কলাম

প্রযুক্তির অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকুক শিশুরা

প্রযুক্তিতে এখন আর পিছিয়ে নেই আমরা। দিন-দিন বাড়ছে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যাও। বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা। গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে এর ব্যবহার। পৃথিবী এখন সবার হাতের মুঠোয়। ডিজিটাল দুনিয়ায়- নেই কোনও মানা, নেই কোনও সীমানা। চাইলেই গুগল থেকে জেনে নেওয়া যায় সবকিছু। জ্ঞান, যোগাযোগ, সেবা ও বিনোদনের কমতি নেই এখানে। জীবনকে সহজ করেছে প্রযুক্তি। কিন্তু আজ প্রযুক্তির ব্যবহারে জটিল হয়ে যাওয়া একটি গল্প বলবো।
এক সাংবাদিক বন্ধুর পরিবারের গল্প এটি। সঙ্গত কারণেই নাম উল্লেখ করছি না। তার মেয়ের বয়স ১২ বছর। পড়ছে ক্লাস সেভেনে। ঢাকার নামকরা এক স্কুলে । বন্ধুপত্নী চাকরি করেন। ব্যাংকার। জীবিকার তাগিদে দুজনকে বাইরে-বাইরে থাকতে হয়। এসময় বাড়িতে থাকেন দূরসম্পর্কের এক খালা। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসার কাজটি বন্ধু ও তার খালাই করে থাকেন। বাবা-মা কেউ খুব একটা সময় দিতে পারেন না মেয়েটিকে। এ নিয়ে কষ্টবোধও তাড়া করে তাদের।
একদিন মেয়েকে খুশি করতে তার জন্য তারা কিনে আনেন একটি মোবাইল ফোন। নিয়ে নেন ইন্টারনেট প্যাকেজও। এখন থেকে স্মার্টফোনে মেয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে যখন-তখন। তার আর মন খারাপ হবে না। মেয়ের নামে তারা খুলে দেন একটি ফেসবুক আইডিও। গেম ও গুগলের ব্যবহারও সে আয়ত্ত করে ফেলে খুব সহজে । সারাদিনে বাবা-মার মায়া ভুলতে সে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্য এক ভুবনে।
মাত্র কয়েক মাসে বন্ধুটি লক্ষ্য করে তার মেয়ের পরিবর্তনগুলো। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সে ব্যস্ত থাকে ফেসবুক নিয়ে। সেখানে তার অপরিচিত শত শত বন্ধু। ঘরের খালা তাকে জানায় মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করে মুভিও দেখে সে। বন্ধুটির মনে খটকা লাগে। এরপর অবসরে কিংবা ছুটির দিনে মেয়েকে সে কাছে পায় না। ডাকলেও সে বিরক্ত হয়। ডিজিটাল ভুবন ছেড়ে কিছুতে সে অন্যকিছু করতে চায় না। এভাবে এক আসক্তি তৈরি হতে থাকে তার মেয়ের। ফলে পড়াশোনায়ও মনোযোগ কমতে থাকে।
আবার মেয়েটি ফোন নিয়ে যায় তার স্কুলে। সেখানে অন্য বান্ধবীদের সঙ্গে লুকিয়ে দেখে বিভিন্ন পর্ণ সাইট। বাড়িতে ফিরে শুরু হয় বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং। এভাবে শিশু বয়সে তৈরি হয় অপ্রত্যাশিত কিছু সম্পর্ক। নিজের অজান্তে তারা মেয়েটি ভাসিয়ে দেন অজানা ভুবনে। পরিবার কিংবা পড়াশোনা কোনওটা তার আগ্রহের মধ্যে নেই। মেয়েটির এই ভুবনের সন্ধান বাবা-মার কাছেও থাকে না। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হতেই টনক নড়ে বাবা-মার । সাংবাদিক বন্ধুটিও তখন বুঝতে পারে তার ভুলগুলো।
