আদিবাসী

সমতলের নৃগোষ্ঠীদের বর্ষবরণ

সাঁওতালদেরবাহাপরব বৈশাখ

আদি আচার পালনের মাধ্যমে সাঁওতালরা যেমন নতুন বছরকে বরণ করে, তেমনি চৈত্রের শেষে বাহাপরব উৎসব উদ্যাপন করে ধুমধামের সঙ্গে। দিনাজপুরের মহেশপুর গ্রামে সাঁওতালদের বাহাপরব ও বৈশাখ উদ্যাপন চোখে পড়ার মতো।

সাঁওতালদের ভাষায় ‘বাহা’ মানে ফুল আর ‘পরব’ মানে অনুষ্ঠান বা উৎসব। শালফুলকে সাঁওতালরা বলে ‘সারজম বাহার’। বাহাপরবের অনুষ্ঠানে তারা শালফুলকে বরণ করে নেয় কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে।

এই উৎসবে গোত্রপ্রধান উপোস অবস্থায় পূজা দেন বোঙ্গার (দেবতা) সন্তষ্টি লাভের জন্য। একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেঁথে দেওয়া হয়। কুলার মধ্যে রাখা হয় চাল, সিঁদুর, ধান, দূর্বাঘাস আর বেশ কিছু শালফুল। উৎসবের প্রথম দিন পূজার মাধ্যমে প্রথমে বলি দেওয়া হয় মুরগি। তারপর সাঁওতাল নারীরা শালফুল গ্রহণ করে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। একই সঙ্গে ওই দিনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলি করা হয় শালফুল। যে ফুল বিলি করে তাকে পা ধুইয়ে বাড়ির ভেতরে নেওয়া হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস, এভাবে ফুলরূপে দেবতা বা বোঙ্গাই তাদের ঘরে প্রবেশ করে।

দ্বিতীয় দিন সাঁওতালরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাদের বিশ্বাস, পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে পুরনো যত হিংসা, বিদ্বেষ, শক্রতা আছে তা দূর হয়ে যায়।

বাহাপরবের তৃতীয় দিনটিতে চলে নানা আনন্দ আয়োজন। খোঁপায় শালসহ নানা রঙের ফুল ঝুলিয়ে, হাত ধরাধরি করে নাচে নারীরা। কণ্ঠ আকাশে তুলে তারা গায়— ‘তোকয় কোকে চিয়ে লেদা বীর দিসাম দঃ, তোকয় কোকে টান্ডি লেদা বীর দিসাম দঃ…’

বৈশাখের প্রথম প্রহরে সাঁওতালরা পুরনো বছরের পান্তা খেয়ে নতুন বছরের শুভ সূচনা করে। এরপর একদল সাঁওতাল তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। আরেকটি দল নদীতে ছোটে মাছ মারতে। মাছ মারাকে সাঁওতালরা বলে ‘হাকু গোজ চালাও’। নারীরা বাড়ি বাড়ি তেলের পিঠা ও চিতই পিঠা তৈরি করতে থাকে। দুপুরে নানা পদ দিয়ে ভোজ সেরে নেয়। একসময় সাঁওতালরা বৈশাখে ২০ পদের রান্না দিয়ে ভোজ সারত। বিকেল থেকে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে আয়োজন চলে ঝুমুর নাচের। সাঁওতাল নারীরা দল বেঁধে হাত ধরাধরি করে নেচে-গেয়ে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। রাতভর চলে প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া।

যেতে চাইলে

সাঁওতাল গ্রামটি দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার মহেশপুর। ঢাকার কল্যাণপুর ও আসাদগেট থেকে দিনাজপুরের একাধিক বাস ছাড়ে। ভাড়া (নন-এসি ও এসি) ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকা। দিনাজপুর থেকে বাসে বোচাগঞ্জে এবং সেখান থেকে অটোরিকশায় যাওয়া যাবে মহেশপুর।

ওরাঁওদের চৈত্রবৈশাখ

সংখ্যার দিক থেকে সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতালদের পরেই ওরাঁওদের অবস্থান। দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাদের বাস। তারা এসেছিল বিহারের ছোট নাগপুর অঞ্চল থেকে। দিনাজপুরের বহবলদীঘির ওরাঁও গ্রামের নিপেন টিগগাও জানালেন তেমনটাই। ওরাঁও গানেও সেটার সত্যতা পাওয়া যায়—

‘নাগপুরের নাগরাজা

নাভালায় বাত্তালানে

আদিবাসী হামিহেকী

ওরাঁও জাতি…’

