কলাম

‘শয়তান আছর করছিল’ – ধর্ম শিক্ষক মাওলানা তাজুল

লোকটির নাম মাওলানা তাজুল ইসলাম। রাজধানীর উত্তর কাফরুল উচ্চবিদ্যালয়ের ধর্ম শিক্ষক। নিয়োগ পান গত ফেব্রুয়ারিতে। এই ধর্ম শিক্ষক এক দিনেই নিজেকে তুলে ধরেন গোটা জাতির কাছে। তার কর্মই তাকে সবার সামনে নিয়ে আসে। শুধু এলাকাবাসীই নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদকর্মীরাও মধ্যরাতে অপেক্ষায় ছিল তার সাক্ষাতের আশায়। সাক্ষাৎ মিলতেই তাজুল ইসলামের দিকে তাক করা হয় ক্যামেরা। সার্চলাইটের আলোতে ঝলঝল করে মাওলানা তাজুলের মুখটি। সাংবাদিকেরা তার বক্তব্য ধারণ করে নেয় যত্নের সঙ্গে। ৯ সেপ্টেম্বর মাওলানা তাজুলের বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করা হয় বিভিন্ন চ্যানেলে। গোট দুনিয়া চিনে নেয় মাওলানা তাজুল ইসলামকে। দেশের মানুষ জেনে যায় এ ধর্ম শিক্ষকের অধর্মের কাজটিকে।
তাজুল ইসলামের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার বড় মির্জাপুর গ্রামে। তার পিতার নাম মোসলেম উদ্দিন। ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে তাজুল ইসলাম সবার ছোট। তাজুল কামিল পাস করে ঢাকার নয়াটোলা কামিল মাদ্রাসা থেকে। কামিলের পরেই তিনি বিয়ে করেন নিজ গ্রামে। মওলানা তাজুল ইসলাম এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। উত্তর কাফরুল স্কুলে শিক্ষকতার পূর্বে তিনি উত্তর কাফরুল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় মক্তব্য শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন প্রায় ছয় বছর। পরবর্তীকালে মসজিদের ঈমামের সুপারিশে তাকে অস্থায়ী ভিত্তিতে ধর্ম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় উত্তর কাফরুল উচ্চবিদ্যালয়ে।স্কুলে শিক্ষকতা করলেও তাজুল ইসলাম থাকতেন ইসলামিয়া মাদ্রাসাতেই। মাদ্রাসার পাশেই মেহেদী হাসানের দোতলা বাড়ি। বছর খানেক আগে থেকেই মেহেদী হাসানের পুত্র পল্লবকে ( সামাজিক কারণে আসল নাম দেয়া হলো না) কোরআন শরীফ ও ধর্ম শিক্ষা বিষয়ে পড়াতেন তাজুল ইসলাম। পল্লবের বয়স আট বছর। মনিপুর স্কুলের ছাত্র সে।
দোতলা বাড়ির বারান্দাতে পার্টিশন দেওয়া রুমে চলত পল্লবের পড়াশোনা। মাওলানা সাহেব যখন পড়াতে আসতেন, তখন নীরবতার স্বার্থে পল্লবের মা সেই রুমের দরজা ভিরিয়ে রাখতেন। এমন পরিবেশেই পল্লবের কোরআন পাঠ আর ধর্ম শিক্ষা চলত সপ্তাহের পাঁচ দিন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এক মাসের মাথায় পল্লব মাওলানার কাছে পড়তে অপারগতা প্রকাশ করে। তার ভাষায়,‘এই হুজুর ভালো নয়, অন্য হুজুর রাখো।’ পল্লব ছিল খানিকটা চঞ্চল প্রকৃতির। তাই মা তার কথায় গুরুত্ব দিতেন না।
এদিকে মাওলানার কাছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়ে পল্লব হতে থাকে কংকালসার। ক্রমেই সে স্বাস্থ্যহীন ও  দুর্বল হয়ে পড়ে। চোখের কোণে জমে কালি। আসলে একধরনের মনোবৈকলে সে। এ কারণেই তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে। কিন্তু সন্তানের অজানা কষ্টের কথা কিছুতেই বুঝতে পারে না পল্লবের বাবা-মা। একদিন সে কারণটিই বেরিয়ে আসে সত্য হয়ে।

