মুক্তিযুদ্ধ

তাঁর ভালোবাসার সুযোগ নিয়াই ওরা তাঁরে খুন করসে

আলাপচারিতার শুরুতেই ভদ্রতাবশত প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘কেমন আছেন?’’
চোখেমুখে কষ্ট ছড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া উত্তর দিয়েছিলেন– ‘‘দেখতেই তো পারতাছেন, এইডা কোনো মাইনসের জীবন! স্বাধীন হইয়া দেশটা তো একাই চলছে। আমি চলছি অন্যের সাহায্যে।’’

তারা মিয়াকে স্বাভাবিক করতে আমরা দৃষ্টি ফেরাই একাত্তরের দিকেতাঁর নাম কেন ‘তারা’ তা জানা নেই তাঁর। জীবনটা তাঁর আকাশের তারার মতো ঝলঝলে নয়। বরং তাঁর জীবনাকাশ দুঃখের কালো মেঘে ঢাকা।

অন্যের সাহায্য নিয়ে জীবন কাটে তারা মিয়ার
অন্যের সাহায্য নিয়ে জীবন কাটে তারা মিয়ার

দেড় বছর বয়সেই তারা মিয়ার বাবা শমসের আলী মারা যান। বাবার চেহারা কেমন ছিল, সেটিও তাঁর স্মরণে নেই। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজ। মা লাল বানুকে নিয়ে যান তাঁর ভাইয়েরা। বিয়ে দেন নতুন ঘরে। বেঁচে থেকেও তাঁদের মা তখন আর তাঁদের নন। তিন ভাই এতিম, কোথায় যাবেন!
পরে দু’ভাইয়ের ঠাঁই হয় খালার সংসারে। আর তারা মিয়া ঠিকানা খুঁজে পান ফুপু মিরজান বিবির ঘরে। ফুপুর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তারা মিয়াকে তিনি পুত্রের মতোই মায়া করতেন। তা দেখে গ্রামের লোক বলত, ‘ওরে পালবা কেমনে? ওর বাপ কি ওর জন্য জমি রাইখা গেছে? বড় হইলে তো মায়ের মতোই চইলা যাইব।’
মিরজান বিবি কারও কথায় উত্তর দিতেন না। তাঁর আদরেই বড় হতে থাকেন তারা মিয়া। গৃহস্থের কাজের পাশাপাশি খেলাধুলা করে কেটে যায় তারা মিয়ার জীবন। হাডুডু খেলায় ছিলেন পটু। হাঁটু ধরে ‘কেচি’ মারায় অস্তাদ। তাই দশ গ্রামের ওপার থেকেও তাঁর ডাক আসত। গ্রামে নাটক হত বছরে একবার। তারা মিয়া তখন দল বাঁধতেন বন্ধু সিদ্দিক, মোবারক, নূর ইসলাম ও কাদিরের সঙ্গে। টিপু সুলতান নাটকে অভিনয় করে মানুষের মন ভরাতেন।
কিন্তু ক্লাস ফাইভ পাসের পরেই তাঁর পড়াশোনা আর এগোয় না। বয়স তখন মাত্র বার। ফুপুর দেওয়া টাকা দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ থেকে পোলাওয়ের চাল এনে বিক্রি করতেন গ্রামের হাটে। চালের সের এক টাকা দশ আনা। তখন ১৯৬৪ সাল। জীবনের তাগিদে গ্রাম থেকে তারা মিয়া চলে আসেন ঢাকায়। ভাবলেন ড্রাইভারের কাজ নেবেন। কিন্তু গ্রামের আজিম উদ্দিন ড্রাইভার তাকে নিরুৎসাহিত করেন। তিনি তখন নরসিংদী রুটে মমিন কোম্পানির বড় বড় কোস্টার চালাতেন। পরে তাঁর মাধ্যমেই তারা মিয়া চাকরি পান ডেমরায়, লতিফ ভবানি জুট মিলে।
দেশে তখন নানা আন্দোলন, সংগ্রাম চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সে সময় মিলের শ্রমিকরা আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশ নিতেন। আতিক ও সাদেক ছিলেন মিলের নেতা। কাজের পাশাপাশি তাঁদের মুখেই তারা মিয়া দেশের কথা শুনতেন। বঙ্গবন্ধুর কোনো মিটিং হলেই কাজকর্ম ফেলে অন্যদের সঙ্গে অংশ নিতেন।