ওরাঁওরা আদি থেকেই কৃষিজীবী। তাদের উৎসবগুলো আবর্তিত হয় ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বৈশাখের প্রথম প্রহরে তারা দল বেঁধে শিকারে বের হয় তীর-ধনুক নিয়ে। কিন্তু তার আগেই পূজা দেয় বাঘমন্ত্রীকে। তাদের বিশ্বাস, এটা না করলে শিকার তো মিলবেই না; বরং পড়তে হবে জীবননাশের মতো বিপদে। এ কারণেই তারা বনে ঢোকার আগে মাটিতে তীর-ধনুক রেখে, জল ছিটিয়ে দূর্বাঘাস ও আতপ চাল রেখে ধূপ জ্বালিয়ে বাঘমন্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য পূজা দেয়। বিকেলে শিকার থেকে ফিরলে শিকারগুলো দিয়ে রান্না করা হয় খিচুড়ি। রাতভর চলে নাচ-গান আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া পান। এভাবে বছরের প্রথম দিনটিকে তারা দলবদ্ধতা ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে নানা আচার পালনের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করে।

ওরাঁওরা অনেক গাছের পাতা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কেউ কেউ অভাবের সময় শুধু গাছের পাতা বা মূল খেয়ে বেঁচে থাকে। চৈত্র মাসে তারা গ্রাম রক্ষাকারী আত্মাকে স্মরণ করে পূজা-অর্চনা করে। এ সময় প্রতিটি পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করে কিছু খাদ্য ভোগ হিসেবে তুলে রাখে। পরিবারের সবার সুস্থতা কামনা করাই এর উদ্দেশ্য। কোনো কোনো পরিবার এ সময় মোরগও বলি দেয়। এই উৎসব চলাকালে নাচ-গানের মাধ্যমে প্রতিটি ওরাঁও পরিবার ঘরের প্রবেশমুখে প্রচুর পানি ঢালে এবং ঘরের চালে ঝুলিয়ে দেয় শালফুল। বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষ দিনও থাকে নানা আচার। ওই দিন বাড়িঘর পরিষ্কার করে একে অপরের গায়ে কাদা আর রং ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাদা বা রং দেওয়া হয় তাকেই খেতে দিতে হয় প্রিয় পানীয় হাড়িয়া। তাদের বিশ্বাস, এতে বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হয়।

যেতে চাইলে

বহবলদীঘির ওরাঁওদের গ্রামটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও আসাদগেট থেকে দিনাজপুর যাওয়ার একাধিক বাস আছে। ভাড়া (নন-এসি ও এসি) ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকা। দিনাজপুর থেকে অটোরিকশায় যাওয়া যাবে বহবলদীঘি। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা। এ ছাড়া উল্লিখিত জেলাগুলোতেও ওরাঁওদের চৈত্র-বৈশাখের উৎসবগুলো দেখতে যেতে পারেনপাহানদেরসিরুয়াবিসুয়া চৈতালি

গবেষকরা মনে করেন, মুণ্ডা জাতির পুরোহিতরাই ‘পাহান’ নামে পরিচিত ছিল। অবশ্য বাংলাদেশে বসবাসরত পাহানরা নিজেদের আলাদা আদিবাসী জাতি হিসেবেই পরিচয় দেয়। এদের পূর্বপুরুষরা এসেছিল ভারতের ছোট নাগপুর ও রাঁচী থেকে। এদের বেশির ভাগের বাস উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, বগুড়া ও নওগাঁয়।

পাহানরা মূলত সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। একসময় তারা প্রতিমাপূজা করত না, কিন্তু এখন হিন্দু রীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বৈশাখের আদি রীতি অনুসারে তারা নতুন বছরের প্রথম সকালে পান্তা খায়। কেন পান্তা খান—এমন প্রশ্নের উত্তর মেলে ৭০ বছর বয়সী শ্যামল পাহানের মুখে। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের শালবনের ভেতরের পাহান গ্রামে। গানের সুরে তিনি বলেন—

‘হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই

পন্তা ভাত ভালোবাসি…’

ওই দিন দুপুরে ভাতের সঙ্গে তারা ১২ ভাজা অর্থাৎ ১২ পদের তরকারিও খায়। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে আয়োজন করে নাচ-গানের আসরের। পহেলা বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষ দিনও পাহানরা নানা আচারের আয়োজন করে। ঐ দিন পাহানরাও ওরাঁওদের মতো  একই নানা আচার-অনুষ্ঠান করে থাকে।

চৈত্রের শেষ দিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে পাহানরা বলে ‘সিরুয়া-বিসুয়া’।

