মুক্তিযুদ্ধ

নতুনেরা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে

‘ভারতের তরঙ্গপুর ক্যাম্প থেকে আমরা ঢুকে পড়ি ঠাকুরগাঁও জেলায়। জাবরহাট নামক গ্রামের এক স্কুলে আশ্রয় নিই সবাই। গ্রামের অধিকাংশ লোকই ছিল দিগরিয়া (চাপাই, মুর্শিদাবাদ থেকে আগতরা)। আমাদের দেখে কেন জানি তারা বাড়তি প্রশংসা করে। আদর আপ্যায়নেরও কমতি নেই। বিকেলের দিকে খাসি জবাই হয়। সন্ধ্যা নামতেই খেতে বসি সবাই।  ভাতের নলা মুখে দিয়েছি ওমনি চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি। আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। জীবন বাঁচাতে ছুটে পালাই সবাই। পূর্বদিকে ছিল একটি বিল। আমরা কয়েকজন কোনরকমে আশ্রয় নেই সেখানে। শরীরে আটকে থাকে রক্তচোষা জোঁকগুলো। তবুও টের পাই না। এভাবেই কেটে যায় সারা রাত। মূলত ঐ গ্রামের দিগরিয়ারা ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে। খাওয়ানোর কৌশল এঁটে তারা গোপনে খবর দিয়ে আসে পাকিস্তানি আর্মিদের একটি কোম্পানিকে।  সেদিন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় এক সহযোদ্ধা। এভাবেই যুদ্ধ করছিলাম। অপারেশনের আগে তাই খবর নিতে হতো রাজাকার, আলবদর বাহিনী ও তাদের অনুসারীদের সম্পর্কে।’

ট্রেনিংয়ের পর প্রথম অপারেশন বগুড়ার ক্ষেতলালে। আমরা ১৮ জনের মতো। কমান্ডার সুবেদার তাহের। খানরা ১৩ জনের একটি দল টহল দিতে গিয়ে জ্বালিয়ে দেয় একটি গ্রাম। তাদের ফেরার পথে আমরা এম্বুশ করি। ১০০ গজের মধ্যে আসতেই প্রথম গুলি করি। সহযোদ্ধাদের স্টেনগানও গর্জে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। খানরা সবাই লুটিয়ে পড়ে। খানদের একজন কোন ফাঁকে যেন ওয়ারলেস ম্যাসেজ দিয়ে দেয়। আমরা দ্রুত তাদের অস্ত্রগুলো নিয়ে সরে পড়ি। মিনিক পাঁচেকের মধ্যেই শত শত সেল এসে পড়ে ওই জায়গায়। আর কয়েক মিনিট দেরি হলে আমরা হয়তো সেখান থেকে ফিরতে পারতাম না। দেশকে মুক্ত করতে হবে। ভয়কে জয় করে আমরা যুদ্ধ করে যাই।
‘১৯৭১ সাল। নভেম্বরের ১১ তারিখ। ভারত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল আমাদের। হামজাপুর ক্যাম্পে বিকেলের দিকে পরিকল্পনা হয় খানপুর আক্রমণের। ভারতের এক কর্নেল আর এক মেজর ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আক্রমণের সম্মুখে থাকব আমরা। পেছনে ভারতীয় সেনা আর আর্টিলারি সাপোর্ট। ১২ তারিখ ভোর ৪ টা। আমরা প্রায় ৪শ মুক্তিযোদ্ধা খানপুরের দিকে রওনা হই। জামালপুরের কাছাকাছি আসতেই শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। আমরা গুলি চালাই আর ক্রোলিং করে করে  সামনে এগোই। আমার ডান পাশে লেফটেন্যান্ট আমিনুল। অন্য পাশে বন্ধু মালেক। গোলাগুলি চলছেই। সকালের দিকে আমরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ি। মনের মধ্যে অন্য রকম চাপ। বেঁচে থাকব নাকি মরে যাব? নানা চিন্তা ভর করে মনে। গুলি থামিয়ে পাশ থেকে মালেক সিগারেট ধরায়। কয়েক টান দিয়ে সিগারেট এগিয়ে দেয় আমার দিকে। সিগারেটে টান দিতেই ব্রাশফায়ারের গুলি এসে লাগে মালেকের পায়ে। রক্তে ভিজে যায় তার গোটা পা। আমি তাকে পেছনে যেতে সাপোর্টিং ফায়ার করছি। কোন খেয়াল নেই আমার। হঠাৎ অনুভব করলাম পা দুটো যেন এগোচ্ছে না। ঝিমঝিম করছে গোটা শরীর। ভাবলাম, সাপে কাটল না তো! খেয়াল করতেই দেখি পেটের দিক থেকে গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। পিঠের দিকটায় স্পর্শ করতেই অনুভব করি বেশ খানিকটা মাংস উড়ে গেছে। কখন যে ব্রাশফায়ারের একটি গুলি পেটের এপাশ থেকে ওপাশে বেরিয়ে গেছে, টেরও পাইনি। আমি ক্রোলিং করে পেছনে হটি। রক্ত বন্ধ করতে এক হাতে চেপে ধরি পেটটা। খানরা আমাকে তাক করে তখনো গুলি ছুড়ছিল। সাপোর্টিং ফায়ার করতে এগিয়ে আসে ল্যাফটেন্যান্ট আমিনুলসহ কয়েকজন। প্রথমে ক্যাম্পে ও পরে আমাকে নেওয়া হয় রায়গঞ্জ হাসপাতালে।  সুস্থ হওয়ার দিন দুয়েক পরে খবর পাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কী যে ভালো লেগেছিল সেদিন!’

