তালে ঝুমুর নৃত্যে ব্যস্ত হন আদিবাসী নারীরা। খোঁপায় শালসহ নানা রঙের ফুল ঝুলিয়ে, হাত ধরাধরি করে নাচেন সবাই। এভাবে বাহাপরবের প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়।

দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানকে বলে-বাহা বাস্কে (এক রাতের বাসি)। এদিন সাঁওতালরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এদের বিশ্বাস পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরোনো যত হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা আছে তা দূর হয়ে যায়। ফলে পরস্পরের সঙ্গে তৈরি হয় বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ। বাহাপরবের তৃতীয় দিনটিতে চলে শুধুই নানা আনন্দ আয়োজন। এ উৎসবে উদ্দীপনাময় গান ও নারী-পুরুষের সম্মিলিত বাহা দান ও জাতুর দান নাচ হয়ে থাকে।

বাহাপরবের সময় সাঁওতালি কণ্ঠে গানের সুর ওঠে-

তোকয় কোকে চিয়ে লেদা বীর দিসাম দঃ,

তোকয় কোকে টান্ডি লেদা বীর দিসাম দঃ.

(ভাবার্থ : কে কে ওই জঙ্গলে গিয়েছিল, কে কে ওই জঙ্গলটা পরিষ্কার করেছিল…)

শালফুলকে গ্রহণ না করলেও গারো আদিবাসীরা কৃষি ও জুমচাষকে কেন্দ্র করেই ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে। এটি কার্তিক- অগ্রহায়ণের অনুষ্ঠান। মূলত সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো হয় এ উৎসবের মাধ্যমে।

এ সময় গারোরা ঝোপঝাড় কেটে গোটা গ্রাম পরিষ্কার করে নেয়। গ্রামপ্রধান বা নকমার ঘোষণার পর পরই গোটা গ্রামে চালের গুঁড়ো দিয়ে বিশেষ ধরনের মদ তৈরির ধুম পড়ে যায়। উৎসবে যে যত বেশি মদ আনতে পারে, তার তত সুনাম হয়। এ উৎসবে প্রতিটি পরিবার জুম থেকে প্রাপ্ত ফসলের কিছু অংশ বাড়ির সামনে কলাপাতায় সাজিয়ে রাখে। সঙ্গে রাখে দ্বিখণ্ডিত চালকুমড়া। উৎসবের প্রথম দিনটি নাচগান আর মদপানের পর্ব। গারো মেয়েরা দকমান্দা পরে, মাথায় পাখির পালক গুঁজে দলবেঁধে নাচে। আর পুরুষরা তাল তুলে বাদ্য বাজায়। এদিন তারা গরু বা শূকর মেরে কিছু মাংস নিজেদের জন্য রেখে বাকিটা গ্রামের লোকদের বিলিয়ে দেয়। নাচ-গানের দলটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেচেগেয়ে গ্রামপ্রধানের বাড়িতে এসে থামে। ওই বাড়িতেই চলে খাওয়াদাওয়া। ওয়ানগালা উৎসবের মাধ্যমেই গারো যুবক-যুবতীর মনে ভালোবাসার রং লাগে। ওয়ানগালার সময় গারোরা গান ধরে-

ওয়ানগালা ওয়ানগালা আচিকরাং ওয়ানগালা

ডরং-এ চায়ে দক্কে দাম্মে মেসায়ে সালজং মিদ্দিনা রুগালা।

ও মিদ্দি সালজং, আচিকরাং হন্না নাংনা রাসং

ওয়াক-দো দক্কে আদুরু সিক্কে রুগালা আপফাসং….

সাঁওতালদের আরেকটি বড় উৎসবের নাম সোহরাই। সাহার শব্দ থেকে এসেছে সোহরাই বা সহরায় শব্দটি। যার অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। এ উৎসবে মূলত ধনসম্পক্তি ও গরু-বাছুর বৃদ্ধির জন্য বিশেষ আচারের মাধ্যমে বোঙ্গাদের (দেবতা) কাছে আবেদন জানানো হয়। প্রতি পৌষে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে ধুমধামের সঙ্গে আয়োজন চলে এ উৎসবের। উৎসব উপলক্ষে বিবাহিত মেয়েরা বাবার বাড়ি আসার সুযোগ পায়। তাই তারা সারা বছর অপেক্ষায় থাকে এ অনুষ্ঠানটির জন্য।