কী অপকর্ম করেছিল মাওলানা তাজুল ? তা জেনে আপনি হয়তো শিউরে উঠবেন কিংবা নিজের সন্তানের কথা ভেবে দুচিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়বেন। নয়তো বলবেন ছি. ছি. এও কি হতে পারে! আমরা স্বাভাবিকভাবে যা ভাবতেও পারি না, ধর্ম শিক্ষক তাজুল ইসলাম তাই ঘটিয়েছে।
৮ সেপ্টেম্বর। বিকেল ৫টা। পল্লবদের বাসায় প্রতিদিনের মতোই পড়াতে আসে মাওলানা তাজুল ইসলাম। মিনিট পনেরো পড়ানোর পরই পল্লব চিৎকার দিয়ে বেরিয়ে আসে পড়ার রুম থেকে। সন্তানের চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে পল্লবের মা। পরিস্থিতি ঠাহর করতে পেরে সেখান থেকে পালিয়ে যায় মাওলানা তাজুল।
পল্লব তখন পায়ুপথের প্রচন্ত ব্যথায় কাতরাচ্ছে। গত এক বছর এভাবেই শিশু পল্লবকে অস্বাভাবিক যৌন নির্যাতন করেছে মাওলানা তাজুল। শুধু তা-ই নয়, এই কুকীর্তি যেন সে অন্য কাউকে বলে না দেয়, সে কারণে মাওলানা পল্লবকে বলত, ‘আমি হুজুর, আমার সাথে আল্লাহ আছে। কাউকে বললে গলা কেটে ফেলব।’ সেদিন মায়ের বুকে মাথা রেখে পল্লব কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বলে দেয়।
দ্রুত ছড়িয়ে পরে খবরটি। ফলে স্থানীয় যুবকদের সহযোগিতায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে ধরে পড়ে মাওলানা তাজুল ইসলাম। স্কুল কমিটির সভাপতি, সদস্য ও স্থানীয় সকলের সামনে অকপটে স্বীকার করেন নিজের অপকর্মের কথা। নিজেকে বাঁচাতে শুধু বলে, ‘আমার ওপর শয়তান আসর করেছিল।’
ধর্ম শিক্ষক মাওলানা তাজুল ইসলামকে স্থানীয়রা পিটুনি দিয়ে সোপর্দ করে কাফরুল থানায়। প্যানাল কোর্টের ৩৭৭ ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয় (মামলা নং-১৪)। সংবাদ পেয়ে মধ্যরাতে থানায় ভিড় জমান গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। গণমাধ্যমের সামনে উত্তর কাফরুল উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আযহারুল হক ফেরদৌস ঘোষণা দেন মাওলানা তাজুল ইসলামের চাকুরিচ্যুতির।
এই প্রতিবেদন যখন যখন লেখা হচ্ছে, তখন মাওলানা তাজুল ইসলাম কারাগারে। কিন্তু শিশু পল্লব তখনো পাহাড়সম মানসিক চাপ সহ্য করে মেডিকেল টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিকেলে। অতঃপর ম্যাজিস্ট্রেটের সন্মুখে নেওয়া হবে এ শিশুটির জবানবন্দি। জানতে চাওয়া হবে যৌন হয়রানি নিয়ে নানা প্রশ্ন। যা একটি শিশুর মনোজগতে ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
ধর্ম শিক্ষার তাজুল, ধর্মের মুখোশের আড়ালে বিকৃতকামী। শুধু মাওলানা তাজুল ইসলামই নয়। এ সমাজে এমন বিকৃত রুচির মানুষেরা মিশে আছে নানা লেবাসে। বহুরূপী মানুষের ভিড়ে তাদের শনাক্ত করা সত্যি কঠিন। তাই প্রয়োজন সচেতনতার। দরকার নিজ উদ্যোগে নিজের শিশুটিকে নিরাপদ রাখা। পুরুষ কিংবা নারী হোক, আপনার সন্তান কি তার গৃহশিক্ষকের কাছে নিরাপদ ?

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে , ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২

পাঠকের মন্তব্যসহ লিখাটি পড়তে চাইলে : সচলায়তন.কম  , ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button