মনকথা

মনের গবেষক মাহী কাজীর কথা

আরিফ সাহেবের দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে পড়ে ক্লাস নাইনে। মেয়েরা থ্রি ও ফোরে। থাকেন মোহাম্মদপুরের ভাড়া বাড়িতে। সরকারি চাকরি করেন। তাই আয়ও একেবারে সীমিত। তা দিয়ে বাড়ী ভাড়া আর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালানো কষ্টকর। প্রতিমাসেই ধার করে চলতে হয়। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে হরহামেশাই ফেলেন দীর্ঘশ্বাস।
এভাবে নানা চিন্তায় হঠাৎ একদিন দেখা দেয় হার্টের রোগ। রোগের কথা শুনেই আরিফ সাহেব আরো ভেঙ্গে পড়েন। রাজ্যের দুশ্চিন্তা ভর করে তার মনে। নিকট আত্মীয়রা একে একে দেখতে আসেন তাকে। নামকরা সব ডাক্তার দেখিয়েও কোন ফল হয় না। সবার একই কথা টেনশন ফ্রি থাকতে হবে। কিন্ত কিভাবে তা সম্ভব? কেউ বলতে পারে না। শরীরের জন্য প্রয়োজন প্রশান্তিময় ঘুম। কিন্ত কিভাবে আসবে সে ঘুম? প্রেসার কিংবা ঘুমের ঔষধ খেলে কী টেনশান কমে? আরিফ সাহেবের প্রশ্ন, ‘পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে কি থাকা যায়?’
উপরের ঘটনাটি রূপক অর্থে লিখা। শরীর কি মনকে নিয়ন্ত্রণ করে, নাকি মন নিয়ন্ত্রণ করে শরীরকে। মন আগে, নাকি শরীর। এরকম নানা প্রশ্ন কখনো কখনো ভর করে আমাদের মনে।
আজ থেকে প্রায় পচিশ বছর আগে এদেশের মানুষও জানতো না মনের শক্তির কথা। জানতো না মনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীরকে ঠিক রাখার কায়দা কানুন। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার বা মেডিটেশন পদ্ধতি শিখার কোন ব্যবস্থাও ছিলনা তখন। মনের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পদ্ধতি বাঙালিদের মাঝে প্রথম নিয়ে আসেন যিনি তিনিই প্রয়াত মাহী কাজী।
মানিকগঞ্জের কাজী পরিবারের কৃতি ও প্রতিভাবান ছেলে মাহী কাজীর পুরো নাম ছিল আব্দুল হামিদ কাজী। তিনি ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি তৎকালীন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বুয়েট) থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। তাঁর কর্মজীবন ছিল ব্যতিক্রমধর্মী ও বৈচিত্রময়। তিনি কিছুদিন তৎকালিন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে আইবিএম কোম্পানি কর্তৃক উপমহাদেশের দুইজন কম্পিটার প্রশিক্ষকের মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর তত্ত্বাবধানেই সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম কম্পিউটার তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে স্থাপিত হয়। এই পেশার সুবাদেই তিনি প্রথমে মধ্যপ্রাচে এবং পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যে গমন করেন। finalপ্রাচীনকাল থেকেই মন নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতির প্রচলন ছিল। ভারত মহাদেশে ছিল এর আদি চর্চা। পরবর্তীতে আমেরিকার টেক্সাস লরেডো শহরে মননিয়ন্ত্রণের আধুনিক ও ডাইনামিক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন হোঁজে সিলভা নামক স্পেনিশ বংশভূত এক ব্যক্তি। তিনি দীর্ঘ ২২ বছর মন নিয়ে গবেষণা করে ১৯৬৬ সাল থেকে প্রথম মন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক বেসিক লেকচার সিরিজ (বিএলএস) কোর্সের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন এবং মন নিয়ে তার গবেষণা অব্যাহত রাখেন। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে হোঁজে সিলভা আবিস্কার করেন আল্ট্রামাইন্ড ইএসপি সিস্টেমের। এটি ছিল তাঁর জীবন ও গবেষণার চুড়ান্ত ফল। হোঁজে সিলভার ভাষায় এটি ‘পৃথিবীতে মানব বিবর্তনের দ্বিতীয় অধ্যায়’।
পেশাগত কারণে মাহী কাজী যুক্তরাজ্যে গেলে সেখানেই পরিচিত হন সিলভা মেথডের সঙ্গে। তিনি সরাসরি হোঁজে সিলভার কাছ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং নিজের জীবনের গতি পাল্টে দেন। তিনি ক্যামব্রিজ শহরে সিলভা মেথড এর প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেশ কিছুদিন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের শেষের দিকে মাহী কাজী দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মন নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সিলভা মেথড শেখাতে শুরু করেন।