আঘাতের চিহ্ন দেখাচ্ছেন আ. জব্বার
আঘাতের চিহ্ন দেখাচ্ছেন আ. জব্বার

স্মৃতি হাতড়ে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাগুলো একে একে বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুল জব্বার। এক সকালে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধর্মদহ গ্রামের নিজ বাড়িতে কথা হয় তার সঙ্গে।
বাবা শেহার উদ্দিন আহমদ ও মা আছিয়া খাতুন এর ছেলে আব্দুল জব্বার যুদ্ধ করেছেন ৭ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর হামজাপুরের অধীনে। সেখানকার কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জব্বার ছিলেন সেনাবহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন ল্যান্স নায়েক। আইডি ৩৯৩৬২৯০। স্বাধীনের পূর্বে সেনাবাহিনীর ব্যারাকের ভেতরকার বৈষম্যের কথা জানালেন এই যোদ্ধা। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের দেখতে পারত না পাঠান-পাঞ্জাবি সৈন্যরা। সময়ে সময়ে কটুক্তি করত। ব্যারাকে খাবার ছিল রুটি। বাঙালি সৈন্যরা রাতে  খেত ভাত। খাওয়া নিয়ে ওরা হাসাহসি করত। কখনো কখনো তারা মুখের সামনেই বলত, ‘শালা বাঙালী আদমি, চাইল খাতায়ে’। আমরা মুখ বুজে সব সহ্য করতাম। ওরা দলে ছিল শক্তিশালী। প্রতিবাদ করলে সামরিক আইনে সাজা খাটাতে হতো।’
যুদ্ধের আগে মায়ের অসুখের কথা শুনে ব্যারাক থেকে জব্বার আসেন বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা নামে ঢাকায়। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। ফলে জব্বারের আর ব্যারাকে ফেরা হয় না।
জব্বার তখন বিরলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যুবকদের একত্র করতে থাকেন। রামপুরের এক আনসার কমান্ডারও তার সঙ্গে যুক্ত হয়। জব্বার বলেন,‘ আমরা বিরল থানা ঘেরাও করি। আমার সঙ্গে ছিলেন মেহরুল ইসলাম, মালেক, আনোয়ার , গফুর , আজিজ, জব্বার, আকবরসহ ৩০০র মতো যুবক। থানায় ছিল শুধু একজন ননবেঙ্গলি অফিসার। আমরা মালখানার চাবি নিয়ে অস্ত্রগুলো নিজেদের কাছে নিয়ে নিই।’
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দিনাজপুর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ -পশ্চিম উপকন্ঠ কুঠিবাড়ীতে। ২৮ মার্চ সেখানে বাঙালি অফিসার ও জওয়ানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে পাঠান পাঞ্জাবিরা। ফলে শুরু হয় গোলাগুলি। বাঙালি ইপিআর জোয়ানরা সেখানকার অস্ত্র লুট করে। অস্ত্র নিয়ে কয়েকজন চলে আসে জব্বারদের দলে।
সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। বিরল তখনো মুক্ত এলাকা। পাইলট স্কুলে অবস্থান নিয়ে জব্বার স্থানীয় যুবকদের রাইফেল চালানোর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ নেন মালেক, মেহেরুন, মজিবুর, মমতাজসহ অনেকেই। এপ্রিলের শেষে পাকিস্তান আর্মিরা দখলে নেয় বিরলকে। জব্বার তখন চলে আসেন ভারতের কুসুমন্ডি থানার পালসার গ্রামে। মাকে নিরাপদে রেখে জব্বার যান মুক্তিযুদ্ধে।
