আদিবাসী

ঘটককে কেন বাঘে খায় না?

সাঁওতালদের যে কয়জন মহাপুরুষ তাঁদের স্বকীয় সংস্কৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে রামদাস টুডু রেস্কা অন্যতম। তিনি ছিলেন আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতির অক্লান্ত গবেষক। ১৮৫৪ সালের ২ অক্টোবর ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সিংভূম জেলার কাড়–ওয়াকাটা গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতার নাম সীতারাম টুডু এবং মাতা মঞ্জুদেবী। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

ছোটবেলা থেকেই রামদাস ছিলেন খুবই মেধাবী। তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পড়াশোনায় আগ্রহ থাকলেও পিতার মৃত্যুর কারণে মিডল ক্লাস পাস করার পর রামদাসের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বড় ছেলে হিসেবে পরিবারের হাল ধরতে তাঁকে নামতে হয় উপার্জনের পথে।

রামদাসের বাবা ছিলেন দামপাড়া এলাকার পারগাণা। পরবর্তী সময়ে রামদাসও ওই এলাকার মাঝি এবং পারগাণা উভয় দায়িত্ব লাভ করেন। এ ছাড়া ধলভূমগড় রাজ এস্টেটের খাজনা আদায় ও জমিজমার হিসাব রাখার দায়িত্বও ব্রিটিশ সরকার তাঁকেই দিয়েছিলেন।

সাঁওতাল সমাজে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক কাহিনী, গাঁথা ও গান প্রচলিত আছে। রামদাস দেখলেন, তা লিখে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। এই মৌলিক সাহিত্যভান্ডার সম্পর্কে সাঁওতালদেরও তেমন কোনো ধারণা নেই। তাই তিনি উদ্যোগী হন এই আদিবাসী সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাণ্ডারকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার। প্রায় ১২ বছর বিভিন্ন সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে ‍তিনি তা সংগ্রহ করতে থাকেন। অতঃপর ১৮৯৪ সালে কলকাতায় ছাপা হয় সাঁওতালি ভাষায় প্রথম গ্রন্থ-খেরওয়াল বংশা ধরম পুথি। কিন্তু তখনো সাঁওতালদের নিজস্ব লিপি ও টাইপের প্রচলন হয়নি। ফলে ওই গ্রন্থটি সাঁওতালি ভাষায় বাংলা হরফেই প্রকাশিত হয়েছিল।

তন্ময় হয়ে রামদাস টুডু রেস্কার কথা শুনছিলাম এক সাঁওতাল বৃদ্ধর মুখে। নাম তাঁর বিমল মার্ডি। রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার ছাতনি পাড়ায় বসে আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। রামদাসের কথা শেষ হতেই আমাদের দিকে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে বলেন- ‘ঘটককে কেন বাঘে খায় না?’

প্রশ্ন শুনে আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাই। পাশে বসা বন্ধু জুয়েল। সেও মাথা চুলকায়। কিন্তু তবুও উত্তর মিলে না। আমাদের অবস্থা দেখে বিমল মুচকি হাসেন। অতঃপর শুরু করেন খেরওয়াল বংশা ধরম পুথির ঘটক কাহিনীটি।

বিয়ের ঘটক থাকে দুজন। একজন কনেপক্ষের, অন্যজন বরপক্ষের। একবার এক বিয়ের প্রস্তাবে কনের বাড়ি ছিল ধাড় দেশে। আর বরের শিলদাতে। বড় একটি জঙ্গলের পাশেই একত্রে এসে মিশেছে ধাড় দেশের নদী ও শিলদার নদীটি। কনেরবাড়ি থেকে বরের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথটি ছিল সে জঙ্গলের ভিতর দিয়েই। সে জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব হতো প্রায়ই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটি ছোট্ট নদী।

একবার কনেপক্ষের ঘটক বরের বাড়িতে যাচ্ছিল সে নদীর ধার দিয়ে। দূর থেকে ঘটককে যেতে দেখেই একটি বাঘিনী হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ল তার সামনে। হঠাৎ বাঘিনীকে দেখে ঘটকের প্রাণ যায় যায়। বাঘিনী প্রথমে ঘটককে দুই থাবার মধ্যে নিয়ে খেলা করতে লাগল। এটাই বাঘদের নিয়ম। শিকারকে সঙ্গে সঙ্গে খায় না তারা।

সে সময় বাঘিনী ঘটককে জিজ্ঞেস করল, কে হে তুমি? কোথায় যাচ্ছিলে?

বাঘিনীর কথায় ঘটক একটু সাহস পেল। সে ভয়ে ভয়ে বলল, মহারানী, আমি ধর্মের কাজে যাচ্ছিলাম, আমাকে তুমি মেরো না।

ঘটকের উত্তরে বাঘিনীর বেশ কৌতূহল হলো। সে বলল, কেমন ধর্মের কাজ হে?

ঘটক বলল, আমি দুটি পরিবারকে একত্রিত করি। দুজন আলাদা লোককে একজনে পরিণত করি।

বাঘিনী বলে, কেমন করে?

