মুক্তিযুদ্ধ

পাকসেনাদের বিচার করা দরকার ছিল

১৯৬৫ সাল। ভারত পাকিস্তানের ওপর ট্যাংক আক্রমণ চালায়। ক্যামকারন সেক্টর হয়ে লাহোর দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু তা নস্যাৎ করে দেয় ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শতাধিক বাঙালি সৈন্য। বুকে মাইন বেঁধে ট্যাংকের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে একে একে তারা উড়িয়ে দেয় ভারতীয় ট্যাংকগুলো। ভড়কে যায় ভারতের সেনারা। পিছু হটতে বাধ্য হয়।
ট্রেনিংয়ে বাঙালি সেনাদের বীরত্বের এ কাহিনি আমাদের পড়ানো হত। বাঙালিদের এমন বীরত্ব থাকা সত্ত্বেও ব্যারাকের ভেতর পাঞ্জাবি-পাঠান সৈনিকেরা আমাদের হেয় চোখে দেখত। ‘তোরা ভিতু’ বলে কটূক্তি করত। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই হাতাহাতি হত।

ট্রেনিং শেষে আমাকে পাঠানো হয় কুর্মিটোলায়, বিমান বাহিনীর ব্যারাকে। উনিশশ’ সত্তর সালের শেষের দিকের ঘটনা। সন্ধ্যায় ব্যারাকের বাইরে আড্ডা দিচ্ছি আনিসুর, দেলোয়ার ও দেলোয়ার রহমানসহ পাঁচজন। একসঙ্গে দেখে একদল পাঞ্জাবি আমাদের ‘মা……’ বলে গালি দেয়। শুনে আমরা ঠিক থাকতে পারি না। সবাই ছিলাম কমান্ডো। ওদের দশজনকে এমন ধোলাই দিই যে পরবর্তীতে ওদের হাসপাতালে নিতে হয়েছিল।
কমান্ডাররা আমাদের কথা শুনলেন না। ঘটনাটি ব্যারাকের বাইরে হওয়ায় চাকরি হারাইনি। তবে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেন্ট্রাল জেলে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে হাতাহাতির খবরটি পৌঁছে যায় আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার কাছে। জামিন করে তিনিই আমাদের জেল থেকে বের করে আনেন। অতঃপর পল্টনে তাঁর বাসার দুটি রুমে ঠাঁই হয় আমাদের।’’
যুদ্ধদিনের কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বীর প্রতীকের মুখে। বাড়ি তাঁর নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার চর মল্লিকপুর গ্রামে। তিন ভাই ও দুই বোনের সংসারে মতিউর সবার ছোট। দুই বছর বয়সেই মারা যান তার বাবা আবদুল কাদের মৃধা। মতিউর লেখাপড়া করেন মল্লিকপুর প্রাইমারি স্কুলে। পরে লোহাগড়া পাইলট স্কুলে পড়েন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর চলে যান খুলনার খালিশপুরে। সপ্তাহে দশ টাকা বেতনে কাজ করেন ক্রিসেন্ট জুট মিলে।
সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর মতিউর যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সে কাহিনি শুনি তাঁর জবানিতে–

বীরপ্রতীক মতিউর রহমানের হাতে আঘাতের চিহ্ন

‘‘ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭। সেনাবাহিনীতে ভর্তির খবর পেয়ে খুলনা সার্কিট হাউজে গিয়ে লাইনে দাঁড়াই। এক অফিসার এসে বুকে খুব জোরে থাপ্পড় মারেন। তবুও আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। পরে তিনি বুকে একটি সিল মেরে দেন। সিপাহী হিসেবে প্রথম ট্রেনিং করি করাচিতে, ডেরা ইসমাইল খান ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানেই এসএসজি (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) নামের বিশেষ কমান্ডো ট্রেনিং করি। আমার আর্মি নং ছিল– ৮৮০৭৯১৪।’’
১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হন বীর প্রতীক মতিউর। তাঁর ডানহাতের বাহুর হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে। ফলে ওই হাতে পৌনে দুই ইঞ্চি আর্টিফিসিয়াল বন লাগিয়ে রড দিয়ে সার্পোট দেওয়া হয়েছে। এখনও ডান কাত হয়ে ঘুমালে তাঁর শরীর অবশ হয়ে যায়। লিখতে গেলে অবশ হয়ে যায় হাতটাও। ভারি কোনো জিনিস তুলতে পারেন না। এভাবেই কাটছে জীবন।
আবেগ, উত্তেজনা আর মাঝে মাঝে বিষাদের সাগরে ডুবে তিনি আমাদের শুনিয়ে যান একাত্তরের নানা গল্প।
‘‘৭ মার্চ, ১৯৭১। তখনও ব্যারাকে ফিরে যাইনি। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিবেন রেসকোর্স ময়দানে। আমরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ পাই। এখন যেখানে শিশু পার্ক, সেখানে তৈরি হয় মঞ্চ। দুপুরের মধ্যেই গোটা মাঠ লোকে লোকারণ্য। সবাই ভেবেছে বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কিন্তু এমনটা তিনি করলেন না। কৌশলে বললেন– ‘যা কিছু আছে, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

