আদিবাসীকলাম

বৈসাবি, তাই সরগরম গণমাধ্যম

পাহাড়ে চলছে ‘বৈসাবি’ উৎসব। চাকমারা এ উৎসবকে বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই, তংচঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু বলে। ত্রিপুরাদের বৈসুক থেকে ‘বৈ’, মারমাদের সাংগ্রাইং থেকে ‘সা’, আর চাকমাদের বিজু থেকে ‘বি’–এভাবে তিনটি নামের আদ্যক্ষর এক করে হয় ‘বৈ-সা-বি’।

সরকারি সিদ্ধান্তে বিভিন্ন দফতরে কর্মরত আদিবাসীরা গতবছর থেকে ২৯ চৈত্র থেকে ২ বৈশাখ পর্যন্ত ৪দিন ঐচ্ছিক ছুটি ভোগের অধিকার পায়। ফলে এই প্রাণাৎসবে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা, নতুন আনন্দ। চলুন প্রথমে জেনে নিই উৎসবটির আদ্যোপান্ত।

ত্রিপুরাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রধানতম উৎসব হলো বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিতে এরা পালন করে এ উৎসব। চৈত্রের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনটিকে এরা ‘হারি বুইসুক’ আর শেষ দিনটিকে বলে ‘বুইসুকমা’। আর নববর্ষের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘বিসিকাতাল’।

প্রথম দিন আদিরীতি অনুসারে ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তোলে, ফুল দিয়ে ঘর সাজায় ও কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নেয়। অতঃপর ঝুড়িতে ধান নিয়ে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। ওইদিন ভালো ও পরিষ্কার কাপড়চোপড় পরে আদিবাসীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এ সময় ঘরে ঘরে বিচিত্র ধরণের পিঠা আর মদ পান করানো হয়। বৈসুক উৎসব শুরু হলে ‘গরাইয়া’ নৃত্যর দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে। নৃত্যদলের একজনের কাঁধে বাঁধা শূলে থাকে একটি খাদি। ঘরের উঠোনে এ শূলটি বসানো হলে, ওই ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। নৃত্য শেষে প্রতিবাড়িতেই শিল্পীরা সুর করে ওই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। তখন মদ, মুরগির বাচ্চা ও চাল তুলে দেওয়া হয়। এভাবে প্রত্যেক বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে ত্রিপুরারা।

আবার ‘তাইংখুং’ মারমা পঞ্জিকা বছরের প্রথম মাস। এ মাসেই উদযাপিত হয় মারমাদের নববর্ষবরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। সংক্রান্তি শব্দ থেকেই এসেছে ‘সাংগ্রাইং’ শব্দটি। মারমাদের বিশ্বাস, এ পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক ধর্মীয় দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। তাই স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় সাংগ্রাইং উৎসব। যে ক’দিন দেবী অবস্থান করবেন সে ক’দিনই চলে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।

এ উৎসব চলে সাধারণত তিনদিন। প্রথম দিনটিকে এরা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’। এর শাব্দিক অর্থ ‘ফুল তোলা’। এ দিন মারমা যুবতীরা গোলাপ, জবা, গন্ধরাজ, বেলীসহ নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধপূজার রাত্রে সেসব ফুল সাজিয়ে দলবেঁধে ওইদিন ভোরবেলা সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে। বৌদ্ধমূর্তির বেদীতে ভক্তিসহকারে সেই ফুল রেখে তারা প্রার্থনা নিবেদন করে এবং নানা রংয়ের মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখে।

উৎসবের আগেই বেদীর স্থানটুকু ফুল ও মাল্যে ভরিয়ে দেওয়া হয়। ওইদিন প্রাতঃকালেই প্রবীণেরা অষ্টশীল গ্রহণ ও উপবাস পালনের জন্য বিছানাপত্রসহ অবস্থান নেয়। বিকেলে মন্দিরের বৌদ্ধমূর্তি নিয়ে সকলবয়সী মারমারা সারিবদ্ধভাবে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। ওই রাতে মারমা যুবক-যুবতীরা গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে। এ সময় তারা নানাপদের ও হরেকরকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করে।

উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি সাংগ্রাইং দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত অবধি ঘরে ঘরে চলে প্রবীণ পূজা। পূজার্ঘ্যর জন্য কলা, পেঁপে, নারকেল ইত্যাদি রঙিন কাগজে মুড়ে মোমবাতির প্যাকেটসহ তা বুদ্ধমূর্তির বেদীতে রেখে প্রার্থনা করা হয়।

‘সাংগ্রাইং আপ্যাইন’ হচ্ছে উৎসবের তৃতীয় দিন। এটা দেবীর নির্গমন দিবস। তাই ভোরে মঙ্গলাচরণ ও স্তত্র পাঠ, সকালে অষ্টশীল গ্রহণ ও পিণ্ডদান, বিকেলে গোলাপ ও চন্দন মিশ্রিত জলে বুদ্ধ স্নান, সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা এবং রাতের আরতি দানের মধ্য দিয়ে দিবসের সমাপ্তি ঘটে।

এ ছাড়া মারমা সমাজে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এটি যুবক-যুবতীদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, প্রেম-ভালোবাসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ অনুষ্ঠানে যুবতীরা প্যান্ডেলের ভিতরে পানিভর্তি নৌকা বা ড্রামকে পেছনে রেখে সারিবদ্ধভাবে পানির পাত্র হাতে নিয়ে নৌকার গা ঘেঁষে বসে থাকে। যুবকেরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নেচে গেয়ে প্যান্ডেলের দিকে এগোতে থাকে। প্রত্যেকের হাতে থাকে খালি বালতি ও মগ। যুবতীরা যুবকদের দিকে পিঠ রেখে উল্টোদিকে ফিরে সারিবদ্ধভাবে নৌকার পাশে বসে। প্রতিটি যুবক পছন্দানুযায়ী এক একজন যুবতীকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট স্থান থেকে পিঠের উপর পানি নিক্ষেপ করে। দু’ তিনবার পানি পড়ার পর যুবতীটি উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুবকের মুখোমুখি হয়। অতঃপর নৌকা বা ড্রাম থেকে পানি তুলে যুবকের মুখের দিকে পানি ছুঁড়ে মারে। যুবকের বালতির পানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত উভয়ে পরস্পরের প্রতি এভাবে পানি ছুঁড়তে থাকে। তবে কৌণিক বা আড়াআড়িভাবে পানি নিক্ষেপ নিষেধ থাকে। অনুষ্ঠান চলাকালে কেউ কোনো অশোভন, অশালীন বা অশ্লীল আচরণও করতে পারে না।সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় চাকমাদের বিজু উৎসবের সঙ্গে দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাকমারা বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে মূলবিজু, তার আগের দিনটিকে ফুলবিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে নতুন বছর বা ‘গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে। এ তিনদিন ধরেই এরা বিজু উৎসব পালন করে।

ফুল বিজুর দিনে বাড়ির ছেলে মেয়েরা সকালে ঘুম থেকে উঠে বিভিন্ন ফুল তুলে নিজ নিজ বাড়িতে আনে। অতঃপর তারা সেগুলো দিয়ে বুদ্ধপূজা, গৃহ দেবতার পূজা করে থাকে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুলে ফুলে বাড়ি ঘর সাজানোর পর পোষা গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। ফুল বিজুর দিনে গ্রামের সবাই একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করে এবং বন্য জন্তুর মাংস সংগ্রহের জন্য শিকারে বের হয়। কেউ কেউ মাছ ধরতে যায় নদীতে। মেয়েরা নানা তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে জঙ্গল ও ক্ষেত খামারে। এ সময় এরা গন্ধকী, কাটুবের আগা বা মূল, একদাজ্যা কচুর দিগ, কেতকী, গোলাক বেত ও মরিচা বেতের আগা ইত্যাদি সংগ্রহ করে আনে। বিকেলে গোয়ালঘরে, স্নান ঘাটে সুতালি বাতি বা মোম জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় নানারকম পিঠা বানানো।