সোহরাই উৎসবের কোনো নির্ধারিত দিন নেই। পৌষ মাসে গোত্রের সবাই মহতের (প্রধান) উপস্থিতিতে নির্ধারণ করে উৎসবের দিনটি। সোহরাই উৎসবে গোত্রের মহতকে আগের দিন উপোস থাকতে হয়। তিনি উপোস ভাঙেন উৎসবের দিনে। সাতদিন ধরে চলে এই উৎসবটি।

প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতাকে সাঁওতালদের ভাষায় বলে উম। ওই দিন গ্রামের পুরুষরা জমায়েত হয় একটি মাঠের মধ্যে। সেখানে একটি জায়গায় আতপ চাউল দিয়ে ঘেরাও বা বাউন্ডারি তৈরি করা হয়। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে রাখা হয় সিঁদুর ও পাতার ঠোঙায় সামান্য হাড়িয়া বা চুয়ানি। অতঃপর মহত সেখানে মুরগি বলি দেন জাহের এরা, মারাঙ্গবুরু, মড়ৈকো, তুরুই কো, গোসাই এরা, পারগানা বোঙ্গা ও অন্যান্য বোঙ্গার উদ্দেশে। প্রতি ঘর থেকে দেওয়া হয় মুরগিগুলো। বলির পরে মাঠ থেকে সবাই নেচেগেয়ে চলে আসে মহতের বাড়িতে। এখানে মুরগি দিয়ে রান্না করা হয় খিচুড়ি। খাওয়া চলে হাড়িয়া আর চুয়ানি। মূলত মহতের বাড়িতে রান্নার মধ্য দিয়েই সাঁওতালদের সোহরাই উৎসবের শুভসূচনা ঘটে।

সোহরাইয়ের দ্বিতীয় দিনকে বলে ডাকা। ওই দিন প্রত্যেক পরিবার তাদের নিকট আত্মীয় ও মেয়ের জামাইকে দাওয়াত করেন। ফলে সবার বাড়িতে থাকে ভালো ভালো খাবার। তৃতীয় দিনটি চলে হাস্যরস আর আনন্দের মাঝে। এই দিনটিকে বলে খুনটাও। ওই দিন একটি বাড়ির উঠানে গোল দাগ দিয়ে দাগের ভেতরে খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয় একটি ষাঁড়। ষাঁড়ের শিং আর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তেলের পিঠা বা পাকওয়াল। অতঃপর প্রচণ্ড শব্দে মাদল বা ঢোল বাজানো হয়। মাদলের শব্দে ছটফট করতে থাকে ষাঁড়টি। এ রকম অবস্থাতেই দাগের বাইরে থেকে গোত্রের যুবকরা হুড়োহুড়ি করে ষাঁড়ের শিং ও গলা থেকে তেলের পিঠা নেওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে তেলের পিঠা ছিনিয়ে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে গোটা গ্রাম।

উৎসবের চতুর্থ দিনে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে সাঁওতালরা সবাই দলবেঁধে জাল আর পলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সাঁওতালরা এটিকে বলে হাকু কাটকোম। পঞ্চম দিনে পূর্বের চারদিনের ভুলত্রুটি সংশোধন ও পরের দিনগুলোর পরিকল্পনা করা হয়। এটিকে ঝালি বলে।

