ভ্রমণকথা

মনোবাসনা পূরণ হয় শঙ্খবাণী মেলায় !

৩০০ বছর আগের কথা। এখানেই ছিলেন এক রাজা। নাম শঙ্ক। তারই আদরের একমাত্র মেয়ের নাম ছিল শঙ্খবাণী। সে একদিন বাড়িতে নিজের কাপড় ধোয়ায় ব্যস্ত ছিল। সে সময় রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এক শাঁখারি শাঁখা ফেরি করতে করতে যাচ্ছিল। রাজার মেয়ের শাঁখা পরতে ইচ্ছে হল। সে কুমারী অবস্থায়ই তার কাছ থেকে শাঁখা কিনে পরল। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে চার পাশে। এতে রাজা ক্ষিপ্ত হয়। রাগান্বিত হয়ে মেয়েকে মারতে যায়। বাবার আচরণে শঙ্খবাণী কষ্ট পায়। মনের দুঃখে সে পাশের দীঘিতে ঝাঁপ দেয়। ঝাঁপ দেওয়ার সময় সে রাজার উদ্দেশে বলে যায়, ‘আজ আমাকে অপমান করলে, একদিন তুমি আমাকেই পূজা দেবে।’

কাঁটাতারের বেড়ার ওই পাশেই ভারতের রাধিকাপুর। দূর থেকেই সেখানকার থেমে থাকা ট্রেনগুলো দেখা যায়। এ পাশে দিনাজপুরের রামচন্দ্রপুর গ্রাম। দেশভাগের আগে রাধিকাপুর আর রামচন্দ্রপুর দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন আমল থেকে প্রতি বছর এই রামচন্দ্রপুরেই বসে শঙ্খবাণী মেলা। এক সময় শঙ্খবাণী ছিল দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা। সময়ের পরিক্রমায় রাধিকাপুরের লোকজন এখন আর আসতে পারে না।

শঙ্খবাণী মেলা

আদি বা হিন্দু পঞ্জিকার হিসাব মতে, বৈশাখ মাসের প্রথম মঙ্গল বা শনিবারে রামচন্দ্রপুরে শঙ্খবাণীর মেলা বসে। এবার মেলা বসেছে ১৬ এপ্রিল মঙ্গলবারে। ওইদিন গ্রামটিতে নামে মানুষের ঢল। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অপরিচিত জনদের পদচারণায় রামচন্দ্রপুরের নীরবতা ভাঙে। আশপাশের জেলাগুলো  থেকে  আসা  আবাল-বৃদ্ধ নানা সাজে ভিড় জমায় গ্রামটিতে। মেলাপাগল মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে গ্রামটির মেঠোপথে। সাইকেল, ভ্যান, মহিষের গাড়ি, মোটরসাইকেল কিংবা পায়ে হাঁটার পথ- যে যেভাবে পারছে দলবেঁধে ছুটে চলে মেলা অভিমুখে।

পুরনো জীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে বছরের শুরুতেই প্রাচীন এই শঙ্খবাণী মেলা দেখতে হাজির হয়েছিলাম দিনাজপুরের  রামচন্দ্রপুর গ্রামে। জীর্ণশীর্ণ গ্রাম্য রাস্তায় কাঁঠালপাকা রোদে চলেছি গরম জিলাপি, পাঁপড় আর পূজারিদের মুখ দেখব বলে। শঙ্খবাণী মেলায় যখন পৌঁছি তখন মধ্য দুপুর। বড় একটি বটগাছের ছায়ায় বসেছে মেলাটি। দীর্ঘদেহী ছড়ানো বটগাছটিই যেন মেলার প্রধান সৌন্দর্য। যতটা সাদামাঠা মনে হয়েছিল মেলার আয়োজন তার চেয়ে অনেক বড়। বটগাছের তলায় নানা বাহারি জিনিস নিয়ে বসেছে দোকানিরা। বাচ্চাদের খেলনার দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। বাঁশ আর কাঠের তৈরি নানা রঙের মনভোলানো খেলনা কিনতে বাচ্চারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।

পাশেই বেশ কয়েকজন দোকানি বসেছে শাঁখা আর কাচের চুড়ি নিয়ে। চুড়ির শব্দে ঢেউ লেগেছে তরুণীদের মনে। হাত বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে পছন্দের চুড়িগুলো। কেউবা দোকানির হাতেই পরে নিচ্ছে পছন্দের শাঁখা বা চুড়ি। মেলার এক পাশে রঙিন কাপড় টাঙিয়ে লাইন ধরে বসেছে কয়েকটি মিষ্টির দোকান। দোকানগুলোর ভেতরের পাম্প চুলায় শোঁ শোঁ শব্দ। সেখানে গরম তেলে নানা ধরনের জিলাপি ভাজা হচ্ছে। সাজিয়ে রাখা হয়েছে গুড়ের জিলাপি, ছানার সন্দেশ, চমচমসহ নানা রসের মিষ্টি। দূর থেকে দেখলেই জিভে জল এসে যায়। একটি দোকানে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঠান্ডা করে জিলাপি খাচ্ছে আগতরা। মেলার মাঝ বরাবর মাটির তৈরি খেলনা, কাঁসার প্রদীপ আর তালের পাখা নিয়ে বসেছে এক দোকানি। তাকে ঘিরে জেঁকে বসেছে ভিড়। ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে সবাই যেন কেনায় ব্যস্ত।