সন্ত্রীক তারা মিয়া
সন্ত্রীক তারা মিয়া

৭ মার্চ, ১৯৭১। আতিকের নেতৃত্বে ডেমরা থেকে তারা মিয়ারা মিছিল নিয়ে আসেন রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তাঁর মনে দাগ কাটে। তাঁরা মিয়ার ভাষায়–
‘‘এত মানুষ কইত্তে আইছে আল্লাই জানে। বঙ্গবন্ধু একটা সাহসের কথা কইছে, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’– এই কথাডা মনে গাইথ্যা গেছে। শরীরের রক্ত তহন টগবগ করতাসে। মনে হইছে উপরে আল্লা, নিচে বঙ্গবন্ধু। রক্ত তো দিতেই হইব। রক্ত ছাড়া কোনো দেশ স্বাধীন হয় নাই। তাঁর ভাষণই সারা দেশরে কাপায়া লাইছিল।’’
২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। পাকিস্তানি আর্মি গণহত্যা চালায় জগন্নাথ হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ২৬ মার্চ ডেমরার তারাবো ঘাটে জড় হয় শত শত লোক। সবার হাতে রামদা, লাঠি। তা দিয়েই তারা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনবেন। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বললেন, ‘এটা নিয়া তোমরা আর্মির লগে পারবা না। সবাই মারা পড়বা। ট্রেনিং নিয়া আস। ভারত চইলা যাও। তারপর ওগো লগে লাগো।’
ওই কথা শুনেই তারা মিয়ার মন উতলা হয়। সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।
সহকর্মী জান মাহমুদের মামা নূর ইসলাম ছিলেন লতিফ ভবানি জুট মিলের সুপারভাইজার। ট্রেনিংয়ে যেতে তিনি সহযোগিতা করলেন। এপ্রিলের প্রথমদিকের কথা। সবখানেই পাকিস্তানি সেনাদের পাহারা। মুদি দোকানদার সেজে, চৌদ্দশ টাকার মালের মেমো হাতে তারা মিয়া ওঠেন বেনাপোলের বাসে। সঙ্গে ছিলেন জান মাহমুদ। বেনাপোল থেকে গোপনে সীমান্ত পার হয়ে চলে যান ভারতে।
তারা মিয়া পরে ট্রেনিং নেন ত্রিপুরা রাজ্যের হরিপুর ক্যাম্পে। ২১ দিনের জেনারেল ট্রেনিংয়ের পর ৭ দিনের হায়ার ট্রেনিং। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং- ৯৭৯৩। তাঁদের ট্রেনিং করান হাবিলদার সিদ্দিক ও রাজ্জাক। রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড, চাইনিজ এলএমজি, এসএলআর চালানোর সব রকম ট্রেনিং দেওয়া হয় তাঁদের। ক্যাম্পে বসে তারার মনে নানা ভাবনা আসত– যুদ্ধে গিয়ে হয়তো বাঁচবেন না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেশটা তো স্বাধীন হবে। এ ভাবনাটাই পরে সত্যি হল। নিজে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হলেন, দেশটা হল স্বাধীন।
শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ তারা মিয়ার জীবনকাহিনি। তাঁর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ইটাওলিয়া গ্রামে। লেখাপড়ায় তাঁর হাতেখড়ি হোতানগর প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে এক সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের আর্টিলারির আঘাতে তিনি স্পাইনাল কর্ডে আঘাতপ্রাপ্ত হন। প্রথমে কিছুদিন হাঁটতে পারলেও স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে আঘাতের স্থানে ইনফেকশন হয়ে যায়। ফলে তিনি পঙ্গু হয়ে যান। বর্তমানে হুইল চেয়ারই তাঁর একমাত্র অবলম্বন।
পঁয়ষট্টি বছর বয়স্ক এ মুক্তিযোদ্ধার দৈনন্দিন জীবনের কষ্টগুলো দেখে আমাদের মনে অন্য এক বিষণ্নতা ভর করে। স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিয়েছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন– তাঁদের জন্য কতটুকুই-বা করতে পেরেছি আমরা! স্ত্রীর সাহায্য ছাড়া প্রায় কিছুই করতে পারেন না তিনি। দুই পা অবশ। বসতে গেলে কখনও কখনও পড়ে যান। শারীরিক কারণে কয়েক মিনিট পর পরই প্রস্রাবের চাপ আসে। প্রসাব-পায়খানা করতেও নির্ভর করতে হয় অন্যের ওপর।

