কলাম

ভূমিকম্পে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

লেখাটি যখন লিখছি তার ঘণ্টা দুয়েক আগে তৃতীয়বারের মতো ভূমিকম্প অনুভূত হলো। পর পর তিনদিন তিনবার ভূমিকম্পের নজির বাংলাদেশে এবারই প্রথম। পেশাগত কারণে এসেছি দিনাজপুরে। ঢাকায় পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব কে কিভাবে আছে জানতে মন উদগ্রিব হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর মোবাইল ফোন বেজে উঠছে। সবার মনে অজানা আতঙ্ক। কী হচ্ছে? কী হবে ভবিষ্যতে?
বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ এ ধরনের তিনটি প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। এছাড়া দেশের মধ্যে থাকা চ্যুতি বা ফল্ট লাইনগুলো যেকোনও সময় ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প।
আবার ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী প্লেট ও সাবপ্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দু’টি প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল। দু’টি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়।
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর চ্যুতি, বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুণ্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরী চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজিবাজার চ্যুতি এলাকা ও রাঙ্গামাটির বরকলে রাঙ্গামাটি চ্যুতি এলাকা। তাই বলা যায় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ফলে কড়া নাড়ছে মাঝারি ও ছোট আকারের ভূমিকম্প।
ভূমিকমম্পের সময় নিশ্চয়ই সারা দেশের মানুষ তাদের প্রিয়জনের খোঁজ নিয়েছেন। কে কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন? ভূমিকম্পে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ভূমিকম্প নেপালের কাঠমান্ডুকে কিভাবে মিশিয়ে দিয়েছে- তার ছবি ও ভিডিও আমরা দেখেছি। নেপালের মতো বা তার কাছাকাছি মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে গোটা ঢাকা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। প্রাণহানি ঘটবে লাখো মানুষের। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভূমিকম্প মোকাবেলায় আমরা কতটুকু প্রস্তুত। বিশেষ করে সরকারিভাবে প্রস্তুতি কতটুকু রয়েছে?পরপর দুইদিন বাংলাদেশে ভূকম্পন অনুভূত হওয়ার পর গত রবিবার সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ভূমিকম্পে ১৪ দফা করণীয়র কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যমকে। ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে সে সম্পর্কে তারা বলছেন- আতঙ্কিত না হওয়া, ভূকম্পনের সময় বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনও আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নেওয়া, রান্না ঘরে গ্যাসের চুলা বন্ধ রাখা, বীম, কলাম ও পিলারঘেঁষে আশ্রয় নেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুলব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চে অথবা টেবিলের নিচে আশ্রয় নেওয়া, ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে খোলা স্থানে আশ্রয় নেওয়া, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল, মার্কেট ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাতে মাথা ঢেকে বসে পড়া, ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্টা না করা, কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা, যাতে ধুলোবালি শ্বাসনালীতে ঢুকতে না পারে। একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নেওয়া। উপরতলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করা, তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নিচে নামা থেকে বিরত থাকা। গাড়িতে থাকলে ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামান, ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরে থাকা, ব্যাটারিচালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ও শুকনো খাবার বাড়িতে প্রস্তুত রাখা।