                                                               ভিডিও:  বীরপ্রতীক মতিউরের সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ:

                                                               

১৬ মার্চে ব্যারাকে ফিরে আমরা বাঙালি প্লাটুনের সঙ্গে অ্যাড হই। আমাদের ২১ জনের একটি দলকে অস্ত্রসহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় পুরাতন বিমান বন্দরের রানওয়ের উত্তর পাশে। বিমান সংরক্ষিত বাঙ্কার ছিল সেখানে। তাঁবু গেড়ে আমরা সেটা পাহারা দিতাম।
২২ ও ২৩ মার্চ। পাঞ্জাবি ও পাঠান সেনারা এয়ারপোর্টের ভেতরে অবস্থান নেয়। তারা রণসাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ২৪ মার্চ রাতে ট্যাংক ও আর্টিলারি এনে জড়ো করা হয়। এসব দেখেই অনুমান করেছি ডাস্টিক কিছু ঘটবে। তাই ঘটল। পরে সেটির নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’।
২৫ মার্চ রাত ১০টা। এয়ারপোর্টের আশপাশের কাফরুল, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া গ্রামগুলোতে তারা ঢুকে ব্যাপক অত্যাচার চালায়। দূর থেকে শত মানুষের আর্তচিৎকার শুনি। ওইসময় পুরো ঢাকা ছিল ব্ল্যাক আউট। কোথাও কোনো আলো ছিল না!
নায়েক সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে সিভিল পোশাকে অস্ত্রসহ আমরা তালতলা দিয়ে বেরিয়ে যাই। পরে রাজাবাজার দিয়ে রেসকোর্স ময়দান পার হয়ে চলে আসি ফুলবাড়ি স্টেশনে। ঠাটারি বাজারের কাছে এসে দেখা হয় নাদির ও শামসুর দলের সঙ্গে। তারা ছিল ওই এলাকার নামকরা গুণ্ডা। কিন্তু দেশের টানে নেমে এসেছিল পথে।

