আদিবাসী

আদিবাসীদের মুখেও ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা

বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাকে সামনে রেখে নানা আয়োজন চলছে প্রায় সবখানে। পাড়ায় পাড়ায় চলছে পতাকা টাঙানোর হিড়িক। কোনোটি উঁচু বিল্ডিং থেকে লম্বালম্বি নামিয়ে দেওয়া, কোনোটি দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে আড়াআড়িভাবে টাঙানো। দলবেঁধে অনেকেই গোটা পাড়াতেই আর্জেনটিনা ও ব্রাজিলের পতাকা দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। যেন অন্য কোনো দেশের ঠাঁই নেই সেখানে। অনেকেই প্রধান সড়কে জ্যাম বাধিয়ে প্রিয় দেশের বড় পতাকা নিয়ে সবাইকে জানান দিচ্ছে আমরাই সেরা। পতাকা উড়ছে বাড়ির ছাদে, বারান্দাতে, গাড়িতে, মটরসাইকেলে, রিকশা ও অটোরিকশাগুলোতে। এটি বেশ পুরনো রেওয়াজ। নিয়ম না থাকলেও বাংলাদেশের সবখানেই এখন ভিনদেশি সব পতাকা উড়ছে। ফুটবলের প্রতি এ যেন বাঙালির চরম উম্মাদনার বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্বকাপে আদিবাসীদের ভাবনাগুলো জানতে বের হয়েছি দিনাজপুরে প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামগুলোতে।
লোহাডাঙায় তুরি গ্রামটির মাহাতো লবানু শিং। বয়স সত্তরের ওপর। একসময়কার দুর্দান্ত ফুটবল খেলোয়াড় তিনি। পুরোন স্মৃতি মনে করে লবানু বলেন সে সময়কার কথা।
একবার লোহাডাঙার সঙ্গে খেলা হয়েছিল পাশের মুরাদপুরের তুরি আদিবাসীদের। লবানুরা দুই গোলে জিতে সে ম্যাচটিতে। একটি গোল করে লবানু নিজেই। ‘ফুটবল’ ইংরেজী নাম হওয়ায় এ নামটির  সঙ্গে তুরিরা তত বেশি পরিচিত নন। ফুটবলকে এরা জানে ‘বল খেলা’ হিসেবে।
একসময়কার নামকরা খেলোয়াড় হলেও লবানুর বয়সী আদিবাসীরা বিশ্বকাপ সম্পর্কে খুব কমই জানে। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। টেলিভিশন নেই। তাই খেলাও দেখতে পারে না তারা। লবানু বলতে পারে না বিশ্বকাপে প্রিয় দেশের নাম। বারান্দায় বসা ছিল তার ছেলে কাজল শিং। খেলার কথা শুনতেই সে এগিয়ে আসে। মুচকি হেসে জানায় বিশ্বকাপে তার প্রিয় দলটি ‘আর্জেন্টিনা’। শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে না পারলেও জানে মেসির নামটিও।
বাড়ির ভেতর উঁচু করে তৈরী করা ছোট্ট একটি জায়গা। পাশেই সন্ধ্যা তারা ফুলগাছ। এটি তুরিদের ‘তুলসি থান’ বা ‘প্রার্থনার স্থান’। প্রিয় দলের জন্য সেখানে রঙিন জার্সি পড়ে ভক্তি দিচ্ছে গোত্রের সবানু শিং। নকুল শিং, পলাশ শিং, কাজল শিংসহ যুবক বয়সীরা বিশ্বকাপ খেলা দেখে রতন শিংয়ের বাড়িতে। জায়গা না পেলে কেউ কেউ আবার চলে যায় বাজারের দিকে।
অন্য দেশের নাম না জানলেও বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের নাম প্রায় সবার মুখে মুখে। আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে একমাত্র রতন শিংয়ের বাড়িতেই টিভি আছে। তাই খেলা দেখতে সবাই ভিড় জমায় তার বাড়িতে। খেলার কারণে এ সময়ে রতনের মান-সম্মানও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। খেলার দেখার সুযোগ পেতে সবাই তার খাতির করে।