কিন্তু সরকার করণীয় নির্ধারণ করলেও তার ব্যাপক প্রচার ও মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণের খবর আমরা এখনও পাইনি। কী করা যেত? রেডিও, টেলিভিশন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে ভূমিকম্পের সময় করণীয়গুলো বার-বার প্রচার করা। এসএমএস-এর মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান করা। উপজেলা বা জেলা ওয়েবপোর্টালে সচেতনতামূলক নির্দেশনা প্রদান। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, গির্জা ও প্যাগোডায় নিয়মিত ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ে আলোচনা বা ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ। এভাবে সহজেই স্বল্প সময়ে অধিক সংখ্যক মানুষকে ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতন করা যায়। কিন্তু এর কোনওটিই আমরা হতে দেখিনি!
অন্যদিকে গণমাধ্যমগুলোর উচিত শুধু বাড়ির ফাটলের সংবাদ কিংবা বাংলাদেশ কতটুকু ঝুঁকিতে রয়েছে শুধু সেটার প্রচারে সীমাবদ্ধ না থেকে করণীয়গুলো বারবার তুলে ধরা। এতে জনসাধারণের মাঝে ভূমিকম্প মোকাবেলায় মানসিক শক্তি কিছুটা হলেও তৈরি হবে। এ দায়িত্ব পালন করতে পারে সংবাদপত্র, অনলাইন সংবাদপত্র ও চ্যানেলগুলো। আমাদের স্বীকার করতেই হবে বাস্তবে শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত কারও মাঝে ভূমিকম্প সচেতনতা নেই। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি গত কয়েকদিনে।
ঢাকায় ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি বিপদজনক বিষয় হলো ঘর থেকে বেরিয়ে আসা। কারণ ঢাকায় ফাঁকা জায়গা নেই। সবাই বাইরে বের হয়ে অাসলে বরং প্রাণহানির আশঙ্কাই বাড়বে। অথচ গত তিনদিনেই আমরা দেখেছি নগরবাসী ভূমিকম্পের সময় এই কাজটিই সবার প্রথমে করেছে। এতে এটাই প্রমাণ করে ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতা বা প্রস্তুতি আমাদের নেই।
তাই শুধু সরকার নয়, ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতায় কাজ করতে হবে প্রত্যেককেই। আমরা যদি আমাদের আপনজনদের মাঝেই করণীয়গুলো ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলেও প্রাণহানি কমানো সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে ভূমিকম্পে নিজেকে বা প্রিয়জনকে বাঁচাতে সচেতনার কোনও বিকল্প নেই।
ভুমিকম্প হলেই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে কথা ওঠে। এরই মাঝে অনেক বাড়িই হেলে পড়েছে। অনেক ভবনে দেখা দিয়েছে ফাটল। এক গবেষণা অনুযায়ী রাজধানীতে ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ ভবনই রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নয়। তাহলে প্রশ্ন হলো রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের নকশা কি রাজমিস্ত্রিদের করা?
নকশার অনুমোদ দেয় রাজউক। কিন্তু রাজউকের কাজ শুধু নকশা অনুমোদন দেওয়া নয়। রাজউকের বেশ কয়েকজন অথরাইজড অফিসার রয়েছেন। যাদের কাজ অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ সাইট পরিদর্শন করে নির্মাণ কৌশল তদারকি করা। কিন্তু বাস্তবে কি আমরা তেমনটা দেখতে পাই!
যিনি বাড়ি বানাচ্ছেন নিজের ও আপনজনকে রক্ষায় তাকেই সর্তক থাকতে হবে। দুই নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদার থেকে দূরে থাকতে হবে। যারা ফ্ল্যাট কিনছেন তাদেরই যাচাই করে নিতে হবে ব্লিল্ডিংটি ভূমিকম্পে সহনশীল কিনা। এ বিষয়ে শুধু রাজউকের ওপর দোষ দিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। নিজের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য নিজেকেই সর্তক থাকতে হবে।
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, কোনও ভবন ধসে পড়লেই ফুটে উঠেছে আমাদের অসহায়ত্ব। উদ্ধারকাজে পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব। অভাব রয়েছে দক্ষ উদ্ধারকর্মীরও। এই দিকটায় খেয়াল দেওয়া জরুরি। শুধু বিভিন্ন বাহিনীর উদ্ধারকর্মীই নয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করে তাদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। এর সুফল আমরা পাব যে কোনও দুর্যোগ মোকাবেলায়।
ভূমিকম্প কোনও পূর্বাভাস দিয়ে আসে না। ফলে তাৎক্ষণিক প্রস্তুতির সুযোগ নেই। একমাত্র সচেতনতাই ভূমিকম্প মোকাবেলার একমাত্র পথ।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: দুপুর ০৩:৪৬ মে ০৫, ২০১৫

© 2015 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button