বন্ধুর মেয়েটির বয়স যেহেতু ১২ বছর সেহেতু তাকে শিশু বলাই ভালো। উপরের ঘটনাটির মতো না হলেও আমরা অনেকে কিন্তু শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছি ইন্টারনেটযুক্ত স্মার্টফোন। ১৮ বছর না হলেও জন্মতারিখ গোপন রেখে সচেতনভাবেই খুলে দিচ্ছি একটি ফেসবুক আইডি। ফলে ফেসবুক দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলছে শিশুরা। যে সময়ে সে গল্পের বই পড়ত, ছবি আঁকত কিংবা বাইরে খেলতে যেত সে সময়ে সে ঘুরে বেড়ায় ফেসবুক রাজ্যে। এভাবে শিশুদের চিন্তার জগত বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। শিশুদের সৃজনশীলতাও নষ্ট হচ্ছে প্রবলভাবে। অভিভাবকদের অসচেতনার কারণে শিশুরা দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে তাদের নিজের জগতটাকে।
আবার শিশুদের বয়ঃসন্ধিকালে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। ঠিক সে সময় যদি খুব সহজে তারা হাতের মুঠোয় পর্নো সাইট পেয়ে যায়, তবে তাদের মনোজগতের যে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা কিন্তু পূরণ হওয়ার নয়। এছাড়া এর মধ্য দিয়ে শিশু নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ারও ঝুঁকিতে থাকে। তাই স্মার্টফোন দিয়ে শিশুদের স্মার্ট বানানোর চেষ্টা না করে অভিভাবকদের উচিত সহজভাবে শিশুদের প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোর বিষয়ে সচেতন করে তোলা। কিন্তু বাস্তবে পরিবার কিংবা বিদ্যালয়গুলো থেকে তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
আমাদের অধিকাংশ বিদ্যালয়গুলো ‘এ প্লাস’ এর দৌড় প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তাদের কাছে শিশুদের মনোজগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়! গুটিকয় ছাড়া অধিকাংশ বিদ্যালয় তাদের শিশুদের হাতে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস দেওয়ার বিষয়ে অভিভাবকদের কোনও নির্দেশনা কিংবা পরমর্শ প্রদান করেন না। শিশুরা কী দেখবে, কী ভাববে, কী চিন্তা করবে- এ নিয়ে তাদের কিংবা রাষ্ট্রের কোনও চিন্তা নেই। অথচ উন্নত বিশ্বে শিশুদের মোবাইল ব্যবহারে যেমন বিধিনিষেধ আছে, তেমনি কোনও সাইটগুলোতে শিশুরা ঢুকতে পারবে কোনটিতে পারবে না- এ নিয়ে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা।
আবার অনেক অভিভাবক শিশুদের হাতে আইফোন কিংবা স্মার্টফোন তুলে দিয়ে নিজেদের আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটাতে পছন্দ করেন। ফলে শিশুরা খুব সহজে আসক্ত হচ্ছে ফেসবুক, পর্নো সাইট ও নানা নিষিদ্ধ সম্পর্কে।
প্রযুক্তির পথেই আমাদের এগুতে হবে। কিন্তু সেটি করতে হবে প্রযুক্তির ক্ষতি থেকে শিশুদের বাঁচিয়ে। সরকারকে এই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয় যদি এ বিষয়ে অভিভাবকদের নিয়মিত সচেতন করে তোলেন, অভিভাবকরা যদি সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ে সচেতন হন তবে আমরা প্রযুক্তির কালো থাবা থেকে শিশুদের রক্ষা করতে পারব। আর এই কাজটি করতে হবে সকলে মিলে, সম্মিলিতভাবে। তাই, আসুন শিশুদের ভবিষতের কথা ভেবে প্রযুক্তি বিষয়ে আমরাও সর্তক থাকি, সচেতন হই। প্রযুক্তির আসক্তি থেকে মুক্ত থাকুক আমাদের শিশুরা।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন-এ, প্রকাশকাল: দুপুর ০১:৩৬ আগস্ট ০৬, ২০১৫

© 2014 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button