সপরিবারে বীরপ্রতীক মতিউর রহমান

রাত তখন ১২টা ১ মিনিট। পাকিস্তানি সেনারা ফিল্ড আর্টিলারি সেল ছাড়ে পিলখানা, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজারবাগের দিকে। আমরা তখন বংশাল পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে অস্ত্র লুট করে নিই। পরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সিদ্দিক বাজার, নওয়াবপুর, কাপ্তানবাজার এলাকায় প্রতিরোধ গড়ি।
২৬ মার্চ সন্ধ্যায় নওয়াবপুর মোড়ে সেনাদের গুলিতে শহীদ হয় নাদির। এলাকায় ঢুকে পড়ে আর্মিরা। তখন ওয়ারির খ্রিস্টান কবরস্থানে অস্ত্র লুকিয়ে আমরা চলে যাই নরসিংদীতে। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা এয়ার অ্যাটাক করে। ফলে শাহ আলম নামে এক ছেলের সঙ্গে লঞ্চে করে আমি চলে আসি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে।
শাহ আলমের বাবা মজিবুর রহমান ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। বাড়ি গোপালপুরে। পুলিশ, আনসারসহ উনি ৩৫ জনের একটি দল রেডি করে রেখেছিলেন। আমাকে পেয়ে তিনি খুশি হলেন। ১ এপ্রিল, ১৯৭১। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্নঘাটে আমরা ফোর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। হাবিলদার আবদুল হালিমের নেতৃত্বে আমাদের একটি প্লাটুন তৈরি করে দেওয়া হয়। আমরা ডিউটি করি গোকর্নঘাট থেকে ২ কিলোমিটার উত্তরে মেঘনা নদীর তীরে।
এপ্রিলের তখন শুরু। মেঘনা নদীতে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ আমরা ডুবিয়ে দিব। নদীর কচুরিপানা ক্যামোফ্লেজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি স্পিডবোটের নিচে তিনটি ও ওপরে আড়াআড়িভাবে দুটি কলাগাছের টুকরো দিয়ে আরআর (রকেট লাঞ্চার) ফিট করে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিই। সাঁতরিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমরা সেটি সামনে নিই। কাছাকাছি আসতেই আরআর-এ গোলা ভরে দেয় নায়েক মনির। ফায়ার করেন ক্যাপ্টেন গফফার। তিনটি ফায়ারেই ডুবে যায় পাকিস্তানি সেনাদের জাহাজটি।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আশপাশে তারা ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। ফলে ফোর বেঙ্গল রেজিমেন্ট শিফট করে চলে যায় আখাউড়া রেলওয়ে জংশনে। সেখানে হত্যার করুণ দৃশ্য দেখে মনটা হু হু করে ওঠে। ত্রিশের মতো পুরুষের পাশে পড়ে আছে জনা বিশেক নারীর লাশ। দেহ ক্ষতবিক্ষত। কারও স্তন নেই। কারও হাত কাটা। কারও যৌনাঙ্গে গাছের ডাল ঢোকানো। স্থানীয় বিহারীরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় এভাবেই সেখানে বাঙালি নিধন করেছিল। এসব দেখে আমরা ঠিক থাকতে পারি না।’’
বীর প্রতীক মতিউর যুদ্ধ করেছেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তাফা কামালের সঙ্গে। সে কাহিনিও জানা হল–
‘‘১৪ এপ্রিল, ১৯৭১। গঙ্গাসাগর নামক স্থানে যুদ্ধ করছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমাদের সেখানে পাঠানো হয়। গঙ্গাসাগর মূলত একটি বড় দিঘি। আমরা এর দক্ষিণ পাড়ে পজিশন নিই। ডানে আগরতলা থেকে বয়ে আসা তিতাস নদী। নদীর ওপারে মুগড়া বাজারে ছিল পাকিস্তানি সেনারা। আর্টিলারি দিয়ে তারা চেষ্টা করছিল ডিফেন্স ভেঙে দিতে। পেছনে কল্যাণ শাহ মাজারের কাছে ছিল আমাদের আরেকটি ডিফেন্স। ১৬ এপ্রিল সেখানেও আর্টিলারি হামলা হয়। এতে বাতাসে ইথার নষ্ট হয়ে যায়। ওয়্যারলেসে যোগাযোগ তখন বন্ধ। ফলে ডিফেন্স আখাউড়া বর্ডারের কাছে সরে গেলেও সে খবর আমরা পাই না।
পাকিস্তানিরা আখাউড়া দখল করলে আমরা পড়ে যাই মধ্যে। পথ খোলা শুধুই পূর্বদিকে। আমাদের কাছে অ্যামুনেশন নেই, খাদ্য নেই। এভাবে থাকলে মারা পড়তে হবে। তাই সিদ্ধান্ত হয় পূর্ব দিক দিয়ে মুভ করার।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল ছিলেন আমার বাঙ্কারে। তাঁর কাছে সেভেন পয়েন্ট নাইন টু হেভি মেশিনগান। তাঁকে বললাম, ‘দোস্ত, চলো মুভ করি’।
নিজের কথা না ভেবে তিনি বললেন, ‘আমার কাছে অ্যামুনেশন আছে। তোমরা আমার মেশিনগানের চেইনগুলি ফিলিং করে গুলি সাজিয়ে দিয়ে যাও। ওদের আমি ঠেকিয়ে রাখব।’
