আদিবাসীমুক্তিযুদ্ধ

ভদ্র ম্রং: এক আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা

‘১৯৭১ সাল। আমি তখন হালুয়াঘাট মডেল স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্র। বন্ধুরা সবাই মিলে প্রায়ই গোলাগুলি খেলা খেলতাম। দুই দলে ভাগ হওয়াটাই ছিল খেলার নিয়ম। হিন্দুস্থান দেওয়া হতো এক দলের নাম। অন্য দলটি পাকিস্তান। সবাই বানিয়ে নিতাম বাঁশের তৈরি ছোট ছোট বন্দুক। দুই দলের মধ্যে শুরু হতো গোলাগুলি। মিছিমিছি গুলি ছুড়তাম একে অপরকে। তাতেই ছিল অন্য রকম মজা। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা আমরা মগ্ন থাকতাম এ গোলাগুলি খেলায়। কিন্তু তখনো ভাবিনি, একসময় সত্যি সত্যি এ দেশেই গোলাগুলি শুরু হবে। হাতে তুলে নিতে হবে অস্ত্র।’

এভাবেই কথা শুরু করেন আদিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং। যিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ ও ১ নং কোম্পানি কমান্ডার ফজলুল রহমান আকঞ্জীর নেতৃত্বে। তিনি ছিলেন ১ নম্বর প্লাটুনের সেকশন কমান্ডার। কোনো কোনো সময় প্লাটুন বা কোম্পানি কমান্ডার না থাকলে তাকেই কোম্পানি বা প্লাটুনের দায়িত্ব পালন করতে হতো।
মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রংয়ের বর্তমান নিবাস ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার রাংরাপাড়া গ্রামে। কিন্তু তার শৈশব কেটেছে পার্শ¦বর্তী ধোবাউড়ার সাংখোলা নামক গ্রামে।
বাবা রজিন্দ্র ঘাগ্রা ও মা বিশ্ব মনি ম্রংয়ের ছেলে ভদ্র ম্রংয়ের পড়াশোনা শুরু রতনপুর প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৬৪ সালে তিনি ধোবাউড়া থেকে চলে যান দুর্গাপুরে। ভর্তি হন বিরিশিরি মিশনারি স্কুলে, ক্লাস ফোরে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে দুর্গাপুরে বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে তিনি যুক্ত ছিলেন সমসাময়িক বন্ধু জালাল উদ্দিন তালুকদারের সঙ্গে। অতঃপর ১৯৭১-এর শুরুতে ভদ্র ম্রং চলে আসেন হালুয়াঘাটে। ভর্তি হন সেখানকার মডেল স্কুলে।
বাল্যবন্ধু তাপস ডিও, অরবিন্দু ডিও, পীযূষ ঘাগ্রার স্মৃতি আজও তার মনে অম্লান হয়ে আছে। বাল্যকালে ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা আর গুলতি খেলাই শুধু নয়, এ বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ছিলেন ভদ্র ম্রংয়ের পাশে।