উৎসবের ষষ্ট দিনটি মূলত শিকারকেন্দ্রিক। সাঁওতালদের ভাষায় এটি সেন্দ্ররা। ওই দিন সকালে একদল সাঁওতাল তীর ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। আর গোত্রের অন্যরা মহতসহ গ্রাম পরিষদের পাঁচ সদস্যের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ-গান ও বিভিন্ন খেলা দেখিয়ে চাল তুলে তা জমা রাখে মহতের বাড়িতে। দিনশেষে শিকার থেকে ফেরা শিকারিদের নিয়ে চলে নানা প্রতিযোগিতা। একটি মাঠে একটি কলাগাছ দাঁড় করিয়ে তার ওপর রাখা হয় মহতের স্ত্রীর হাতের তৈরি তিনটি তেলের পিঠা। দূর থেকে তীর ধনুক দিয়ে যে কলাগাছ লাগাতে পারে সেই হয় বিজয়ী। বিজয়ীকে আবার পালন করতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। পাঁচটি ধনুক মাটিতে লম্বালম্বি সাজিয়ে বিজয়ীকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে এর চারদিক ঘুরে মাটিতে থাকা ধনুক একটি একটি করে তুলতে হয় এবং একই নিয়মে আবার মাটিতে সাজাতে হয়। অতঃপর কলাগাছটি গোত্র পরিষদের পাঁচ সদস্যের জন্য পাঁচ টুকরো করে বিজয়ী কাঁধে তুলে নেয়। এই অবস্থায় বিজয়ীকে সবাই কাঁধে তুলে হৈ-হুল্লোড় করে নিয়ে আসে মহতের বাড়িতে। এ সময় সবাইকে আপ্যায়ন করা হয় মুড়ি আর হাড়িয়া দিয়ে। অন্যদিকে শিকারগুলো দিয়ে চলে খিচুড়ি রান্না। খিচুড়ি আর হাড়িয়ায় ভাসতে থাকে গোটা গ্রাম। সপ্তম দিনটিতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভালোমন্দ খাবার খায়। এভাবে নানা আয়োজন আর ধুমধামের সঙ্গে শেষ হয় সাঁওতালদের সোহরাই উৎসব। সোহরাইয়ের সময় এরা গান ধরে-

      হাটিঞে দাঁড়ান মানাঞ মেরে

      পাতাঞ দাঁড়ান মানাঞ মেঃ

      সহরায়ওে কুল হি দাঁড়ান আলাম মানাঞা।

(ভাবার্থ : হাটে যেতে মানা করো। মেলা দেখতে বাধা দিও। কিন্তু সহরায়ের নাচ-গান করতে মানা করো না।)

সোহরাই উৎসবে নৃত্য
সোহরাই উৎসবে নৃত্য

আবার সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে দিনাজপুরের ভুনজারদের উৎসবগুলো বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। এরা চৈত্র মাসের শেষ দিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনকে পালন করে বিশেষ আচারের মাধ্যমে। ভুনজারদের ভাষায় এটি চৈতবিসিমা উৎসব। এ উৎসবে চৈত্র মাসের শেষ দিনে এরা বাসন্তী পূজা করে। ডায়রিয়া আর বসন্তের হাত থেকে মুক্তি পেতেই বহু আগে থেকে ভুনজাররা চৈত্রের শেষ সন্ধ্যায় ঠাকুরের কাছে পূজা দিয়ে আসছে। এ কারণেই এর নামকরণ হয়েছে বাসন্তী পূজা।

এ সময় ভুনজাররা একটি মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশে পূজা দেয়। কেউ কেউ ওই দিনই বলি দেয় মানতের  হাঁস, মুরগি কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে সবাই কালাইসহ নানা ধরনের ছাতু-গুড় খেয়ে আনন্দ-ফূর্তিতে মেতে ওঠে। বৈশাখের প্রথম দিন এরা দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি করে শিকারগুলো দিয়ে রান্না হয় খিচুড়ি। রাতভর চলে ভুনজারদের খ্যামটা নাচ আর হাড়িয়া খাওয়া।

অন্যদের তুলনায় লোহার আদিবাসীদের উৎসব ও আচারগুলো বেশ স্বতন্ত্র। দুর্গাপূজার সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যখন দেবী দুর্গার আরাধনা করে, তখন লোহাররা পালন করে বিশ্বকর্মা পূজা। এটিই তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ পূজায় এরা সারা বছরের কর্মভাগ্য সুপ্রসন্নের জন্য প্রার্থনা করে দেবতা ব্রহ্মার কাছে। পূর্বপুরুষদের নিয়ম মেনে এরা পূজার আগের রাতে উপোস থাকে দুধ আর আতপ চালের ক্ষীর খেয়ে। সকালে লোহার কাজের ভাথিটাকে (কয়লার আগুনে বাতাস দেওয়ার যন্ত্রবিশেষ) ধুয়ে পরিষ্কার করে লোহাররা। অতঃপর ভাথির গায়ে সিঁদুর ফোঁটা দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ভক্তি দিয়ে মুরগি বলি দেওয়া হয়। পূজা শেষে কলা, দুধ আর বাতাসা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের প্রসাদ খেয়ে এরা উপোস ভাঙে। পরে বলি দেওয়া মুরগি দিয়ে রান্না হয় খিচুড়ি। রাতভর চলে ঝুমের নাচ আর হাড়িয়া খাওয়া।