তাঁর কাছে জানতে চাই তিনি কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছেন।
‘‘ট্রেনিং শেষে আমি চলে আসি ডেমরায়, যোগ দেই হাবিলদার ইদ্রিস কমান্ডারের দলে। আমরা ছিলাম ৩০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা। তখন কারফিউ থাকত সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত। দিনের বেলাতেই বেশ বদলে গোপনে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ডিনামাইট লাগিয়ে দিতাম। আর রাতে তার বিস্ফোরণ ঘটাতাম। ওরা কইত, ‘মুক্তিবাহিনী কিয়া চিজ। জিন না ইনসান। কিদারছে আতাহে, কিদার জাতাহে, মালুম না আতাহে।’ ২ নং সেক্টরের অধীনে এভাবেই আমরা অপারেশন করি সোনারগাঁও, কাছপুর ও ডেমরার বিভিন্ন এলাকায়। এছাড়াও বিচ্ছু বাহিনীতে গোয়েন্দার কাজ করতাম।’’
বিচ্ছু বাহিনীর কাজ কী ছিল?
মুক্তিযোদ্ধা তারার উত্তর–
‘‘২নং সেক্টরে ছিল পিচ্চি পিচ্চি পোলাপাইন। কিন্তু সবাই ছিল বারুদ। বিচ্ছু জালালের কথা সবার জানা। বেছে বেছে ছেলে নিয়ে গঠন করা হয় বিচ্ছু বাহিনী। এদের মূল কাজ ছিল পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রেইকি করে তাদের অস্ত্র, পজিশন ও সৈন্য সংখ্যাসহ সব রকম তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে আসা। বিচ্ছু বাহিনীর সদস্য সংখ্যা খুব কম ছিল। কিন্তু তাদের সাহস ও দেশপ্রেম ছিল অনেক বেশি।’’
বিচ্ছু বাহিনীতে আপনাকে কেন নিল?
মুচকি হেসে তিনি যা জানালেন, তা সংক্ষেপে এই– জুট মিলে পাকিস্তানিদের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তিনি ভালো উর্দু জানতেন। ভাষার কারণে মৃত্যুভয়ও কম ছিল। সাহসও ছিল বেশি। ভাষা আর বেশ পরিবর্তন করে মিশে যাওয়ার স্পেশাল ট্রেনিংও ছিল তাঁর। বাবুর্চি সেজে তিনি নিউ মার্কেটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দুদিন থেকে পুরা তথ্য নিয়ে যেতেন। এছাড়া গেণ্ডারিয়া ক্যাম্পেও রেইকি করতেন। তথ্য দিতেন স্পাই সেলিমকে। রেইকি করতে মাঝে মধ্যে ঢাকার বাইরেও যাওয়ার নির্দেশ আসত।
পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে তারা মিয়ার বেঁচে যাওয়ার একটি ঘটনা শুনলাম। সেটি সংক্ষেপে এই–
জুলাই মাসের কথা। গাজীপুরের বরমীতে সায়দুল্লাহ চরের এক স্কুলে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। তারা মিয়া সেখানে রেইকি করতে যান হাবিলদার মফিজের সঙ্গে। দুপুরে খেতে যাবেন। কিন্তু কোনো হোটেলেই মাছ মিলল না। তখন পুকুরের মাছ খাওয়া বন্ধ। মানুষ মেরে ফেলে দেওয়া হত পুকুরে। তাই সবার ধারণা মাছেও মানুষ খেয়েছে। মাংস নিয়ে দুজন খেতে বসেছেন। অমনি পাঁচজন পাঞ্জাবি বন্দুক তাক করে বলে, ‘হোল্ড’।
তারা জানতে চান, ‘কেয়া হোয়া খান সাব?’
ওরা বলে, ‘তুম লোক মুক্তি ফৌজ।’
উত্তর দেন তারা মিয়া, ‘মুক্তি ফৌজ ক্যায়া চিজ হ্যায়? জিন্দেগি মে নেহি মিলা।’
ওরা জিজ্ঞেস করে, ‘তুম কেয়া করতা হ্যায়?’
‘লতিফ জুট মিলকা নকরি করতা হ্যায়।’
তারা মিয়ার আইডি কার্ড দেখে বলে, ‘যাও, তুম তো আপনা আদমি হো।’
তাঁকে ছাড়লেও মফিজকে ছাড়ে না। অগত্যা তিনি সুপারিশ করলেন, ‘ছোড় দো সাব, বোখার আদমি।’
ওরা তখন রেগে যায়, ‘বাইনচোদ, আপনা রাস্তা মাপ।’
মফিজের পরিণতি কী হয়েছিল আজও জানেন না তারা মিয়া।
আহত হওয়ার ঘটনাটি জানতে চাই আমরা। খানিকটা নিরব থেকে তারা মিয়া বলেন–
‘‘আমরা ছিলাম তারাবোতে। পিছনে ভারতীয় আর্মি। মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটা দলও যোগ দিছে। শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে লতিফ ভবানি জুট মিল। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ক্যাম্প। আমরা ক্যাম্পটা দখল কইরা অ্যাডভান্স হইয়া ঢাকা দখলে নিব, এমন ছিল পরিকল্পনা। যুদ্ধ কইরাই আমাদের দেড় দিন চইলা যায়।