ঘটক উত্তরে বলে, যার বউ নেই তাকে বউ জোগাড় করে দেই আর যার স্বামী নেই তার জন্য স্বামী জোগাড় করে দেই।

ঘটকের উত্তর শুনে বাঘিনীর নিজের কথা মনে হয়। সে বলে, যদি তাই হয়, আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও। সে দুঃখ করে বলে,  ১২ বছর আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমি একা।

সুযোগ বুঝে ঘটক বাঘিনীর কথায় রাজি হলো। সে বলল, তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মহারানী। ঘটককে বিশ্বাস করে বাঘিনী তাকে ছেড়ে দিল।

ঘটকের ছিল তীক্ষ্ম বুদ্ধি। ছাড়া পেয়ে সে গেল সেই গ্রামে। অনেক খুঁজে গ্রামের ভেতর পেল একটা দোকান। দোকান থেকে সে দুটো নতুন বস্তা কিনে নিল। তা সেলাই করার জন্য কিনল একটি সুই ও দড়ি। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িতে থাকত দুজন  বুড়ো ও বুড়ি। গ্রামের যে কোনো বিয়েতে তারাই হলুদ ও পাতা বাছাই করে দিত।

ঘটক সে বাড়িতে গিয়ে খুশি মনে তাদের বলল, যাও, একটু হলুদ বেটে এবং পাতা বেছে পরগাছার সরু কাঠি দিয়ে শালপাতার চার কোণের খালা তৈরি কর। সেই খালায় দিয়ে দাও বাটা হলুদ ও তেলটুকু। বুড়ো-বুড়ি তাই করল।

ঘটক এবার নতুন বস্তা, সুই, শনের দড়ি ও তেল-হলুদ নিয়ে ফিরে গেল বাঘিনীর কাছে।

বাঘিনীকে সে বলল, মাহারাণী, তোমার জন্য পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।

শুনে বাঘিনী তো মহা খুশি।

ঘটক বলল, যদি আমাকে বিশ্বাস কর এবং বিয়ে করতে চাও তবে তুমি এই বস্তার ভিতর প্রবেশ করো।

বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথা মতো বস্তার ভিতর ঢুকে পড়ল। ঘটক তখন সেই তেল-হলুদের খালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তাই করল।

ঘটক এবার  সেই শনের দড়ি দিয়ে ঐ বস্তাটিকে ভালো করে সেলাই করল। অতঃপর বাঘিনীকে বলল, মহারাণী, নড়াচড়া করো না। তোমাকে এই নদীর জলে নামিয়ে দিচ্ছি। এই জলের নিচেই তোমার স্বামী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যখন তোমাকে নদীর জল থেকে তুলে নেবে তুমি তখন হাতে থাকা তেল-হলুদ তার মুখে মাখিয়ে দিও।এ কথা বলেই ঘটক বস্তাটিকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল।

সে দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীতেও বান দেখা দিয়েছে। অন্য একটি গ্রামে ছিল একটি বাঘ। তার স্ত্রীকেও মানুষেরা মেরে ফেলেছে ১২ বছর আগে। সেই বাঘটি প্রতিদিন বান দেখতে নদীর ধারে এসে বসে থাকত। মাঝে মাঝে বানের জলে গরু, ছাগল, মহিষ ভেসে আসলেই নদী থেকে সে তা তুলে এনে খেত। সেদিনও সে নদীর ধারে বসেছিল। একটি বস্তা ভেসে আসতে দেখেই সে জলে নেমে সেটাকে উপরে তুলে আনল। দাঁত দিয়ে বস্তাটি ছিঁড়তে যাবে ওমনি বস্তার ভিতর থেকে বাঘিনীর গর্জন।

বাঘ তাড়াতাড়ি বস্তাটি ছিঁড়ে ফেলল। ঠিক তখনই বাঘিনী  মনের আনন্দে আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো। সে হাতের তেল-হলুদ বাটা ভালো করে মাখিয়ে দিল ওই পুরুষ বাঘটির মুখে এবং তাকে চুমু খেতে থাকল। অতঃপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুখে- শান্তিতে কাটতে থাকল বাঘ-বাঘিনীর জীবন।

এ কারণেই আদি থেকেই সাঁওতালরা মনে করে বাঘেরা ঘটকদের ওপর খুব খুশি। তাই ঘটককে কখনো বাঘেরা খায় না।

কথার পিঠে কথা চলে। কিন্তু এক সময় একটি জায়গায় এসে তা থেমে যায়। রামদাস সাঁওতালদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি ও আচার ধরে রাখতে এক সময় গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তখন সাঁওতালদের ছিল না কোনো আর্থিক দৈন্য। কিন্তু সাঁওতাল সমাজে আজ বাসা বেঁধেছে সীমাহীন দারিদ্র্য। বৈষম্য ও সংখ্যাগুরু জাতির অত্যাচার তাদের নিত্যসঙ্গী। টিকে থাকার লড়াইয়ে অনেকেই তাই ত্যাগ করেছে পূর্বপুরুষদের জাতধর্মকে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে সাঁওতালদের মৌলিক সংস্কৃতিগুলো। কালপ্রবাহে এভাবেই কি হারিয়ে যাবে এক একটি আদিবাসী জাতি!

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি.কমে, প্রকাশকাল: ০৪ জুন ২০১৬, ১৫:২৫

 

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button