বললাম, ‘তোমার অ্যামুনেশন যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন তো ওরা তোমাকে ধরবে, কাটবে, টর্চার করে মেরে ফেলবে, মোস্তফা।’
চোখ দুটো স্থির রেখে মোস্তফা উচ্চারণ করলেন জীবনের শেষ বাক্যটি, ‘আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলতেছি, আত্মসমর্পণ করব না। প্রয়োজনে শেষ বুলেট দিয়ে আত্মহত্যা করব।’
বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বীর প্রতীক মতিউর। তাঁর মনের চোখে ভেসে উঠেছে সহযোদ্ধার মুখখানি। নিজেকে সামলে নিয়ে কোনো রকমে বললেন, ‘‘আজ যে বেঁচে আছি, এটা তাঁর কারণেই। সত্তর জন সেনার জীবন রক্ষা পেয়েছিল সেদিন।’’
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত সে দিনটিতে?
মতিউর রহমানের ভাষায়–
‘‘চন্দ্রপুর গ্রামে ছিল আমাদের সি কোম্পানির ডিফেন্স। কমান্ডে লেফটেন্যান্ট আজিজ। সেখান থেকে দুইশ গজ উত্তরে লতিয়া মোড়ায় ছিল পাকিস্তানিদের শক্তিশালী ঘাঁটি। তারা অস্ত্র সেখানে জমা করে আগরতলার দিকে আর্টিলারি ছুঁড়ত। আমরা দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা। অন্য পাশে ছিল ইন্ডিয়ান আর্মির একটি কোম্পানি। তিন দিন ধরে চলে রেইকি ও ব্রিফিং।
২১ নভেম্বর, ১৯৭১। রাত ১২ টার পর অপারেশন শুরু হয়। ইন্ডিয়ান আর্মি আক্রমণ করে লতিয়া মোড়ার পূর্ব দিকে। রেললাইনের ওপর দিয়ে ক্রলিং করে চন্দ্রপুর গ্রামের পূর্বদিকে আমরা এগোই। পরিকল্পনা ছিল ওদের বাঙ্কারের পেছনে পৌঁছে আমরা ফায়ার ওপেন করব। কিন্তু তা হল না। একশ গজের ভেতরে প্রবেশ করতেই ওরা ফায়ার ওপেন করে দেয়। বেরি লাইট নিক্ষেপ করে আমাদের অবস্থান জেনে যায়। ধানক্ষেতে আমরা তখন পজিশন নিই।
তুমুল গুলি চলছিল। পাশে লেফটেন্যান্ট আজিজ, উত্তরে হাবিলদার আবদুল হালিম বীর বিক্রম। শোঁ শোঁ করে গুলি আসছে। খানিক পরেই দেখি তাদের নিথর দেহ পড়ে আছে। নিজেকে সামলে নিই। ক্রলিং করে দক্ষিণ পাশের একটি বাঙ্কারের নিচে আসি। আমার হাতে একটা থাট্টি সি হ্যান্ড গ্রেনেড। অপেক্ষায় থাকি। ফায়ার বন্ধ হলেই থ্রো করব। তাই করলাম। কিন্তু সে মুহূর্তেই ব্রাশ এসে লাগে আমার ডান হাতে।
প্রথমে কিছুই বুঝিনি। মনে হল কেউ যেন রাইফেল দিয়ে হাতে বাড়ি দিয়েছে। ডান হাত কোথায়? কোনো বোধ নেই। ভাবলাম, হাত কেটে পড়ে গেছে। পরে খেয়াল করে দেখি ডানহাতের বাহুর হাড় গুঁড়ো হয়ে হাতটি পেছনে উল্টো হয়ে উঠে গেছে। প্রচণ্ড ব্যথা। সহযোদ্ধারা ইনজেকশন দিতেই আমার শরীর ঢলে পড়ে। জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, আমি আসামের গৌহাটি হাসপাতালে।’’
যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের মানসিকতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন–
‘‘বাঙালি মেয়েদেরকে ওরা মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত। আমাদের সঙ্গে যখন পেরে উঠত না তখন মেয়েদের উলঙ্গ করে বাঙ্কারের ওপর শুইয়ে দিয়ে মাইকে চিৎকার করে বলত, ‘মার, তেরা বেহেন কো মার’।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মতিউর বলেন–
‘‘ওই ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা যাদের আত্মসমর্পণের পর ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, আমি মনে করি তাদেরও বিচার করা উচিত ছিল।’’
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের কার্যক্রম কেমন দেখেছেন জানতে চাইলে তিনি জানালেন–
‘‘ওদের মুল কাজ ছিল গ্রামে গ্রামে ঘুরে ধনসম্পদ লুট করা ও বাঙালি মেয়েদের পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া। সেনারা যখন গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিত, রাজাকাররা তখন ধন-সম্পদ লুট করত। তারা যদি পথ চিনিয়ে, লোক দেখিয়ে না দিত তবে পাকিস্তানি সেনারা এত লোক হত্যা করতে পারত না।’’
যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচার প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন–