দেশে ফিরে মাহী কাজী আইসোমেট্রিক নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিলভা মেথড এর বিএলএস কোর্স শেখাতে শুরু করেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নানা প্রতিকূলতার কারণে তিনি আইসোমেট্রিক বন্ধ ঘোষণা করে সিলভা বাংলাদেশ নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিলভা কোর্স পরিচালনা করেন।
মাহী কাজীর মৃত্যুর পর তাঁরই ইচ্ছায় নতুন এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ হারুন। পরবর্তীতে সৈয়দ হারুন হোঁজে সিলভার সর্বশেষ আবিষ্কার সিলভা আল্ট্রামাইন্ড ইএসপি সিসটেম নামক মাইন্ড ট্রেনিং কোর্স বাংলাদশে পরিচালনার এবং মাহী কাজীর জীবনের মিশনকে দেশময় বিস্তৃত করার লক্ষ্যে সিলভা বাংলাদেশ এর নাম পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন এম.কিউ (মাহী কাজী) মিশন। মাহী কাজীর এই শীষ্যই বর্তমানে সিলভা আল্ট্রামাইন্ড কোর্সের বাংলাদেশের কান্ট্রি সুপারভাইজার ও একমাত্র ট্রেইনার।
অন্যদিকে মাহী কাজীর মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মীনি বন্ধ থাকা আইসোমেট্রিক প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় চালু করেন। চালু হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে সিলভার বিএলএস কোর্স এবং বর্তমানে সিলভা ইনটিউশন সিসটেম কোর্সটি পরিচালনা করছে। বর্তমানে ডেসটিনি গ্রুপের মোহাম্মদ সাইদুর রহমান ইনটিউশন কোর্সের কান্ট্রি ডাইরেক্টর।
এছাড়া বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত কোয়ান্টাম মেথড এর প্রবর্তক মহাজাতক শহীদ আল বোখারী, ক্রিয়েটিভ মেডিটেশনের প্রবর্তক ড. হাসানসহ এদেশে মন নিয়ন্ত্রণের যতগুলো মেথড চালু রয়েছে তাদের প্রায় সবাই মাহী কাজীর কাছ থেকেই প্রথম সিলভা মেথড কোর্সের প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা লাভ করেছেন।
এদেশে এভাবেই মাহী কাজীর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মেডিটেশন চর্চার শুরু। উন্নত বিশ্বের মতো এখন এ দেশের মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বেড়েছে, বেড়েছে রোগ নিরাময়ের প্রয়োজনে যত্রতত্র ঔষধ গ্রহণ না কারার প্রবণতা। ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রয়া থেকে বাঁচতে মানুষ নির্ভর করছে নানা ধরণের বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর। পৃথিবীর প্রায় ১২০টি দেশের মতো এ দেশেও চলছে মনকে নিয়ন্ত্রণ করে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকার বিভিন্ন পদ্ধতির চর্চা। মন নিয়ন্ত্রণ বা মেডিটেশন বা মাইন্ড ট্রেনিং করছেন হাজার হাজার মানুষ।
আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে রয়েছে নানা সমস্যা। প্রত্যেকেই চাই এই সমস্যাগুলোর শান্তিময় সমাধান। চাই রোগহীন চিন্তামুক্ত জীবন। না পাওয়ার বেদনা আমাদেরকে করে তুলে অস্থির। ফলে আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসটুকু। অপরের ভাল ও  কল্যাণের কথা চিন্তা করার মানসিক সক্ষমতা আমাদের মাঝে লোভ পাচ্ছে প্রবলভাবে। ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে মানবতার বোধটুকু। তাই মনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের দৃষ্টিভাঙ্গিটাকে বদলানো এখন আর কোন কঠিন বিষয় নয়।
বাংলাদেশে মন নিয়ে চর্চা তথা মাইন্ড কন্ট্রোল মেথড এর পথিকৃত মাহী কাজী পরলোক গমন করেন ৪ জানুয়ারী ২০০৭ সনে। রেখে যান মানবতাবোধ সম্পন্ন হাজার হাজার অনুসারীকে। এদেশে মেডিটেশন বা মাইন্ড কন্ট্রোল মেথড চর্চার ইতিহাসে মাহী কাজী স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি নাম।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে  ২ জানুয়ারি ২০১২ তে

© 2012 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

One Comment

  1. ভাগ্যক্রমে তার সাক্ষ্যাত পেয়েছিলাম। আল্লাহ্ তার মঙ্গল করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button