কলামমুক্তিযুদ্ধ

মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত

বৈশাখ মাস। প্রচন্ড রোদ। তবুও চারপাশে শীতল অনুভূতি। বড় বড় আমগাছ। সংখ্যায় দুই হাজারের মতো। অধিকাংশই শতবর্ষী। দিনময় এখানে চলে পাখিদের কোলাহল। ছায়াঘেরা পাখিডাকা আম্রকানন এটি। খরতাপও এখানে কুর্নিশ নোয়ায়। প্রচন্ড গরমে তাই আগতরা আশ্রয় নেয় আম্রকাননের শীতলতায়।

১৭ এপ্রিল ১৯৭১। এ আম্রকাননেই আশ্রয় মেলে বাংলাদেশের ইতিহাসের নক্ষত্রদের। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (প্রবাসী) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা শপথ নেন এখানেই। সে থেকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন নাম পাল্টে হয়ে যায় মুজিবনগর।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের প্রকাশ্যে শপথ নেওয়ার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল ১৯৭১, চুয়াডাঙ্গাতে। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে পাওয়া যায় এমন তথ্য। কিন্ত সেই গোপন সিদ্ধান্তটি সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তান বাহিনী সে স্থানে প্রবল বোমাবর্ষণ করে। আর এতে ভেস্তে যায় সেই পরিকল্পনা।

এখন আম্রকাননের এক পাশে স্মৃতিসৌধ। অন্য পাশে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের মূল ভবন। ভেতরের মাঠে বাংলাদেশের বড় একটি মানচিত্র। মানচিত্রে ছোট ছোট ভাস্কর্য বসানো। সেখানে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনা। কিন্ত গোটা দেশের যুদ্ধচিত্র সেখানে অনুপস্থিত।

গার্ড অব অনার
গার্ড অব অনার

ভবনের উত্তর পাশের সম্মুখ অংশে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একেকটি অধ্যায়কে। সবই ধবধবে সাদা বর্ণে। বড় বড় ভাস্কর্যের মাধ্যমে। যেন একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। দেশের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরতে মুজিবনগর কমপ্লেক্সের সার্বিক উদ্যোগ অসাধারণ!

প্রতিদিন শত শত মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে মুজিবনগরে। দেশের প্রথম রাজধানী হিসেবে কমপ্লেক্স ছাড়া উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া নেই এখানটায়। কমপ্লেক্সে ইতিহাস উপস্থাপনের কাজও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। ইতিহাসকে কাছ থেকে উপলব্ধি করতে এখানে আসেন দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। দূরদুরান্ত থেকে শিক্ষাসফরে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরাও। এক বিকেলে আমরাও ঘুরে দেখি মুজিবনগর কমপ্লেক্সেটির স্থাপনাগুলো।

ভবনের উত্তর পাশে নজরে এলো মানুষের জটলা। একদল ছাত্রছাত্রী। সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষক। দূর থেকে তারা দেখছে সাদা ভাস্কর্যগুলোকে। এক শিক্ষক আবার বর্ণনা করছেন ভাস্কর্যের পেছনের ইতিহাসটিকে। ভাস্কর্যে ইতিহাস দেখা। নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস শেখানোর এ এক অনন্য পদ্ধতি।

মুজিবনগরে ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয় । গার্ড অব অনার প্রদানকারী ১২ জনের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র চারজন আনসার সদস্য। এক যুবক জানালেন তথ্যটি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হতেই ফোন নম্বর দিয়ে সহায়তাও করলেন। মুঠোফোনে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। অতঃপর কেটে যায় মিনিট দশেক সময়। একে একে উপস্থিত হন কালের সাক্ষী চারজন আনসার।

মোঃ সিরাজ উদ্দিন ও মোঃ হামিদুল হকের বয়স ষাট পেরোলেও মোঃ আজিমুদ্দিন ও মোঃ লিয়াকত আলীর বয়স সত্তরোর্ধ্ব। ভাস্কর্য দেখতে দেখতে কথা চলে তাদের সঙ্গে। আজিমুদ্দিন জানান সেদিনের কথা। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সংগীতে কন্ঠ দিয়েছিলেন আসাদুল আর আইয়ুব। কোরআন তেলওয়াত করেন বারেক। এরপরই শুরু হয় গার্ড অব অনার পর্বটি। তাঁদের ভাষায়,‘প্রথমে আমাদের কমান্ডে ছিলেন আনসার ইয়াদ আলী। পেছনের লাইনে ছিলাম আমরা ১১জন। ইয়াদ আলীকে লাইনে পাঠিয়ে কমান্ড করলেন মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন মাগুরা মহকুমার পুলিশ কর্মকর্তা। পেছনে আমরা ১২জন গার্ড অব অনার প্রদান ও সশস্ত্র সালাম দিই।’

অন্য আনসার সদস্যদের নাম জানতে চাইলে লিয়াকত আলী হরহর করে বলতে থাকেন, ‘ ফকির মোহাম্মদ, নজরুল ইসলাম, মফিজ উদ্দিন, অস্থির মল্লিক, মহিম শেখ, কিসমত আলী, সাহেব আলী, এবং ইয়াদ আলীর।’