‘‘আরও আগেই এদের বিচারের আওতায় আনা দরকার ছিল। রাজাকারদের তালিকা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হত। স্বাধীনতার পর এই তালিকা অনুযায়ী রাজাকারদের চিহ্নিত করলেই বিচার করা সহজ হত। তবে দেরিতে হলেও এদের বিচার হচ্ছে, এটি ভেবেই শান্তি পাই।’’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে অকপটে তিনি বলেন–
‘‘অস্ত্র হাতে যাঁরা সম্মুখযুদ্ধ করেছেন তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন সার্পোটিং গ্রুপ। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা দিয়েছেন, গোপনে খাবার ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। স্বাধীনতা লাভের পরে সম্মুখযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা ও সাহায্যকারী মুক্তিযোদ্ধা দুটি ক্যাটাগরিতে তালিকা প্রণয়ন করা হলে কোনো বির্তক থাকত না।’’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ উঠতেই এই বীর প্রতীকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। অতঃপর তিনি বলেন–
‘‘বঙ্গবন্ধু না হলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হত না। বাঙালির মনে জাতীয়তাবোধের জন্মদাতা তিনি। একাত্তরে পাকিস্তানিরা তাঁর কিছুই করতে পারেনি। অথচ স্বাধীন দেশে তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিশ্ব ইতিহাসে আমরা শুধু বীরের জাতি নই, নিমকহারাম ও খুনির জাতিতেও পরিণত হয়েছি।’’
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দালাল আইন বাতিলের ফলে রাজাকারদের বিচার বন্ধ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই তারা রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গাড়ে। এটি ছিল লজ্জাজনক অধ্যায়। সে সময়কার একটি ঘটনা বলেন মতিউর–
‘‘জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি, তখন রাজাকার শাহ আজিজ তার প্রধানমন্ত্রী। আমরা দাওয়াত পাই বঙ্গভবনে। সেখানে আমরা প্রতিবাদ করি, শাহ আজিজ যদি মঞ্চে থাকে তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে না। কুষ্টিয়ার মামুন নামে এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তাকে জুতা নিয়ে মারাতেও গিয়েছিল।’’
জিয়াউর রহমান কেন রাজাকারদের সঙ্গে হাত মেলালেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধা মতিউর বলেন–
‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভুমিকা ছিল এক রকম, কিন্তু পরে ক্ষমতার লোভে সব পাল্টে যায়। একবার জিয়াকে আমরা প্রশ্ন করলাম, আপনি রাজাকারদের কেন সরকারে নিলেন, দেশে কি আর কোনো লোক ছিল না? জিয়া বললেন, ‘আমাকে একটু দাঁড়াতে দাও। পায়ের নিচে মাটি নেই। মাটি তৈরি করতে হলে প্রথম দিকে কাদামাটি, কচুরিপানা এনেই চালাতে হয়। মাটি শক্ত হলেই এগুলোকে বিদায় করে দিব।’ কিন্তু পরে সেটা তিনি করলেন না। এখন তো রাজাকার ছাড়া তার দল চলতেই পারে না!’’
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার কথা জানতে চাই আমরা। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তিনি বলেন–
‘‘আমাদের ছেলেরা বিদেশের মাটিতে যখন সফল হয়, কর্মজীবী লাখো নারী যখন স্বাধীন দেশে নিজেদের যোগ্যতা স্পষ্ট করে, দেশের প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেয়– তখন সত্যি খুব ভালো লাগে।’’
আর খারাপ লাগে কখন?
‘‘স্বাধীন দেশে যখন দেখি রাজাকাররা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, দেশের রাজনীতিতে পাকা আসন গেড়েছে– তখন খুব কষ্ট পাই, খারাপ লাগে।’’
পরবর্তী প্রজন্মের হাত ধরেই এ দেশটা একদিন অনেক উন্নত হবে– এমনটাই আশা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক মতিউর রহমানের। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন–
‘‘তোমরা ঠিকভাবে লেখাপড়া কর, জ্ঞান অর্জন করে তা দেশের কাজে লাগিও। দেশটাকে ভালোবেস। তা না হলে তোমার সব অর্জনই বৃথা হয়ে যাবে।’’

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমের মতামত-বিশ্লেষণ বিভাগে, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৪

© 2014 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button