মুক্তিযুদ্ধ

আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে গণজাগরণ মঞ্চ

৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের এক বছর পূর্ণ হল। যাঁদের আত্মত্যাগের কারণে এ দেশটা স্বাধীন হয়েছে, দেশের জন্য যাঁরা হারিয়েছেন নিজের অঙ্গটি কিংবা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তেমনি কয়েকজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চোখে কেমন ছিল গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নেওয়া- গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন? আসুন, দেশমাতৃকার জন্য জীবনবাজী রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া মহান মুক্তিযোদ্ধাগণের মুখ-নিসৃত অভিব্যক্তিগুলো আমরা জানি :

আমাদের আলাপ হয় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মান্নান আলীর সঙ্গে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ৫নং সেক্টরের ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টরের ছাতক থানা অপারেশনের সময় সম্মুখ যুদ্ধে সুরমা নদীর তীরে পাকিস্তানী সেনাদের পুতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় তাঁর ডান পায়ের কিছু অংশ। তাঁর সারা-শরীরেও বিদ্ধ হয় স্প্লিন্টার। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা করেন।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তাঁর ভাষায়, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই আজ পথে নেমেছে তরুণরা। বিয়াল্লিশ বছর পর মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই গণজাগরণ মঞ্চ। মুক্তিযোদ্ধাদের মনের কষ্টের কথাগুলোই বলছে তারা। তাই তাদের প্রতি আমাদের দোয়া ও সহযোগিতা থাকবে সব সময়। তবে তথাকথিত রাজনৈতিক বলয়ের বাইরেই সব সময় তাদের থাকতে হবে।’
আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জি এম জুলফিকার। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ৬নং সেক্টরের লালমণিরহাট বড়খাতা রেলস্টেশনের কাছাকাছি পাকিস্তানীদের পঁচিশ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট দখলের সময় এম-ফোরটিন মাইনের বিস্ফোরণে তাঁর ডান পায়ের গোড়ালি উড়ে যায়। শরীর ও মুখে লাগে অসংখ্য স্প্লিন্টার। বর্তমানে হুইল চেয়ারেই তাঁর সঙ্গি। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন তাঁর কাছে স্বাধীনতার পক্ষে নতুন প্রজন্মের জেগে ওঠা। তাঁর ভাষায়, ‘এই ছেলেরা সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে সত্য সত্যই থাকে। দেরীতে হলেও সত্য একদিন জাগ্রত হয়- এটাই তার প্রমাণ। ভেবেছিলাম এদের বিচার হবে না। গণজাগরণ মঞ্চ আমাকে আশাবাদী করেছে। এখন আমি মইরা গেলেও এদেশে এদের বিচার হইবেই।’

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে পিছিয়ে ছিল না শিশুরাও
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে পিছিয়ে ছিল না শিশুরাও

কেউ কেউ তো এটাকে ‘নাস্তিক’দের আন্দোলনও বলার চেষ্টা করেছে– এমন প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তাঁদেরও তো তখন বলা হতো ইসলামের শক্রু। মুক্তিযোদ্ধারা ধর্ম মানে না এমন কথাও আমাদের শুনতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরাও আল্লাহু আল্লাহু বলেছি, গুলি খাইলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছি, সুরা কেরাত পরেছি, নামাজ পরেছি। আমরাও তো মুসলমানের পেটে জন্ম নিয়েছি। যারা এমন কথা বলে তারাই তো ধর্মটাকে বিকৃত করেছে। নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে ধর্মকে।’
১৯৭১সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জাহাঙ্গীর খান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন সিপাহী। আর্মি নম্বর-৬৫৭৮১০৩। ২৮ নভেম্বর ১৯৭১তারিখে ২নং সেক্টরের হালুয়াঘাট অপারেশনের সময় পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে তাঁর ডান হাতের কনুয়ের হাড়ের কিছু অংশ উড়ে যায় এবং কয়েকটি গুলি লাগে তলপেটে। ওই হাতটিতে অপারেশন হয়েছে মোট ২৬বার। হাতটা ঝুলেছিল কোনো-রকম। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের প্রতি দোয়া করে তিনি বলেন, ‘এই গণজাগরণ না হলে এদের বিচার করা যেত না। কাদের মোল্লার ফাঁসীও হতো না। তাই যে যাই বলুক গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন আজ ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আনোয়ার হোসেন খান যুদ্ধ করেছেন ১১নং সেক্টরে। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে হালুয়াঘাট দখলের সময় এক সন্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাদের একটি গুলি এসে লাগে তাঁর ডান পায়ে। ফলে ওই পায়ের হাঁটুর নীচের অংশ মারাত্মকভাবে জখম হয়। তাঁর বড় ভাই আক্তারুজ্জামানও গিয়েছিলেন যুদ্ধে। তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানীরা হত্যা করে তাঁর ৫ ও ৭ বছরের দুই ভাই চান্নু ও পান্নুকে। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে যাদের সহযোগিতায় মারা হয়েছিল তাদের বিচার তো আরও আগেই করা উচিত ছিল। বিয়াল্লিশ বছর পর হলেও এদের বিচার হচ্ছে এটা ভেবেই শান্তি পাই। এ জন্য আমি মন থেকে দোয়া করি গণজাগরণ মঞ্চের তরুণদেরকে।’ গণজাগরণ মঞ্চের স্লোগান প্রসঙ্গে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তাঁর ভাষায়, “জয় বাংলা স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। এটা উচ্চারণ করলেই কেউ আওয়ামী লীগের হয়ে যায় না। এটা তো জিন্দাবাদের দেশ না। জিন্দাবাদের বিরুদ্ধেই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমানও নিজেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন। তাই এটি বাঙালীর স্লোগান।”

গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে যুক্ত হয় সাংস্কৃতিক দলগুলোও।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে যুক্ত হয় সাংস্কৃতিক দলগুলোও।

আমাদের কথা হয় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের সঙ্গে। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ১১নং সেক্টরের মির্জাপুর থানা অপারেশনের সময় পাকিস্তানী সেনাদের রাইফেলের একটি গুলি তাঁর বাম হাতের জয়েন্টে লেগে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে তাঁর হাতটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা দেখে আনন্দে চোখ ভিজে যায় এ বীরের। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সব রাজাকারের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তোমরা নিশ্চয়ই সজাগ থাকবে। তোমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থেকো। মনে রেখো বিচার না হলেও খুনি খুনিই থাকে, রাজাকার থাকে রাজাকারই। এদের সম্পর্কে তোমরা সব সময় সর্তক থেকো।’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইউনুছ চৌধুরী (ইনু) যুদ্ধ করেছেন ৩নং সেক্টরে। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ভৈরব ব্রিজের কাছে এক অপারেশনে স্প্লিন্টারের আঘাত লাগে তাঁর কপালে। স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর বলেন, ‘যখন দেখি কণ্ঠ আকাশে তুলে নতুন প্রজন্ম জয় বাংলা স্লোগান তুলছে তখন মনটা ভরে যায়। বিয়াল্লিশ বছর পরে হলেও রাজাকারদের বিচারের জন্য গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা যখন আন্দোলন গড়ে তোলে- তখন বুকটা ভরে ওঠে।’

স্বাধীনতার জন্য এক চোখ হারিয়েছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নাজির আহমদ চৌধুরী। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে ৪নং সেক্টরের জকিগঞ্জের আটগ্রাম ডাকবাংলো অপারেশনের সময় পাকিস্তানী সেনাদের একটি গুলি তাঁর ডান চোখের পাতার নীচ দিয়ে ঢুকে নাকের হাড় ভেঙ্গে বাম পাশের গাল দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে নষ্ট হয়ে যায় তাঁর ডান চোখটি। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবীতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ প্রসঙ্গে নাজির বলেন, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সৎ সাহস তারা দেখিয়েছে। তাই তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তাদের আন্দোলন দেখে শান্তি পেয়েছি। মনে হয়েছে স্বাধীন এ দেশটাকে নতুন প্রজন্ম সত্যি অনেক দূর নিয়ে যাবে।’
কথা বলি আরেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহীমের সঙ্গে। ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ২নং সেক্টরের ফেনীর ছাগলনাইয়ায় এক সন্মুখ যুদ্ধে মাইনের আঘাতে তাঁর ডান পায়ের কিছু অংশ উড়ে যায়। রক্তের সাথে তখন ঝরঝর করে পড়ছিল হাড়ের ভেতরের মজ্জাগুলো। পায়ের রগগুলো ঝুলে ছিল শেকড়ের মতো। পরে ওই পায়ের হাঁটুর নীচ পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম পায়ে চলাফেরা করেন।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুরনো দোসরদের বিরুদ্ধে এ প্রজন্ম আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করছে। আমরা যা পারিনি তারা তা করে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। তাই তাদের মাথার ওপর ছায়ার মতো থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া।’
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সিরাজুল ইসলাম যুদ্ধ করেছেন ৫নং সেক্টরে। ১৭ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে সুনামগঞ্জের বৈশারপাড় গ্রামে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে তাঁর ডান হাতে মারাত্মক জখম হয়। ফলে তাঁর ডান হাতটি অকেজো হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে তরুণ প্রজন্মের জেগে ওঠা দেখে চোখ ভিজে যায় এ বীর মুক্তিযোদ্ধার। নতুন প্রজন্ম দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এমনটাই বিশ্বাস তাঁর। তাই চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ সবার ঊর্ধ্বে দেশ। তোমরা দেশের জন্য কাজ করবে সততার সঙ্গে। স্বাধীনতার পক্ষে থাকবে। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে। স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পর্কে তোমরা সর্বদা সজাগ থেকো।’

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দি রিপোর্ট২৪.কমে , ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

© 2014 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button