এ ছাড়া পাহানরা চৈত্র মাসেই আয়োজন করে চৈতালি পূজার। রোগ থেকে মুক্তি পেতে ঠাকুরের কৃপালাভই এই পূজার উদ্দেশ্য। এ পূজায় আগের রাতে উপোস থেকে পরদিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙা নিয়ম। বেলগাছের নিচে মাটির উঁচু ঢিবি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধূপকাঠি টাঙ্গিয়ে, পান-সুপারি, দুধ-কলা, দূর্বাঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া দিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরকে পূজা দেওয়া হয় চৈতালি পূজায়। একই সঙ্গে বলি দেওয়া হয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঁঠা। পূজা শেষে খাওয়া হয় খিচুড়ি। রাতভর চলে হাড়িয়া পান আর নাচ-গান।

যেতে চাইলে

দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী শালবন এলাকা কালিয়াগঞ্জ। ঢাকার কল্যাণপুর ও আসাদগেট থেকে দিনাজপুরের একাধিক বাস ছাড়ে। ভাড়া (নন-এসি ও এসি) ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকা। দিনাজপুর থেকে অটোরিকশায় যাওয়া যাবে কালিয়াগঞ্জে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। এ ছাড়া দিনাজপুর ছাড়াও নওগাঁয়ও পাহানদের চৈত্র-বৈশাখের সিরুয়া-বিসুয়া ও চৈতালি পূজা দেখতে যেতে পারেন।

তুরিদেরচৈতাবালি বৈশাখ

তুরিদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতের দুমকা থেকে। ঝুমটা নাচের গানেও পাওয়া যায় দুমকার কথা। দিনাজপুরের লোহাডাঙ্গার তুরিদের মুখে শোনা গানটি এমন—

‘কিনে দেব ঝুমকা/ত লেয়ে যাব দুমকা’।

ভাবার্থ : কিনে দেব ঝুকমা, তারপর নিয়ে যাব দুমকা।

এদের উৎসব ও আচারগুলো খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ।

লোহাডাঙ্গা ছাড়াও দিনাজপুরের রামসাগর, বোটের হাট, জামালপুর, পুলহাট, খানপুর, মহেশপুর, বড়গ্রাম, সাদিপুর, মুরাদপুর, হাসিলা, গোদাগাড়ি আর নাজিরগঞ্জে রয়েছে তুরিদের বাস। এ ছাড়া রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাটেও রয়েছে তুরি আদিবাসীদের বসতি। নিজেদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও তারা আঁকড়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের জাতধর্ম আর আদিবাসী সংস্কৃতি। তারা পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে বরণ করে নিজেদের আদি রীতিতেই।

বৈশাখের আগে তুরিরা চৈত্র মাসের শেষ পাঁচ দিন ‘চৈতাবলি’র অনুষ্ঠান করে। শুরুর দিন থেকে তারা ছাতু-গুড় খেয়ে নাচ-গান করে। চৈত্রের শেষ দিন বাড়িতে রান্না করে সাত পদের তরকারি। সাত পদ দিয়ে ভোজ সেরে বিদায় দেয় চৈত্রকে। বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে নাচ-গানের পর্ব।

চৈত্রসংক্রান্তির পরের দিনই বৈশাখ। বৈশাখ শুরু হলেই তুরিরা বন্ধ করে দেয় মাছ-মাংস খাওয়া। পুরো এক মাস তারা শুধুই নিরামিষ খায়। প্রতিদিন মাটির প্রদীপ হাতে তুলসী ঠাকুরকে ভক্তি দেয়। তুরি ভাষায় এটি ‘সান্দবাতি’। প্রদীপ জ্বালিয়ে পানি ছিটিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে ভক্তি দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ঠাকুরের কাছে স্বামী, সন্তান আর সবার জন্য মঙ্গল কামনা। তাদের ভাষায় প্রার্থনাটি হচ্ছে এমন—

‘তুলসী তুলসী মাধবীলতা/কৃষ্ণ ঠাকুরক থানম/সন্ধ্যাবাতি দেলিও’।

ভাবার্থ : তুলসী তুলসী মাধবীলতা, তুলসীর থানে দিয়েছি কৃষ্ণের বাতি।

বৈশাখের পুরো মাস রাতে তুরিপাড়ায় কীর্তন চলে। শুধু পুরুষরাই এ কীর্তন করতে পারে। সৃষ্টিতত্ত্ববিষয়ক কীর্তনই তখন বেশি গাওয়া হয়। এ সময় কীর্তন শুনতে দূর-দূরান্ত থেকে নানা বিশ্বাসের আদিবাসীরাও ভিড় জমায় তুরিপাড়ায়। বৈশাখের শেষের দিকে তারা প্রতি বাড়ি থেকে চাল তুলে একত্রে খিচড়ি (খিচুড়ি) রান্না করে খায়। ওই দিন আয়োজন করা হয় গান আর আদিবাসী নৃত্যের। এভাবে বছরের প্রথম দিন থেকেই সৃষ্টিকর্তার কৃপালাভের আশায় চলে তুরিদের আদি আচারগুলো।

