কীর্তিমান বাঙালি

রক্ষা করা হোক অতীন্দ্র মোহন রায় এর স্মৃতিগুলোকে

প্রবীর বিকাশ সরকার

`জীবনে যা খুঁজছি তা পাইনি, তা পাব না। তবে তার স্বাদ পেয়েছি ইসারা পেয়েছি আপনার মত যারা শুধু মধু নিয়ে এসেছিলেন এবং আমার জীবন থেকে মৌমাছির মত মধুই সংগ্রহ করেছেন তাঁদের কাছ থেকে। এ মানুষ সংসারে বেশী নয়। দু’চারজন। স্ত্রী পুত্রও নয় অতীনবাবু।’ – এই চিঠিটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিখা।আর এই ‌’ অতীন’ হচ্ছেন সেই মহাবিপ্লবী অতীন্দ্র মোহন রায় । যিনি ভারতীয় সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ত্যাগী মানুষ। যিনি ত্যাগ-তিতিক্ষাকেই ধর্ম বলে জীবনে গ্রহণ করেছিলেন। বৃটিশদের অমানুষিক নির্যাতন, শ্বেতাঙ্গ শাসকদের পদলেহী লোভী বাঙালি তাঁবেদারদের শত অত্যাচার, হুমকি-ধামকি যাঁকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি । বরং সকল বিপদ-আপদ আর নিপীড়নকে সহাস্যে গ্রহণ করে যিনি মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় করে এগিয়ে গিয়েছেন ইংরেজ শোষকদের বিরুদ্ধে অকান্ত লড়াইয়ের দিকে।