মূল বিজুর দিন প্রতি বাড়ির লোকেরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নদীতে বা জলাশয়ে স্নান সেরে নেয়। অতঃপর দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে চাকমারা পুরানো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মেয়েরা স্নান সেরে ফুল বিজুর দিনে সংগ্রহ করা প্রায় ২০ রকমের শাকসবজি দিয়ে রান্না করে ‘পাঁচন’ নামক এক ধরণের ঐতিহ্যবাহী খাবার। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে আগতদের তা খেতে দেওয়া হয়। এছাড়া এদিনে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী সকল বয়সীরাই বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যায়। এ সময় নানা ধরণের খাদ্য ও প্রিয় পানীয় ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

গুজ্জেই পজ্জা’র দিন বা তৃতীয় দিন বা নববর্ষের প্রথম দিন চাকমারা দলবেঁধে  উপাসনালয়ে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। গ্রাম্য ছেলেমেয়েরা এ দিনটি গিলাখেলা, গুদু (হাডুডু) খেলাসহ বিভিন্ন খেলাধুলা ও আমোদের মধ্যে অতিবাহিত করে। যুবক-যুবতীরা মহানন্দে আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায়। সন্ধ্যায় প্রতিঘর, ক্যাংঘর, স্নানঘাট, গরু-মহিষের ঘরে আলোকসজ্জা করা হয়। মূল বিজু বা বৎসরের শেষ দিনে নানা প্রকার পানীয় ও উত্তম খাদ্যদ্রব্য খাওয়া হয়। তাই এর পরদিন নববর্ষের প্রথম দিনে এরা বিশ্রাম নেয়। এ কারণেই চাকমারা এ দিনটিকে ‘গুজ্জেই পজ্জা’র দিন অর্থাৎ শুয়ে থাকার দিন বলে।

বৈসাবির সময়টাতে পাহাড়ের আদিবাসীরা জেগে ওঠে। দূর প্রবাসের আদিবাসীরাও ফিরে আসে তাদের আপনজনের কাছে। তারা প্রাণের উৎসব বৈসাবি পালন করে বিশ্বাসের নানা আচার আর আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে।

বৈসাবি আসলেই গণমাধ্যম সরগরম হয়ে ওঠে। দলবেঁধে সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিক আর বিভিন্ন পেশাশ্রেণির মানুষেরা ভিড় জমায় পাহাড়ে। আদিবাসী নারীদের বৈসাবির নানা আচার ও জলকেলির পানি ছোড়ার ছবি ও দৃশ্য দেখানো হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। প্রতিযোগিতা চলে কে কত ভালোভাবে তুলে আনতে পারে আদিবাসী সংস্কৃতিটাকে। কেউ কেউ আদিবাসীদের উৎসবে গিয়ে মুগ্ধ হন। আনন্দ পান। আদিবাসীদের সঙ্গে নানা আচারে অংশ নিয়ে নানা ঢংয়ে ছবি তোলেন। কিন্তু অবাক হতে হয় তখনই যখন দেখি আদিবাসীদের যৌক্তিক অধিকার আদায়ের পক্ষে, আদিবাসী নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে কিংবা নির্ভয়ে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালনের দাবির কর্মসূচিগুলোতে খুব কমসংখ্যক বাঙালিই যুক্ত রয়েছেন।

তাই শুধু উৎসব-আনন্দেই নয়। আদিবাসীদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে হাতে হাত রেখে। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। অধিকার ও মানবতার পক্ষে। তবেই এদেশে প্রতিষ্ঠা পাবে সব জাতির মৌলিক অধিকারগুলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, প্রকাশকাল: ১৪ এপ্রিল ২০১৬

এই সাইডে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button