ভদ্র ম্রংয়ের সম্মাননা
ভদ্র ম্রংয়ের সম্মাননা

মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রংয়ের কথা আমরা প্রথম জানি আদিবাসী বাংলা ব্লগে বিপুল হাজংয়ের একটি ছোট্ট লেখা থেকে। সে সূত্র ধরেই এক বৃষ্টিভেজা দিনে আমরা হাজির হই ভদ্র ম্রংয়ের রাংরাপাড়ার বাড়িতে। স্মৃতিঘরের দুয়ার খুলে মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং আমাদের জানান ৪১ বছর আগের নানা ঘটনার কথা।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিলের শুরুতেই পরিবারের সঙ্গে চারুয়াপাড়া সীমান্ত পেরিয়ে ভদ্র ম্রং চলে যান ভারতের বাগমারা শরণার্থী ক্যাম্পে। সে সময় সেখানকার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন সেখানে খাবারের খুব কষ্ট ছিল। আমরা দূর থেকে বাঁশ কেটে এনে বিক্রি করতাম। মানুষের জীবন ছিল কুকুর-বিড়ালের মতো।’
কিন্তু এভাবে আর কত দিন? নিজের দেশকে মুক্ত করতে হবে। তাই কয়েক বন্ধুসহ ভদ্র ম্রং সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাওয়ার। পরিবারকে না জানিয়ে একদিন বন্ধু তাপস, অরবিন্দু, পীযূষ ঘাগ্রাসহ ভদ্র ম্রং ট্রেনিংয়ের জন্য নাম লেখান বাগমারা ইয়ুথ ক্যাম্পে। দশ দিনের লেফট রাইট চলে সেখানে। অতঃপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরার রংনাবাগ ট্রেনিং ক্যাম্পে।
একুশ দিনের গেরিলা ট্রেনিং নেন ভদ্র ম্রং। তার ভাষায়, ‘২১ বছরের ট্রেনিং নিয়েছি ২১ দিনে।’ ৭ নং কোম্পানিতে ভদ্র ম্রংরা ছিলেন ৯১ জন। এর মধ্যে আদিবাসী গারো ছিল ১০ জন আর হাজং ১ জন।

ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রংদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় দুর্গাপুরের দক্ষিণে বাদামবাড়ির সামনে রাঙাছড়ায়। সেখানকার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়াও তিনি অপারেশন করেছেন দুর্গাপুরের সিও ডেভেলপমেন্ট অফিস, গোপালপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। বিজয়ের দিনে তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ শহরে। ভদ্র ম্রং বলেন, ‘কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন। আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে উল্লাস করেছি আমরা।’
দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং নিজেকে যুক্ত করেন শিক্ষকতা পেশায়। ঝিলাগড়া মিশনারি স্কুলে ষাট টাকা বেতনে শুরু করেন চাকরি। অতঃপর ২০০০ সালে অবসর নেন রাংরাপাড়া সরকারি প্রাইমারি স্কুল থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের তালিকা প্রসঙ্গে কথা উঠতেই এই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তালিকা ছিল ক্যাম্পে ক্যাম্পে। ফলে যুদ্ধের পর সহজেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা যেত।’ তিনি বলেন, ‘এখন তো সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তালিকা বদলায়। আওয়ামী বা বিএনপিপন্থীরা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হলেই নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যায়। অনেক সময় তাদের আত্মীয়স্বজনের নামও তালিকায় চলে আসে।’
মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং জানান, তার দাদা পরিবারসহ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হওয়ায় তারা এখন ধর্মান্তরিত গারো আদিবাসী। তিনি মনে করেন, অন্যান্য আদিবাসীর মতো ধর্মান্তরের ফলে গারোরাও হারিয়ে ফেলেছে তাদের সমৃদ্ধময় আদি সংস্কৃতি ও আচারগুলো। তার ভাষায়, ‘আমরা এখন মিক্সড সংস্কৃতি পালন করছি। ধর্মান্তরিত হয়ে আমাদের মাঝে আর্য সংস্কৃতি ঢুকে গেছে। ঢুকেছে ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতিও। বড়দিনে আমরা কীর্তন করি। এগুলো তো গারো সংস্কৃতিতে ছিল না। এভাবে আর্য সংস্কৃতি অনার্যদের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, গারোরা চাইলে এখনো তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আদিবাসী-বাঙালিতে ছিল না কোনো ভেদাভেদ। সবার ওপরে ছিল দেশ। বাঙালি সহযোদ্ধা বন্ধু কাঞ্চন ও লাল মিয়ার কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় ভদ্র ম্রংয়ের। তার ভাষায়, ‘আমরা ভাইয়ের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। একে অপরের পাশে থেকেছি। যুদ্ধের সময় একজন অন্যজনের প্রাণ বাঁচিয়েছি। তখন তো কোনো জাতপাত ছিল না।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে এ আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার অভিমত, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনের ভেতরের চাপা কষ্ট লাঘব হবে। আর জাতি হবে কলঙ্কমুক্ত।’
একাত্তরে আদিবাসীদের ত্যাগের কথা বলতে গিয়ে ভদ্র ম্রং বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম দেড় থেকে দুই হাজার গারো আদিবাসী। হালুয়াঘাটে শহীদ হয় আড়ং রিসিল ও পরিমল দ্রংসহ তিনজন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের শরীর গরম পানিতে ঝলসে দিয়ে, গাড়ির পেছনে শরীর বেঁধে তাদের দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘এ দেশের জন্য আদিবাসীরাও তো যুদ্ধ করেছে, শহীদ হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু আদিবাসীরা কী পেয়েছে?’ তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘সরকার আদিবাসীদের শুধুই ক্ষুদ্র করে দিচ্ছে। এভাবে হয়তো একসময় আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।’
মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং বর্তমানে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্য বিষয়ে তিনি নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন অকপটে।
তার ভাষায়, ‘পাকিস্তানের সময়ে আমরা দুই নম্বর নাগরিকও ছিলাম না। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর তবু নাগরিকত্ব পেয়েছি। কিন্তু বৈষম্যগুলো তো রয়েই গেছে।’
কী সেই বৈষম্য? মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রং বলেন, ‘এখনো অফিস আদালতে তেমন সম্মান পায় না আদিবাসীরা। তাদেরকে ভিন্ন চোখে দেখা হয়। পাকিস্তানের সময়ে জোর করে আদিবাসীদের জমি দখল করে নিত স্থানীয় বাঙালিরা। স্বাধীনের পর কৌশলটা পাল্টেছে। এখন গারো গারো বিবাদ সৃষ্টি করে সালিস ডেকে সুকৌশলে আদিবাসীদের জমি দখল করে নিচ্ছে বাঙালিদের একটি চক্র। পার্থক্য শুধু এটুকুই।’
আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে কথা বলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জানান, সংবিধান তৈরির পূর্বে বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন মধুপুরে। সেখানে গারোদের পক্ষে পরেশ সাংমা দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। দাবি রেখেছিলেন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির। তবু ’৭২-এর সংবিধানে আদিবাসীদের কোনো স্থান মিলল না।
মুক্তিযোদ্ধা ভদ্র ম্রংয়ের মতে, কোনো সরকারই আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতি আন্তরিক নন। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘৯৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বললেন, এ দেশে কোনো আদিবাসী নেই। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সমর্থন দিলেন। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আমাদের অনুষ্ঠানগুলোতে এসে একাত্বতা প্রকাশও করলেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে হলেন অন্য মানুষ।’
কেন আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলো না? এমন প্রসঙ্গে ভদ্র ম্রং বলেন, ‘শুনেছি, কিছু গোয়েন্দার কথা সরকার শুনেছে। তাই আমাদের স্বীকৃতি মেলেনি।’
আদিবাসী হিসেবে একজন প্রতিমন্ত্রী আছেন সরকারের ভেতরে, তার ভূমিকা বিষয়ে জানতে চাইলে ভদ্র ম্রং দুঃখ করে বলেন, ‘আমাদের মাথাই সরকারের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। মন্ত্রিত্ব বজায় রাখতে তিনিও নিশ্চুপ হয়ে গেছেন।’
বৃষ্টি বেড়ে চলে, তার সঙ্গে আমাদের কথাও। ভদ্র ম্রং হতাশার অন্ধকারে জ্বালান আশার আলো। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ দেশে একদিন আদিবাসীদের স্বীকৃতি মিলবেÑ তেমনটাই মনে করেন তিনি। বৈষম্যের বিরুদ্ধেই একদিন যুদ্ধ করেছিল এ দেশের মানুষ। আর তাই এই বীর মুক্তিযোদ্ধার আশা, এ দেশের মানুষও আদিবাসীদের অধিকারগুলোর প্রতি হবেন শ্রদ্ধাশীল।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে

© 2012 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button