কথায় কথায় আমরা আসি গার্ড অব অনারের ভাস্কর্যটির সামনে। ভাস্কর্যটিতে দেখানো হয়েছে আটজন আনসার সদস্য গার্ড অব অনার দিচ্ছেন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে। তা দেখিয়ে আজিমুদ্দিন দুঃখ করে বলেন, ‘আমরা গার্ড অব অনার দিয়েছিলাম ১২জন আনসার। অথচ মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভাস্কর্য বা মুর‌্যালচিত্রে দেখানো হয়েছে  আটজনকে। সকলের ছবি থাকা সত্ত্বেও ভাস্কর্যে সকলের সঠিক অবয়বও আনা হয়নি।’ তারা মনে করেন এটা ইতিহাস বিকৃতির শামিল; যা সঠিক ও অবিকৃতভাবে উপস্থাপন করা উচিত। তাদের দাবির সঙ্গে আমরাও একমত হই।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, গণহত্যা, অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদ, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া সম্মেলন শেষে আমাদের দৃষ্টি আটকায় আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যটির দিকে। একটি টেবিল সামনে রেখে দুটি চেয়ারে বসা অবস্থায় রয়েছেন পূর্বাঞ্চলের সম্মিলিত বাহিনী প্রধান লে. জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লে. জে. এ কে নিয়াজী। আত্মসমর্পণের দালিলিক এ চিত্রটিই আমাদের জানা। কিন্ত এখানকার ভাস্কর্যে ওই দুজন ছাড়াও টেবিলের পাশে চেয়ারে বসা তৃতীয় এক ব্যক্তিকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ঢাকা থেকে আগত একজন দর্শনার্থীরও চোখ আটকায় আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যটির দিকে। নাম তার আসমা ইসলাম। মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তিনি। বললেন নিজের অনুভূতির কথা ‘এটি একটি বড় ভুল। ইতিহাসে কখনো হস্তক্ষেপ করা যায় না। ইতিহাসের এ রকম ভুল উপস্থাপন বিভ্রান্তিতে ফেলবে পরবর্তী প্রজন্মকে।’

সাধারণত কোনো তথ্য বা ছবি থেকেই নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্য। তাই আমার একটু ফিরে দেখি ইতিহাসে আত্মসমর্পণের সে দিনটির দিকে।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহোওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য বিনা শর্তে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সম্মিলিত বাহিনীর পক্ষে এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন লে. জেনারেল জগজিত সিং অরোরা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লে. জে. এ কে নিয়াজি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর উপ সেনাপ্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এস ফোর্স অধিনায়ক লে. কর্ণেল কে এম সফিউল্লাহ, ২নং সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার এবং টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী। উল্লেখিত তথ্যটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবের।

গত ২৬ মার্চ ২০১২  সালে প্রথম আলোর স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় ‘আত্মসমর্পণের টেবিল’ শিরোনামে লে. কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ তার লেখায় আত্মসমর্পণ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ঠিক এভাবে, ‘রেসকোর্স ময়দানে আমরা প্রবশে করি এখন যেখানে পুলিশ কন্ট্রোল ক্যাম্প, সেদিক দিয়ে। পশ্চিম পাশে একটি গেট ছিল। পূর্বদিকে কিছুদূর যাওয়ার পর, অর্থাৎ পুলিশ ক্যাম্পের পূর্ব পাশে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার রাখা। সেই টেবিল ও চেয়ার কোথা থেকে আনা হয়েছে, সেটি আমি জানি না। জেনারেল অরোরা ও নিয়াজি সরাসরি টেবিলের সামনে পাতা চেয়ারে গিয়ে বসেন। দু-তিন মিনিট পর জেনারেল নিয়াজি যৌথ কমান্ডের (বাংলাদেশ- ভারত) কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। তখন আমার ঘড়িতে সময়
চারটা ৩১ মিনিট। নিয়াজি স্বাক্ষর করা মাত্র চারদিকে জয়বাংলা স্লোগানে মুখর হতে থাকল।’ একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কে এম সফিউল্লাহর লেখা থেকেও তৃতীয় কোন চেয়ার কিংবা ব্যক্তির অস্তিত্বের প্রমাণ নেই।

এছাড়া আত্মসমর্পণের দলিল হিসেবে সে সময়কার বিভিন্ন ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, দুটি চেয়ারে বসা অবস্থায় শুধুই অরোরা ও নিয়াজী। আর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা ক্যামেরা ও রেকর্ডার হাতে হাটু গেড়ে বসেছেন টেবিলের চারপাশে।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল ‘ম্যান এট এ টেবিল’। খবরটিতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে শুধুমাত্র অরোরা ও নিয়াজিই টেবিলের সামনে দুটি চেয়ারে বসে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, দেশি- বিদেশি কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদেও মিলেনি তৃতীয় কোনো চেয়ার কিংবা ব্যক্তির অস্তিত্ব।

যদি তা-ই হয়, তবে মুজিবনগর কমপ্লেক্সে আত্মসমর্পণ ভাস্কর্যে ইতিহাসের ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এই ভুলে প্রশ্ন থেকে যায় অনেকগুলো। কোন ছবি থেকে এমন ভাস্কর্য তৈরি করা হলো ? এমন বিভ্রান্তিমূলক ছবি ও তথ্য সরবরাহ করল কে ? তৃতীয় চেয়ারে বসা ব্যক্তিটি বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? এটি কি ইতিহাসকে বিকৃতির চেষ্টা নয়? দেশের ইতিহাস রক্ষার দায়িত্বে আসলে কারা আছেন? মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ঠেকাবে কে?

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে

© 2012 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button