পত্রিকায় ইন্টারভিউ

বঙ্গবন্ধু নিয়ে, সংবিধান নিয়ে, জয় বাংলা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই

“ মুক্তিযোদ্ধারাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। তাদের কাছে ছুটে যাই সত্যটি জানতে, যে সত্য আগুনের মতো সত্য, জীবনের বিনিময়ে সত্য।  নতুন প্রজন্ম যেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে পারে সেই চেষ্টাটি সর্বাগ্রে থাকে”

– সালেক খোকন, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, প্রাবন্ধিক, কালি ও কলম পুরস্কারপ্রাপ্ত

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন

সময়টা ২০১০/১১। গণকবর নিয়ে কাজ শুরু করেছি মাত্র। মনে আছে, দিনাজপুর গিয়েছিলাম একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেখানে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাশকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তার পা নেই। যুদ্ধে হারিয়েছেন। একটি কাঠের পা ব্যবহার করেন। মিস্ত্রীর কাজ করে সংসার চালান।। পরদিন খবরের কাগজে মন্ত্রী, এমপিসহ সকলের বক্তব্য ছাপা হয়। কিন্তু কৃষ্ণ কিশোর দাশের কোনো বক্তব্য ছাপা হয়নি। বিষয়টি আমাকে কষ্ট দেয়। মনে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কেউ শুনতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় করে, পুঁজি করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবি করে কেবল সুবিধাটি নিতে চায়। কৃষ্ণ কিশোর দাশের বয়স ষাটের ওপর। সেদিন মনে হয়েছিল এই মুক্তিযোদ্ধারা একদিন থাকবে না। তাদের গল্পগুলো, জীবনের কথাগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা উচিত। সেই চেষ্টা থেকেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ শুরু করি। ছুটে যাই দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গতকাল ‘দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’র সঙ্গে আলাপকালে ‘কালি ও কলম’ পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সালেক খোকন এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কেবল যুদ্ধ দিনের গল্প নয়, আরও অনেক কিছুই জানার আছে তার। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনও কিছু মানুষ বিভ্রান্তিছড়ায়, অহেতুক বিতর্ক করে। মুক্তিযোদ্ধারাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। তাদের কাছে ছুটে যাই সত্যটি জানতে, যে সত্য আগুনের মতো সত্য, জীবনের বিনিময়ে সত্য। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ, রাজাকার, ৭৫-এর কালো অধ্যায়- এসব বিষয়ে কী অভিমত ব্যক্ত করেন সেটিও জানবার এবং জানাবার বিষয় আমার। নতুন প্রজন্ম যেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে পারে সেই চেষ্টাটি সর্বাগ্রে থাকে।

এখন পর্যন্ত কতজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ জনেরও বেশি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে। সমতলের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি, আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও কাজ করেছি। আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমার গবেষণা গ্রন্থও রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের এই গবেষণায় কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা বা অনুদান পান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজটি আমার ভালোলাগা থেকে করি। এক ধরনের দায়বোধ থেকে করি। এখনও পর্যন্ত আমার ব্যক্তি উদ্যোগেই গবেষণা কাজটি করে যাচ্ছি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আমার সঙ্গে জড়িত নয়। এমনকি কোনো দলীয় সমর্থনও নেই। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সেকায়েপ প্রকল্পের জন্য আমার একটি বই অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করেছে। যেটি এক ধরনের কাজের প্রণোদনা বলে আমি মনে করি।

তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে তিনি বলেন, দ্বিধা-বিভক্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু নিয়ে, সংবিধান নিয়ে, জয় বাংলা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে, জয় বাংলার চেতনাকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক থেকে জীবনের সকল স্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে পারলেই তরুণরা উদ্বুদ্ধ হবে। পাশাপাশি স্বপ্নের বাংলাদেশের যাত্রা- তার লক্ষ্যে পৌঁছবে।

ইন্টারভিউটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমাদের অর্থনীতি-তে,  প্রকাশকাল: ৩ মে ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button