মেলার এক পাশে একটি উঁচু জায়গায় ছোট্ট একটি মন্দির। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে মন্দির আছে। এটিই শঙ্খবাণী মন্দির। ধারণা করা হয় মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো।  মনোবাসনা  পূরণের  ইচ্ছা  নিয়ে মন্দিরটিতে পূজা দিতে লাইন ধরেছে শত শত লোক। সবার হাতে পাতায় মোড়ানো ধূপ-সিঁদুর। ভিড় ঠেলে মন্দিরের ভেতরে যেতেই দেখা মিলে পূজারি ফগেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর। তিনি জানান শঙ্খবাণী পূজা নিয়ে প্রচলিত কাহিনীটি।

কথিত রয়েছে প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। এখানেই ছিলেন এক রাজা। নাম শঙ্ক। তারই আদরের একমাত্র মেয়ের নাম ছিল শঙ্খবাণী। সে একদিন বাড়িতে নিজের কাপড় ধোয়ায় ব্যস্ত ছিল। সে সময় রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এক শাঁখারি শাঁখা ফেরি করতে করতে যাচ্ছিল। রাজার মেয়ের শাঁখা পরতে ইচ্ছে হল। সে কুমারী অবস্থায়ই তার কাছ থেকে শাঁখা কিনে পরল। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে চার পাশে। এতে রাজা ক্ষিপ্ত হয়। রাগান্বিত হয়ে মেয়েকে মারতে যায়। বাবার আচরণে শঙ্খবাণী কষ্ট পায়। মনের দুঃখে সে পাশের দীঘিতে ঝাঁপ দেয়। ঝাঁপ দেওয়ার সময় সে রাজার উদ্দেশে বলে যায়, ‘আজ আমাকে অপমান করলে, একদিন তুমি আমাকেই পূজা দেবে।’

এর কিছুদিন পরেই এই স্থানে এক রাতে পাথরের মূর্তি ওঠে। সেই থেকে এখানে মা শঙ্খবাণীর পূজা হয়ে আসছে। প্রচলিত বিশ্বাস, যে যে ইচ্ছা নিয়ে এখানে আসে তার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়ে যায়। মূলত এই শঙ্খবাণী পূজাকে ঘিরেই প্রতি বৈশাখে এখানে একদিনের মেলা বসে। মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে ভিড় জমায় হিন্দু, মুসলমান আর আদিবাসীরা। একদিনের এই শঙ্খবাণী মেলাকে ঘিরে প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার লোকের সম্মিলন ঘটে।

শঙ্খবাণী মেলা

পূজার দিন হাজার হাজার লোক শঙ্খবাণীকে ফল, আতপ চাল, সিঁদুর, ধূপ, কাঁচা দুধ দিয়ে ভোগ দেয়। পাতায় মোড়ানো ধূপ-সিঁদুর মানত করে ছুড়ে দেয় শঙ্খবাণীর দিকে। কেউ কেউ রূপা বা স্বর্ণের পাদুকা বানিয়ে শঙ্খবাণী মূর্তির শরীরে লাগিয়ে দেয়। এরপর তাকে প্রণাম করে প্রসাদ নেয় পূজারির কাছ থেকে। মন্দিরস্থলে শুরু হয় এক ধরনের আচার।

হঠাৎ ঢাকঢোল আর বাঁশির করুণ সুর বেজে ওঠে। দেবংশী চন্দ্র কান্ত রায় মন্ত্রপাঠ করতে থাকেন। আর যুবক বয়সী চারজন হাতের মধ্যে কবুতর নিয়ে খালি গায়ে নানা অঙ্গভঙ্গিতে নাচতে থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস দেবতারা (শঙ্খবাণী, শ্মশানকালী, মশানকালী, বুড়িকালী) নাকি তাদের ওপর ভর করেছে। নাচ শেষে দেবংশী একে একে ভোগ খাইয়ে তাদের মুক্তি দেন বা বিসর্জন দেন। ভোগ হিসেবে খাওয়ানো হয় কলা, আতপ চাল আর ঘি। ভোগ মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যার ওপর দেবতা ভর করে সে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সকাল, দুপুর আর সন্ধ্যা- তিন পর্বে নামে দেবতারা।

অনেকে আবার মন্দিরের পাশেই বলি দেয় মানতের পাঁঠা। পূজা শেষে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেলার কেনাকাটায়। পাশের সেতাবগঞ্জ থেকে মেলায় এসেছেন ৭০ বছর বয়সী মালতি রানী। মনোবাসনার ধূপ-সিঁদুর মন্দিরে ছুড়ে দিয়ে নাতনির জন্য বাতাসা কিনছেন মেলা থেকে।

কী চাইলেন শঙ্খবাণীর কাছে?

উত্তরে শুধুই মুচকি হাসি। মনোবাসনার কথা বলতে হয় না, এটাই এখানকার নিয়ম। বিকেলের দিকে পুরোদমে জমে উঠে শঙ্খবাণী মেলা। তিল পরিমাণ জায়গা থাকে না মেলা প্রাঙ্গণে। হাজার হাজার মানুষ। অথচ কোনো ভেদাভেদ নেই। শঙ্খবাণীর টানে বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে সবাই যেন উজাড় করে দিচ্ছে নিজেকে। সূর্য ডোবার আগেই ফেরার পথ ধরি। লোকালয়ে ঢুকতেই দৃষ্টির সীমানা থেকে ক্রমেই হারিয়ে যায় শঙ্খবাণী মেলা।

 লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক এই সময়ে, প্রকাশকাল: ২৩ এপ্রিল ২০১৪

© 2014 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button