আবার বৈশাখের সকালে বাঙালির সঙ্গে মিলে যায় মুণ্ডা পাহানদের পান্তাভাত খাওয়ার আদি রেওয়াজটি। এ নিয়ে তাদের সমাজে প্রচলিত আছে একটি গান। পাহান আদিবাসীরা গায় –

হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই / পান্তা ভাত ভালোবাসি…

বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষ দিনেও পাহানরা পালন করে নানা আচার। ওই দিন এরা  বাড়িঘর পরিষ্কার করে একে অন্যের গায়ে কাদা আর রং ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাদা বা রং দেওয়া হয়, তাকেই খেতে দিতে হয় হাড়িয়া। পাহানরা বিশ্বাস করে, এতে তাদের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষ দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে বলা হয় সিরুয়া-বিসুয়া। এ ছাড়া পাহানরা রোগমুক্তির জন্য চৈত্র মাসেই আয়োজন করে চৈতালিপূজার। আগের রাতে উপোস থেকে পরের দিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙে পাহানরা। মঈনকাঁটা বা বেলগাছের নিচে মাটির উঁচু ঢিপি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধূপকাঠি টাঙিয়ে পান, সুপারি, দুধ, কলা, দূর্বা ঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া রেখে, ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরকে পূজা দেওয়া হয় চৈতালিপূজায়। এ সময় ঠাকুরের কৃপা লাভের আশায় বলি দেওয়া হয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে চলে আদিবাসীদের আনন্দনৃত্য।

এ ছাড়া তুরি আদিবাসীরা চৈত্র মাসের শেষ পাঁচদিন পালন করে চৈত্রাবালি অনুষ্ঠানের। শুরুর দিনে এরা ছাতুগুড় খেয়ে নাচ-গান করে। শেষদিন এরা বাড়িতে রান্না করে সাত পদের তরকারি। সাত পদ দিয়ে ভোজ সেরে এরা চৈত্রকে বিদায় জানায়। বৈশাখ শুরু হলেই তুরিরা বন্ধ করে দেয় মাছ-মাংস খাওয়া। পুরো এক মাস এরা শুধুই নিরামিষ খায়। এ সময় প্রতি রাতে তুরি পাড়াতে চলে কীর্তন। বৈশাখের শেষের দিকে প্রতি বাড়ি থেকে চাল তুলে একত্রে খিচুড়ি রান্না করে খায় তুরিরা। সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভের আশায় চলে এমন আচার।

ওরাওঁ আদিবাসীরা গবাদি পশুর মঙ্গলের জন্য একধরনের পূজার আয়োজন করে থাকে। এটিকে এরা সাহরাই উৎসব বলে থাকে। প্রতিবছর আশ্বিনের চাঁদের অমাবস্যার পরদিন চলে এ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। সাহরাই উৎসবের প্রথমদিনে ওরাওঁরা ঘরে, উঠানে, জমিতে, গোবর ফেলার জায়গাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। দ্বিতীয় দিন গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতিকে স্নান করিয়ে তেল ও সিঁদুর মাখানো হয়। লাঙল, জোয়ালসহ চাষাবাদের সব যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে মাখানো হয় সিঁদুরের রঙে। পূজার দিন নিয়ম অনুসারে গোয়ালঘরে চলে এই পূজা। পূজা শেষে প্রথমেই গরু-ছাগলকে খাওয়ানো হয় লবণ ও হলুদ ছাড়া কালাই। অতঃপর নিয়ম মেনে বাড়ির সবাইকে গোয়ালঘরে বসেই সেরে নিতে হয় খাওয়াদাওয়া। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই প্রদীপ জ্বালানো হয় গোয়ালঘরসহ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে। সাহরাই উৎসবের রাতে ওরাওঁ গ্রামগুলো থাকে আলোকোজ্জ্বল।

এ দেশে বসবাসরত আদিবাসীরা অধিকাংশই হতদরিদ্র। তা ছাড়া নানা বিষয়ে অবহেলা আর বঞ্চনার কশাঘাত তো রয়েছেই। তবু আদিবাসীদের কষ্টগুলো ভেসে যায় তাদের উৎসবের বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোতে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমের ঈদ আয়োজনে , প্রকাশকাল: ০৬ জুলাই ২০১৬

 

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button