জমিদারের সন্তান হয়েও অতীন্দ্র মোহন রায় ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত সাধারণ নাগরিক। রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন কিন্তু সস্তা রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হননি। সে সময়ে রাজনীতি ছিল পরিচ্ছন্ন আদর্শ ও দেশপ্রেমের প্রতীক। সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে, সমাজে শান্তি ও সমতা রক্ষার জন্য জাতীয়তাবাদী চেতনালদ্ধ কিংবা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের রাজনীতি করে গেছেন যাঁরা তাঁদের ক্ষেত্রে প্রাচুর্য, দারিদ্র বা উচ্চশিক্ষার বালাই ছিল না ।বরং কঠিন-কঠোর আপোষহীননীতির অহঙ্কারে প্রদীপ্ত ছিলেন তাঁরা। যা এখনকার রাজনীতিতে চিন্তারও অতীত!
১৮৯৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার ভোলাচং গ্রামের জমিদার পরিবারে জন্ম অতীন্দ্র মোহন রায়ের । স্কুল জীবনেই স্বদেশী আন্দোলনে হাতেখড়ি নেন, পরিত্যাগ করেন গৃহ। ১৯১১ সালে গুপ্তসংস্থা অনুশীলন সমিতির সদস্য হন। তিনি সর্বমোট পাঁচবার কারারুদ্ধ হন। পঁচিশ বছর জেলেই কাটিয়েছেন। বৃটিশ সরকারের ভয়ের কারণ ছিলেন এই বিপ্লবী। তিনি মহানন্দ এবং রঘু-বীর নামেও পরিচিত ছিলেন। অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী উপন্যাস ‘চার অধ্যায়ে’র [অতীন] এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য উপন্যাস ‘গণদেবতা’র [ডেটিনিউ যতীন] এই নায়কদ্বয়ই হচ্ছেন বিপ্লবী অতীন্দ্র মোহন রায়।অতীন্দ্র মোহন রায় মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন কুমিল্লা শহরস্থ বাগিচাগাঁও এর বাসিন্দা। তিনি ১৯৪৭ সালে কুমিল্লা  পৌরসভার  প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কুমিল্লা অভয় আশ্রম তথা গান্ধীআশ্রম গঠনে ছিল তাঁর বিশাল অবদান। বর্তমানে বিস্মৃত বসন্তস্মৃতি পাঠাগার এবং অমূল্যস্মৃতি পাঠাগার দুটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে অতীন্দ্র মোহন রায়ের একমাত্র পুত্র অসীমশান্তি রায় চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। এরপর পুত্রশোকে তিনি ক্রমশ লোকবিচ্ছিন্ন এবং মানসিকভাবে  অসুস্থ্ হয়ে পড়েন। পুত্রবধূর তত্ত্বাবধানে গ্রন্থপাঠকে জীবন সায়হ্নের একমাত্র অবলম্বন করে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন নিভৃতে। ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এই বীর বাঙালি।এহেন বীরবিক্রম বিশুদ্ধ বাঙালি মানুষটিকে নিয়ে আজ পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে খুবই কম। তাঁকে স্থান দেয়া যেতো পাঠ্যপুস্তকে। তাঁর জীবন ও কর্মকে অনুসরণ করার মতো ঘটনা তাঁর জীবনে একাধিক বিদ্যমান। প্রকৃত মূল্যায়ন তো দূরের কথা, শহরের একটি উপসড়কের নামকরণেই কুমিল্লাবাসী তাদের ঋণ পরিশোধে সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাঁর একটি স্মারক মূর্তি পৌরসভা তথা সিটি কর্পোরেশনের উদ্যানে স্থাপন করা যেতেই পারে। শুধু তিনিই নন, কুমিল্লার আরও একাধিক পথিকৃৎ নারী-পুরুষ যেমন বিপ্লবী শান্তি ও সুনীতি, দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মণ, কবি ও সাহিত্যিক অজয় ভট্টাচার্য, তদনুজ কবি ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, পন্ডিতপ্রবর রাসমোহন চক্রবর্তী প্রমুখেরও স্মারক মূর্তি স্থাপিত হতে পারতো শহরের নগর মিলনায়তন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে। কিন্তু হয়নি। এই অবহেলা ও অবজ্ঞা একমাত্র অকৃতজ্ঞ অবিবেচক বিস্মৃতপ্রবণ বাঙালিকেই যেন মানায়!
অতীন্দ্র মোহন রায় আজকে একমাত্র স্মৃতি হয়ে আছেন কতিপয় জীবিত ব্যক্তির মনে যারা কুমিল্লায় জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলা শাখার সক্রিয় সদস্য হয়েছিলেন। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অতীন রায় শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। শিশুদেরকে প্রকৃত সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাঁর আন্তরিকতার অন্ত ছিল না। এই ক্ষেত্রেও তিনি আজ কিংবদন্তি। তাঁর আপন বোনপো জজকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী অজিত কুমার চৌধুরীর কাছ থেকেও অনেক তথ্য জানা যায় এই মহান বিপ্লবী সম্পর্কে। তিনি বাগিচাগাঁও পাড়ায় ‘কিশোর বাহিনী’ নামেও একটি সংগঠন গঠন করেছিলেন শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেশাত্ববোধ জ্রাগ্রত করার জন্য।
তাঁকে নিয়ে কোনো ইতিহাস বা স্মারকগ্রন্থ এখনো প্রকাশিত হয়নি। ফলে তথ্যাদিও হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁর মৃত্যুর পরপরই একটি পত্রিকার সন্ধান পাওয়া গেলো উপরোক্ত অজিতবাবুর কাছে যেটা তাঁর স্মরণেই প্রকাশিত হয়েছিল, নাম ‘পত্রিকা’, একটি সাহিত্য-শিল্পবিষয়ক সাময়িকী। প্রকাশকাল জুন ১৯৭৯ সাল। আট পৃষ্ঠার নিউজপ্রিন্ট কাগজে মুদ্রিত একরঙা নির্মেদ কাগজটির সম্পাদক একদা কুমিল্লার সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী তরুণ কবি ও লেখক প্রয়াত আজিজুর রহমান মোমিন। সংযুক্ত সম্পাদক তরুণ কবি মমীন শাহাগীর ও পাখী রহমান। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বর্তমানে অধুনালুপ্ত সিংহ প্রেস থেকে মুদ্রিত। কাগজটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানেই যে, প্রচারবিমুখ অতীন্দ্র মোহন রায় সম্পর্কে বেশ কিছু দুর্লভ তথ্য জানা যায়। যেমন তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীটি লিখেছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক তৎকালীন দৈনিক বাংলারবাণী পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নির্মল সেন। ঔপন্যাসিক ও বিপ্লবীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারাশঙ্করের একটি চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা সম্ভবত তাঁকেই উদ্দেশ্য করে রচিত, অপ্রকাশিত অবস্থায় পাওয়া গেছে তাঁর ডায়েরিতে। একটি অমূল্য স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর বিধবা পুত্রবধূ ‘রঘুবীরকে চিনে নাও’ শিরোনামে অজন্তা রায় চৌধুরী। তাঁর লেখাতেই জানতে পারা যায় কিভাবে কিশোর অতীন্দ্র স্বদেশী সংগ্রামে দীক্ষা নিয়েছিলেন, কী দুঃসাহসিক কাজকর্ম করেছেন, কীরকম অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছেন, কতখানি ত্যাগ করেছেন মাতৃভূমি ও মানুষের জন্য! আরও জানা যায় তাঁর দুটি নাম যথাক্রমে মহানন্দ ও রঘুবীর হওয়ার কাহিনী।

অতীন্দ্র মোহন রায়ের আত্মীয় অজিত কুমার চৌধুরীর মন্তব্য থেকে জানা যায়, অতীন্দ্র মোহন রায়কে মরোণত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়েছিল। তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা লিপিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন তাঁর অসমাপ্ত ডায়েরিটিরও প্রকাশ। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন। কারাগারের অন্তরালে সময় অপচয় না করে চলমান জীবনের ঘটনাসমূহ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, সাহিত্যচর্চাও করেছেন। তাঁর অনেক লেখা ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে কুমিল্লার পত্রিকাতেও মুদ্রিত হয়েছে যার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে সংগ্রহ না করার কারণে।

আমরা কি পারি না অতীন্দ্র মোহন রায়ের মতো ত্যাগী মানুষদের স্মৃতিগুলোকে রক্ষা করতে ?

ছবি : লেখক

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button