দলবলসহ জব্বার প্রথমে আসেন প্রাণসাগর ইয়ুথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আশ্রাফ সিদ্দিকী। পরে তিনি ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের দলে যোগ দেন। জব্বারের ভাষায়, ‘প্রাণসাগর থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় হিলি কামাল পাড়ায়। এক বিকেলে সেখানে আসেন ক্যাপ্টেন ইদ্রিস। তিনি ছিলেন দুধর্ষ লোক । কেউ তার সঙ্গে যুদ্ধে যেতে রাজি  হতো না। তিনি খুঁজছিলেন ট্রেন সৈন্য। আমরা ১২জন রাজি হতেই তিনি আমাদের জিপে তুলে নিয়ে আসেন নিজের ক্যাম্পে। এরপর তাঁর সঙ্গে থেকেই যুদ্ধ করি আমরা।’
৪০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা জানতে চাইলে জব্বার বলেন, ‘গুলি খেয়েছি সেটি বড় কথা না, দেশ যে উপহার পেয়েছি, জাতি হিসেবে পৃথিবীতে জায়গা করেছি, এটিই আমার গৌরব।’ তিনি বুকভরা আশা নিয়ে বলেন, ‘আমাদের সংগ্রামের কথা, ত্যাগের কথাগুলো যেন পরবর্তী প্রজন্ম কখনো ভুলে না যায়।’
দেশ নিয়ে আক্ষেপের কথাও জানান এই বীর। তার ভাষায়, ‘পাশের দেশ ভারতের কথাই ধরেন,  দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের পথ বের করে। অথচ ৪০ বছরে আমাদের দেশে দলাদলির শেষ নেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা দিনে দিনে বাড়ছে। কে কেমন মানুষ তার গুরুত্ব নেই। কে কোন দলের, সেটাই যেন গুরুত্বপূর্ণ। এমন দেশের জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপর এটি হলে কোন সমস্যা থাকত না। এখনও ১১ টি সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংগ্রহ করা সম্ভব।’ জব্বার বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা, বীরঙ্গনার তালিকা কল্যান ট্রাস্টে জমা ছিল। কিন্ত সেটি তো দেখছে না কোন সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা শুধু বাড়ছেই। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তারাও এখন হাসতে হাসতে সরকারি ভাতা ওঠায়। এগুলো দেখলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুঃখ লাগে। সুবিধা পাব মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এমন চিন্তা তো ছিল না। লক্ষ্য ছিল একটাই- ‘দেশকে মুক্ত করতে হবে, খানদের হটাতে হবে।’
জব্বারের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে জীবন বলি দিতে হয়েছে তারই বড় ভাই আঃ সাত্তারকে। ১১ জুন ১৯৭১ সালে রাজাকাররা  তার ভাইকে ধরিয়ে দেয় পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে। ওই দিন তাঁর বৃদ্ধ পিতাকেও ১২ ঘন্টা বেধে রাখা হয় বটগাছের সঙ্গে। সে সব কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে যায় এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার।
নতুনেরা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে – এমনটাই আশা এই যোদ্ধার। একধরণের স্বপ্ন চোখে গম্ভীর কন্ঠে জব্বার বলেন, ‘ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো নতুনেরাও দেশের জন্য কিছু করবে- এটাই চাওয়া’।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সচলায়তন ব্লগে ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২

© 2012 – 2021, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button