কথা হয় খেলাপাগল কয়েকজন আদিবাসী যুবকের সঙ্গে। অভাবের কারণে নিজ পছন্দের দলটির পতাকা কিনতে পারেনি তারা। সে নিয়ে তাদের বেশ মন খারাপ। কিন্তু তা সত্ত্বে¡ও বিশ্বকাপ নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই তাদের মধ্যে । শকিন্ত শিং তুরি ভাষায় বলে, ‘আর্জেনটিন যুদি জিতেএ, তালে খুব আনন্দ কেরবে, হাড়িয়া খাবে’। নয়ন শিং বলে, ‘মেসি বালাক খেলেল পারছে’। পাশ থেকে রাজন শিং চেঁচিয়ে ওঠে, ‘বাজিল জিতেবেএ’। bisho cup-2গোত্রের পলাশ শিং বিশ্বকাপে কোন দলের সার্পোট করবে তা এখনও স্থির করতে পারেনি। মেক্সিকোর সঙ্গে ব্রাজিলের খেলা তার কাছে ভালো না লাগায়, এখন সে আর্জেটিনার ভক্ত। বিশ্বকাপ ফাইনালে কোন দল জিতবে? এ রকম প্রশ্নের উত্তরে আদিবাসী তুরিদের মাঝে হট্টগোল বাধে।
হালজায় গ্রামের কড়া পাড়ায় বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো উত্তাপ নেই।  বাংলাদেশে টিকে থাকা আদিবাসী কড়াদের মাত্র ১৬ টি পরিবারের বাস এখানে। কড়াদের অনেকে অন্যের জমিতে কাজ করে। কেউ কেউ আবার ভ্যান চালিয়ে যা আয় করে তা দিয়েই কোনো রকমে চালিয়ে নেয় সংসার।
নিজ গ্রামে টিভি না থাকলেও পাশের গ্রামে গিয়ে বিশ্বকাপ খেলা দেখে কৃষ্ণ কড়া, ওদো কড়া, কামান কড়া, কাইচাল কড়া। প্রায় অধিকাংশেরই পছন্দের দল ব্রাজিল। পতাকা নাই কেনো প্রশ্ন করতেই কৃষ্ণ কড়ার জবাব, ‘টাকা নাই, তাই পতাকা নাই’।
কড়াদের এই গ্রামেই রয়েছে একটি ফুটবল টিম। দলটির বেশ নামডাক রয়েছে। টিমটির বিষয়ে গোত্র প্রধান জগেন বলেন, ‘বল খেলাল জেবে আজ হামনে টিম হে’। বিশ্বকাপে কোন কোন দেশ অংশ নিচ্ছে তা জানা নেই গোত্রের রঞ্জন কড়ার। কোন দল জিতবে এমন প্রশ্নে সে চিন্তিত, কি উত্তর দিবে ভেবেই যেন পাচ্ছে না। হঠ্যাৎ বলে ওঠে, ‘ভারত জিতবে’। উত্তর শুনে চারপাশে হাসির রোল ওঠে।
বহবলদিঘীর ওঁরাও পাড়ার নিপেন টিগ্গা। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া অনেক দেশেরই নাম জানে সে। ১৯৮০ সালে দিনাজপুর স্টেডিয়ামেও খেলার অভিজ্ঞতা আছে তার। তার মতে, ফুটবল সবার জন্য উপভোগ্য একটি খেলা। যারা দেখে তারা যেমন সহজে বুঝে, যারা খেলে তাদের জন্যেও সহজ। কোন দলের খেলা পছন্দ প্রশ্ন করতেই পাশ থেকে ভিম লাকড়ার উত্তর, ‘সবে আর্জেন্টিনা’।
নিপেন জানালো এ গ্রামে তাদেরও একটি শক্তিশালি ফুটবল টিম রয়েছে। ‘টিনপাড়া ফুটবল টিম’ বললেই সবাই একনামে চেনে। ফুটবল নিয়ে গোত্রের মহত বলেন,‘এমা খাদদার বল ভাল বেজ নার’ (আমাদের ছেলেরা ফুটবল ভাল খেলে)।  ওঁরাও যুবকেরা সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যা হতেই বেরিয়ে পড়ে খেলা দেখতে। গ্রামের মধ্যে কোনো টিভি না থাকায় সবাই ভিড় জমায় প্রায় ২ কিলোমিটার দূরের বাজারে।