যেতে চাইলে

লোহাডাঙ্গার তুরি গ্রামটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও আসাদগেট থেকে দিনাজপুর যাওয়ার একাধিক বাস আছে। ভাড়া (নন-এসি ও এসি) ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকা। দিনাজপুর থেকে অটোরিকশায় যাওয়া যাবে লোহাডাঙ্গায়। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা। এ ছাড়া উল্লিখিত জেলাগুলোতেও তুরিদের ‘চৈতাবালি’ ও বৈশাখের আচার দেখতে যেতে পারেন।

ভুনজারদেরচৈতবিসিমা

চৈত্র মাসের শেষ দিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি ভুনজাররা উদ্যাপন করে বিশেষ আচারের মাধ্যমে। তাদের ভাষায় এটি ‘চৈত-বিসিমা’ উৎসব। এ উৎসবের অংশ হিসেবে তারা চৈত্র মাসের শেষ সন্ধ্যায় ‘বাসন্তী পূজা’ করে। এটি কেন করা হয়, তার উত্তর মেলে দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী বহবলদীঘির ভুনজার গ্রামের প্রধান বাতাসু ভুনজারের মুখে।

একসময় আদিবাসী গ্রামগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। তখন ডায়রিয়া আর বসন্ত রোগে মারা যেত শত শত মানুষ। এই রোগ দুটি থেকে মুক্তি পেতেই ভুনজাররা মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারিকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের পূজা করে। বসন্ত রোগ থেকে মুক্তির পূজা বলেই এর নামকরণ হয়েছে ‘বাসন্তী পূজা’। কেউ কেউ এই দিনই বলি দেয় মানতের হাঁস, মুরগি কিংবা পাঁঠা। এর আগে চৈত্রের শেষ শুক্রবার তারা উপোস থাকে। উদ্দেশ্য ঠাকুরের সন্তুষ্টি ও রুটি-রুজি বৃদ্ধি। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধু ফলমূল আর দুধ। বাসন্তী পূজা শেষে ভুনজাররা কলাইসহ নানা ধরনের ছাতু-গুড় খেয়ে আনন্দফুর্তিতে মেতে ওঠে। রাতভর চলে নাচের আসর।

বৈশাখের প্রথম দিন খুব ভোরে ভুনজাররা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। এটিই তাদের আদিবাসী রীতি। শিকারের আদি অস্ত্র তীর-ধনুক। তবে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে তারা কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা খায়। তাদের বিশ্বাস, পান্তা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও তারা কষ্ট পাবে না। পান্তার পানি বছরজুড়ে তাদের শরীর ঠাণ্ডা রাখবে।

শিকার থেকে ফিরে ওই দিন বিকেলেই শিকারগুলো দিয়ে তারা একসঙ্গে খিচুড়ি রান্না করে। রাতভর চলে নাচ-গান ও হাড়িয়া পান। আর ভুনজারদের কণ্ঠে ভেসে আসে—

‘পানের ডেলা পানে রইল

সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল, মা

সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল

হে সেবেল, সেবেল, ওয়াহাগলে, ওহাগলে, হে…’

গানের তালে চলে খ্যামটা নাচ। একদল আদিবাসী নারী হাত ধরাধরি করে নানা ভঙ্গিমায় নাচে। নাচ-গান আর নানা আচারে ভুনজাররা বরণ করে নেয় নতুন বছরকে।

যেতে চাইলে

বহবলদীঘির ভুনজার গ্রামটি দিনাজপুরের বিরল উপজেলায়। ঢাকার কল্যাণপুর ও আসাদগেট থেকে দিনাজপুরের একাধিক বাস ছাড়ে। ভাড়া (নন-এসি ও এসি) ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকা। দিনাজপুর থেকে অটোরিকশায় যাওয়া যাবে বহবলদীঘি। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কন্ঠের বিশেষ ম্যাগাজিন ‘রঙিলা বৈশাখ’ এ, প্রকাশকাল: ১৩ এপ্রিল, ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button