ভ্রমণকথা

পাহাড়পুরী গোপালপুর

মাঝপথে হঠাৎ বসে পড়ল জুয়েল। হালকা-পাতলা শরীর নিয়েও হাঁপাচ্ছে। বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে শুধু বলল, ‘আর কতটুকু’। আর দশটি পাহাড়ের মতোই এ পাহাড়। গায়ের সবুজ কেটে লালমাটির পথ। সে পথ বেয়েই চূড়ায় উঠতে হয়। পাহাড়ের গায়ে কয়েকটি মাচাঘর। বাঁশের তৈরি ঘরগুলোতে আদিবাসীরা থাকে। আশপাশে জংলি ফুলের বাগান। টকটকে অনেক লাল ফুল ফুটে আছে।পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছড়া। দূর পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। তার কলকল ধ্বনি নীরবতা ভাঙছে। পাহাড়ের মানুষ এ জলেই তিয়াস মিটায়।

জুয়েলকে নিয়ে এক সময় আমরা চূড়ায় উঠি। চারপাশের দৃশ্য মন ছুঁয়ে যায়। ক্লান্তি ভুলে অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। ছোট-বড় শত শত পাহাড়। কোনোটি আমাদের, কোনোটি ভারতের। দূরে সবুজে ঢাকা উঁচু একটি পাহাড় নজর কাড়ে। তার ছূড়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটি মাচাঘর। মাচাঘরের ওপাশে আরেকটি পাহাড়। সবুজ পাহাড়ের রাজ্যে অজানা পাখির ডাক বয়ে আনে ঠাণ্ডা বাতাস।
মাসখানেক আগে নেত্রকোনা গিয়েছিলাম। শিক্ষাবিদ যতীন সরকারের বাড়ি সেখানে। দাদার সঙ্গে গল্পে গল্পে বিকেল করে ফেললাম। ঢাকায় ফিরে যাব করতে করতেই ভাবনাটা মাথায় চাপল। এত কাছে এসে দুর্গাপুর-বিরিশিরি না দেখে ফিরে যাব! বন্ধু জুয়েল আর অরণ্যও সায় দিল। নেত্রকোনা থেকে বাসে চেপে সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম দুর্গাপুর। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে রাত কাটালাম।

 গোপালপুর, বিরিশিরি, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা
গোপালপুর, বিরিশিরি, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা

সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের সঙ্গী স্থানীয় নাট্যকর্মী গোপাল। তার মোটরসাইকেলে চড়ে ঘুরে দেখি সাত শহীদের মাজার, টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ, রাজবাড়ি, রানীক্ষ্যং মিশন ইত্যাদি। দুপুরের খাবার খেতে খেতেই গোপাল জানাল গোপালপুরের কথা। দুর্গাপুর থেকে গোপালপুর ১৫ কিলোমিটার। শহর থেকে আত্রাইখালী ব্রিজ পার হলে চায়না মোড়। মোড় থেকে ডান দিকের পথটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে গোপালপুরের দিকে। খানিক যেতেই আশপাশের দৃশ্যাবলি বদলে যেতে থাকে। ফসলের সবুজ মাঠের ওপাশে দূর পাহাড়। পাহাড় থেকে উড়ে আসে সাদা বকের ঝাঁক। বক দেখতে গিয়ে দূর পাহাড়ে বৃষ্টি পড়তেও দেখি। খানিক পর বাতাস বৃষ্টি ভাসিয়ে আনে আমাদের কাছে। আমরা পিছু হটলেও রেহাই পাই না। আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায় বৃষ্টি। যত এগোই ততই ভাবে বুজে আসে চোখ। মনে হয় কোনো স্বপ্নপুরীতে চলে এসেছি। পাহাড়গুলো আমাদের ক্রমাগত ডাক দিয়ে যায়।
গোপালপুরে পৌঁছাতে বিকেল হয়। পাহাড়ের চূড়ায় বসে দেখি একপাশে সবুজে মোড়ানো ফসলের খেত। ওপর থেকে ক্ষেতের আলগুলো অন্য রকম লাগে। আমরা নানা ঢঙে ছবি তুলি।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে গানের সুর- ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক, পায়েল খানি বাজে…’। পাহাড়ে নারীকণ্ঠ! অবাক হয়ে উৎস খুঁজি। চোখ যায় ছড়ার দিকে। দেখি একদল যুবক-যুবতী। গান গাইতে গাইতে জল নিয়ে খেলায় মেতেছে। মাঝেমধ্যে হাসির তুফান তুলে পাহাড়ের গায়ে আনন্দের ঢেউ তুলছে। জুয়েল ওদের সঙ্গে যোগ দিতে ছুটে যায় ছড়ার দিকে। আমরা গল্প জমাই আদিবাসীদের সঙ্গে। গারো বৃদ্ধ প্রনাশ মারাক আমাদের বসতে দেন। খেতে দেন তাঁদের প্রিয় পানীয় চু। আপন ভেবে জানান দুঃখের কথা। মাঝেমধ্যে আক্রমণ করে বন্য হাতির দল। তখন আগুন জ্বালিয়ে আর ঢোল বাজিয়ে তাঁরা বাঁচার পথ খোঁজেন। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে আসে। পাহাড়ের দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। ঝিঁঝি পোকার ডাক আর জোনাকির মিছিল ভেঙে আমরা ফেরার পথ খুঁজি।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, ১৯ আগষ্ট ২০১৩

© 2013 – 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button