১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সকাল তখন ১১টার মতো। আমি ফেরিঘাটের কাছে পজিশনে। সঙ্গে মেশিনগান। ওরা গুলি ছুঁড়লে আমরাও ছুঁড়ি। পাকিস্তানি সেনারা খুব সাহসী ছিল। ওরা ফেরি দিয়া এই পারে আসতে চাইত। কিন্তু আমরা ওগোরে ঠেকায়া দিতাম। এই ভাবেই চলসে। চোখের সামনে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হইল। ভাবতেছিলাম, আমাদের ভাগ্যে কী আছে কে জানে!
হঠাৎ বৃষ্টির মতো আর্টিলারি পড়তে থাকে। আমি তখন শরীর লুকাই একটা দেওয়ালের পাশে। কিছু বুইঝা ওঠার আগেই একটি আর্টিলারি প্রথমে আইসা পড়ে দেওয়ালে। পরে তার কিছু অংশ ছিটকা আইসা আঘাত করে আমার পেছনে, মাজার জয়েন্টে। চিৎকার দিয়া আমি উপুড় হইয়া পড়ি। অমনি পুরা দেওয়ালডাও ধইসা পড়ে আমার শরীরের ওপর।
জ্ঞান তখনও ছিল। সহযোদ্ধারা তুইলা নিয়া পাঠায়া দেয় নরসিংদী হাসপাতালে। চিকিৎসার পর ক্র্যাচে ভর দিয়া হাঁটতে পারতাম। তখন ভাবছিলাম বুঝি ভালো হইয়া গেছি। কিন্তু স্পাইনাল কর্ডে যে ইনফেকশন হইয়া গেছিল টের পাই নাই।’’
স্বাধীনতালাভের পরের জীবনযুদ্ধের কথা বলেন এ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়–
‘‘অনেক কষ্ট করছি, বাবা। ঢাকায় আইসা প্রথমে ফলের দোকান দিছিলাম। পরে চা সিগারেটের দোকান দেই মিরপুরে। তহনও ক্র্যাচে ভর দিয়া চলতে পারতাম। ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে থাকল। আস্তে আস্তে পঙ্গুই হইয়া গেলাম।’’

তারা মিয়ার ভাষ্যের ভিডিও–

তিনি জানালেন, আবাসনের জন্য গত বছর প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছিলেন। তাঁর কার্যালয় কলেজ গেটের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত বহুতল ভবনে একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দের সুপারিশ করে একটি পত্র (স্মারক পত্র নং- ৩২৩, তারিখ- ১০ নভেম্বর, ২০১৩) পাঠায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু অদ্যাবধি সে বরাদ্দ মিলেনি।

যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন সে স্বপ্নের দেশ পেয়েছেন কি?
এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া–
‘‘দুই পা গেছে অসুবিধা নাই। দেশ তো স্বাধীন হইছে। এহন নাতিরা বলে মুক্তিযোদ্ধারা পাগল ছিল। ঠিকই কইছে, পাগল না হইলে কি দেশ স্বাধীন হইত? দেশ স্বাধীন হইছে, আমার আর কোনো আফসোস নাই বাবা।’’
কথা উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে। তিনি বলেন– ‘‘বঙ্গবন্ধুর আমলে যদি তালিকা করত সবচেয়ে বেটার হইত। তহন তো মুক্তিযোদ্ধাগো চেনা পরিচয় ছিল। এহন মুক্তিযোদ্ধারা বুড়া হইছে, ভেজালও বাড়ছে। ধরেন, আপনার আত্মীয়র মধ্যে একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হইছে। স্বার্থের কারণে আপনি সেইটা জানাইবেন না। এই ভাবেই তো ভুয়া বাড়ছে।’’
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বললেন মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া–
‘‘আমি তহন মিরপুরে পান সিগারেটের দোকান করি। একদিন রংপুরের আবদুর রাজ্জাক নামে তালিকাভুক্ত এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন। কথায় কথায় জানতে চাই কত নম্বরে যুদ্ধ করেছেন। সে বলে, ‘১৪ নম্বর সেক্টরে।’ শুনেই তো রক্ত মাথায় উঠে যায়। বলেছিলাম, ‘তুই নিজেই তো চৌদ্দ নম্বর। লেওরার মুক্তিযোদ্ধা।’
তখনই জানতে চাই তেতাল্লিশ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বাড়ার কারণ কী বলে তিনি মনে করেন। তারা মিয়ার উত্তর– ‘‘এইডা আমলা আর কমান্ডার গো গিয়া জিগান। পড়াশোনা কইরা সচিব হইছে। কত সম্মানিত পদ। অথচ দেহেন ওনাদের মতো লোকেরাও চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর লোভে ভুয়া সার্টিফিকেট নিছে। যে দেশে সচিবরা চোর হয়, সে দেশের আর কী থাকে! শুধু তারা না, যে সব কমান্ডারদের স্বাক্ষরে ভুয়ারা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাইছে তাদেরও ধরা উচিত।’’
স্বাধীনতার পরবর্তী সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন– ‘‘ভালো হইত বঙ্গবন্ধু যদি তাড়াতাড়ি প্রধানমন্ত্রী না হইয়া তাজউদ্দিন সাহেবকে দিয়ে দেশ পরিচালনা করাইতেন। তাইলে তিনি শুধু নেতার কাতারেই থাকতেন।’’
কথা ওঠে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে। তারা মিয়া তখন আবেগে আপ্লুত হন। অতঃপর অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত–
‘‘আমরা তো গাদ্দার। যার কারণে দেশ স্বাধীন হইছে, তাঁরেই মাইরা ফেলছি। পাকিস্তান থেইক্যা যেসব আর্মিরা ফিরা আসছিল তাগো রে আবার সেনাবাহিনীতে নেওয়াই ছিল বড় বোকামি। বঙ্গবন্ধু উদার ছিলেন। তাঁর ভালোবাসার সুযোগ নিয়াই ওরা তাঁরে খুন করসে। আমাদের মনে তো তহন আগুন জ্বলছে।’’
তখন কি আপনারা প্রতিবাদ করেছিলেন?
‘‘না, আমরা পারি নাই। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল। সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা ছিল কোনঠাসা। পরে জিয়াউর রহমান তো বাইছা বাইছা মুক্তিযোদ্ধা আর বঙ্গবন্ধুর কাছের অফিসাদের মারছিল।’’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া বলেন–
‘‘বঙ্গবন্ধু বিচার শুরু করছিলেন, শেষ করতে পারেনি। ৪০ জনের নাগরিকত্ব তিনি বাতিল করছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজাকারদের রাজনীতিতে আনেন। তার কারণেই আমাদের পতাকা উড়ছে রাজাকারদের গাড়িতে। কত কষ্ট পাইছি আমরা! এই লজ্জা কোনোদিনও মুছবার না।’’
স্বাধীন দেশে ভালো লাগা জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন–
‘‘১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চ আসলে সব জায়গায় লাল-সবুজ পতাকা ওড়ে, সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা হয়। তখন মনটা ভরে যায়। কিন্তু ঢাকা ছেড়ে স্মৃতিসৌধ কেন সাভারে করা হল সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও পাই নাই।’’খারাপ লাগার অনুভূতি জানাতে তিনি বলেন–
‘‘ভোট নেওয়ার পর সাংসদরা আর গ্রামে যায় না। যারা ক্ষমতায় যায় তারাই লোভ করে, দুর্নীতি করে। টাকা ছাড়া সরকারি চাকরি হয় না। এই সবের জন্য তো আমরা রক্ত দেই নাই। বিএনপির আমলে প্রধানমন্ত্রী আমগো কইত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা। মনে হইত আমরা ভিক্ষুক। এমন অসম্মানে সত্যি কষ্ট লাগত।’’
পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে বুকভরা আশা নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তারা মিয়া বলেন–
‘‘তোমরা নিজেদের যোগ্য কইরা তোল। ভালো-মন্দের ভেদাভেদ বুইঝা ভালোটা নাও। মিথ্যাকে ঘৃণা কর। মনে রাখবা, মিথ্যা দিয়া কোনো জাতি বেশি দূর আগাইতে পারে না।’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ২৪.কমের মতামত-বিশ্লেষণ কলামে, আগস্ট ১৬, ২০১৪

© 2014 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button