কীর্তিমান বাঙালি

মাতুব্বরের কথা

আরজ আলী মাতুব্বর একজন স্ব-শিক্ষিত, স্বধর্মত্যাগী দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক। বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে চড়বাড়িয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত লামছড়ি গ্রামের এক গরীব কৃষক পরিবারে তিনি ১৭ ডিসেম্বর ১৯০০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো “আরজ আলী”। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাধে তিনি “মাতুব্বর” নাম ধারণ করেন। তাঁর পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। বার বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। এর পরে অভাবের কারণে তাদের দুই একরের বসতবাড়িটিও নিলামে ওঠে। জমিজমাহীন বালক আরজ আলী স্থানীয় সুদখোরদের কাছে তখন তাঁদের পরিবারটি দেনার দায়ে পূর্বপুরুষের ভিটামাটি হারিয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়ে যায়। অন্যের দয়া দাক্ষিণ্যে বহু কষ্টে খেত খামারে কাজ করার কারণে আর দরিদ্র আরজ আলী আর স্কুলে পড়ার সুযোগ পান নি।

আরজ আলী নিজ গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মসজিদ দ্বারা পরিচালিত মক্তবে সীতানাথ বসাকের কাছে ‘আদর্শলিপি’ পড়তেন। দরিদ্রতার কারণে নিয়মানুবর্তিতার অভাবে তাঁকে মক্তব ছাড়তে হয়। এরপর তিনি কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। সাথে সাথে তিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় লেখাপড়া শিখতে থাকেন। নিজের জ্ঞানের পিপাসা মেটাতে তিনি বরিশাল লাইব্রেরীর সমস্ত বাংলা বই একজন মনোযোগী ছাত্রের ন্যায় পড়েন। দর্শন ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়। কিন্তু পাঠাগারে পর্যাপ্ত বই ছিলো না। পরে বিএম মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের এক শিক্ষক – কাজী গোলাম কাদির তাঁর জ্ঞানগর্ভ বিচার দেখে মোহিত হন এবং তিনি মহাবিদ্যালয়ের পাঠাগার থেকে বই ধার দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এভাবেই তাঁর মানসিক আকৃতি গঠিত হয়।

আর্থিক সঙ্কটের কারণে, মাতুব্বর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স বা ডিগ্রী লাভ করতে পারেন নি। কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি জরিপ বা আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কৃষি ক্ষেতের জন্য এভাবে কিছু পুঁজি জমা করেন।
মাতুব্বর ছিলেন সাম্যবাদী ঢঙের, অনেক অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেন। তাঁর লেখার জন্য তাঁকে ধর্মীয় ভাবমূর্তির প্রতিমাধ্বংসকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ইসলামের বংশগতির ধারা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেন এবং স্বকীয় মত-বৈশিষ্ট্য একমতে আনতে ব্যর্থ হন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ঘাটতি সত্ত্বেও তিনি কতিপয় বই সাহসীকতার সহিত লেখেন। বিশ্ব ও জীবন সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক লেখা বিতর্কিত হয়ে পড়ে।মাতুব্বর বরিশালের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল হক সহ অন্য অনেক সংখ্যক সাম্যবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিলো। তাঁর বইগুলো সর্বদাই সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধের হুমকিতে থাকত, কারণ তাঁর লেখনী রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু লোকদের মতের বিরুদ্ধাচারিত নির্দিষ্ট দাবিকৃত ধর্মীয় মত বা ভাবাদর্শ ধারণ করত। মাতুব্বরকে তাঁর বই – “সত্যের সন্ধানে”র (Sotyer Shondhaney) জন্য বন্দী করা হয় এবং পুলিশ হাজতে নেয়া হয়। লেখনীর কারণে তিনি যতবার দাবিকৃত ধর্মীয় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ততবার তাঁকে হুমকি ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়।

মাতুব্বরকে তাঁর বইগুলো প্রকাশে অনেক বাধা পেরোতে হয়েছিলো। এমনকি তিনি তাঁর প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও আঁকেন, যেটি ১৯৫২ সালে লেখেন এবং ১৯৭৩ সালে “সত্যের সন্ধানে” তা ছাপানো হয়। এই বইটি তাঁকে তাঁর এলাকায় “শিক্ষিত ব্যক্তি” হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিলো।তিনি একজন অন্য প্রকৃতির লেখক ছিলেন। তাঁর কারণ তাঁর গ্রামীণ পটভূমি। তাঁর পক্ষে সমাজে বিরাজ করা অন্ধকার মেটানো সম্ভব ছিলো না, কিন্তু তিনি যতদূর পেরেছেন তাঁর ক্ষীণ ও নিষ্প্রভ আলো ভয়হীন বা সন্দেহ ছাড়াই ধারণ করেছেন। বাংলাদেশে, তাঁর লেখা যে সব বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ (সেন্সর) করা হয় সেগুলো হলঃ
* সত্যের সন্ধানে, (The Quest for Truth) (1973)
* সৃষ্টির রহস্য, (The Mystery of Creation) (1977)
* অনুমান, (Estimation) (1983)
* মুক্তমন (Free Mind) (1988)
মরণোত্তর কতিপয় কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি আরজ আলী মাতুব্বরের রচনাবলী শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তাঁর কিছু লেখা ইংরেজীতে ভাষান্তর করা হয় এবং পাঠক সমাবেশ কর্তৃক সেগুলো খন্ডাকারে আবদ্ধ করা হয়। এছাড়া তার আরো কতিপয় প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে –
* ম্যাকগ্লেসান চুলা (১৯৫০)
* স্মরণিকা (১৯৮২)
১৫ই মার্চ ১৯৮৫ সাল বাংলা সনের ১লা চৈত্র ১৩৯২তারিখে তিনি ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরলোকগমন করেন। তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করেন। মেডিকেলের ছাত্রদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ-এর এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদান করেন। মৃত্যু পরবর্তী আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের গ্রাম্যসমাজে এই পর্যন্ত পরিখার আদলে গড়ে উঠা বিশ্বাস ও কুসংস্কারে অকুতোভয় ছিলেন।

তথ্য ও ছবি : সংগৃহীত

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button