মহেশপুর গ্রামের সাঁওতালরা অন্য জাতির তুলনায় বেশ অগ্রসর। বিশেষ করে যারা ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছেন তাদের অনেকের বাড়িতেই রয়েছে টেলিভিশন। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা হয় গোত্রের মহত শাহ বাছকির সঙ্গে। তিনি বলেন,‘বল এনেক এটি মজ, হর ডি মছকো এনেক দাড়িয়া’ (ফুটবল খেলা আমাদের খুবই পছন্দের, সাঁওতালরা ভাল বল খেলে)। অন্য কোনো দেশের নাম বলতে না পারলেও এ গ্রামের সাঁওতালরা হর হর করে বলে দেয় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার নামটি। সাঁওতালী তরুণদের মুখে মুখে মেসির নাম। গোত্রের দালু সরেনের মতে নামের উচ্চারণ সহজ হওয়াতেই মেসি এখানে বেশ জনপ্রিয়। আবার মুগলী মুরমুর মতো ব্রাজিলিয়ান সমর্থকরা ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলার কাকাকে ‘কারকা’ নামে মনে রেখেছে। বাছকি জানায় বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন গোটা গ্রামে চলবে আনন্দ উল্লাস, চলবে হাড়িয়া খাওয়া। bisho cup-1পিপল্লা গ্রামের ভুনজার আর কাশিডাঙ্গা গ্রামের মুশহর আদিবাসীরাও পিছিয়ে নেই বিশ্বকাপ খেলা দেখায়। শহরের নিকটবর্তী গ্রাম হওয়াতে এখানকার আদিবাসী গ্রাম দুটিতে উড়ছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার ছোট্ট ছোট্ট পতাকা। চাঁদা দিয়ে পতাকা কিনেছে ভুনজার আর মুশহর যুবকেরা। একইভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে বিশ্বকাপ ফাইনালের আনন্দ উদযাপনের।
বিরল উপজেলার একজন ক্রীড়া সংগঠক শফিকুল আজাদ মণি। তিনি জানালেন, এ অঞ্চলে ভালো ফুটবল খেলোয়াড়দের তালিকায় আদিবাসীদের নামই শীর্ষে। বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন টিনপাড়া ফুটবল টিমটির সফলতার কথা। তিনি মনে করেন সঠিক নির্দেশনা আর সহযোগিতা পেলে আদিবাসীদের মধ্য থেকে উঠে আসতে পারে দেশের প্রতিভাবান ফুটবল খেলোয়াড়।
বিশ্বকাপ খেলা উপলক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের নেক দৃষ্টি পড়েনি আদিবাসী গ্রামগুলোতে। অন্য গ্রামগুলোতে জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া টেলিভিশন পৌঁছালেও বঞ্চিত হয়েছে পিছিয়ে পড়া আদিবাসীরা।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এ অঞ্চলের আদিবাসীরা পিছিয়ে নেই বিশ্বকাপ খেলা দেখায়। প্রযুক্তির কল্যাণে তীর ধনুকের মানুষদের দৃষ্টিও আজ বিশ্বকাপের দিকে। রাতভর অন্য গ্রামে গিয়ে খেলা দেখা আর দিনের বেলায় প্রীতি ম্যাচের আয়োজন চলছে আদিবাসী গ্রামগুলোতে। তাদের মুখেও উচ্চরিত হচ্ছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার নাম। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাস তাদের জানা নেই। তাদের ভালো লাগা শুধুই ফুটবলে। এভাবে বিশ্বকাপ ফুটবলের আনন্দ কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিচ্ছে বুকের ভেতর জমে থাকা আদিবাসীদের চাপা কষ্টগুলোকে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক এই সময়ে, ২২ জুন ২০১৪, বর্ষ- ১, সংখ্যা-২৫

WARNING : If anyone wants to share this content, please contact me. If any unauthorised use or reproduction of salekkhokon.me content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

© 2014 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button