আদিবাসী

মাহালীদের নানা বিশ্বাস ও আচার

একপাশে একটি মসজিদ আর অন্যপাশে গির্জা। মাঝ বরাবর সরু রাস্তাটি চলে গেছে মাহালীপাড়ার দিকে। এলোমেলো ভাবে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি আর ডালাগুলো পড়ে আছে এদিক ওদিক। কোনো কোনো ঝুড়ি বা ডালা পুরোপুরি তৈরি হওয়া, কোনোটি আবার শুরু হয়েছে মাত্র। কাজ ফেলে সবাই ভিড় জমিয়েছে একটি বাড়িতে। বাড়ির ভেতর মহিলারা কান্নার মাতন তুলেছে। সবার চোখ ভিজে উঠেছে কান্নার জলে।
এ পাড়ার সবচেয়ে বয়ঃবৃদ্ধা জুলিয়া হেমব্রন। বয়স একশো পাঁচের মতো। গতরাতে জুলিয়া মারা যায় হঠাৎ করেই। গোটা পাড়া হয়ে যায় স্তব্ধ। সবার মাথার ওপর থেকে যেন সরে গেছে বটগাছের ছায়াটি।
দিনাজপুরের মিশন এলাকার মাহালীপাড়া এটি। মাত্র ২৫টির মতো মাহালী পরিবারের বাস এখানে। আমরা যখন পৌঁছাই গোত্রের মহৎ বা মানঝিসহ পরিষদের অন্যান্যরা তখন নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ সবাইকে ডেকে আনছে। কেউবা চলে গেছে কবর খুঁড়তে।
মৃত ব্যক্তিকে গোসল করাচ্ছেন গোত্রের জনাকয়েক মহিলা। গোসল শেষ হতেই  আত্মীয়স্বজনেরা ভিড় জমায়। পালা করে মৃতের গায়ে হলুদ মাখে। মাহালী সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বিশ্বাস  একদিনের পর আর কোনো দিন কেউ মৃত ব্যক্তিকে স্পর্শ করতে পারবে না। আর সে কারণেই মৃতের গায়ে হলুদ মাখা হয়।
এরপর মৃত ব্যক্তিকে সাদা কাপড় পরিয়ে সুগন্ধি দেয়া হয়। গোত্রের মানঝি আব্রাহাম হাজদা জানালো এক সময় মৃতের পরবর্তী জীবনে যাতে কোনো অভাব না হয় সে কারণে নাকি কাপড়ের ভেতরে টাকা পয়সা দিয়ে দেয়া হতো। একই সঙ্গে দেয়া হতো মৃতের পছন্দের কিছু ব্যবহার্য জিনিস।
মাহালীদের মৃত্যুর পরের আচার ও বিশ্বাসগুলো অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন। গোসলের পর কবরে নেয়া হয় মৃতকে। তখন মহিলারা যেতে পারে গ্রামের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত মাত্র। লাশ নিয়ে যাওয়ার পর গোত্রের মেয়েরা পুকুরে পানিতে তেল ও সিঁদুর মিশিয়ে গোসল সেরে নেয়। পানিতে তেল ও সিঁদুর যদি সহজেই মিশে যায়Ñ তাহলে তারা বিশ্বাস করে এটি মৃতের স্বাভাবিক মৃত্যু। আর তা না হলে ধরে নেয়া হয় এই মৃত্যু অস্বাভাবিক।
আমরা অবাক হয়ে শুনতে থাকি একটি আদিবাসী জাতির আচারগুলোর কথা। মৃত ব্যক্তির আত্মার মুক্তির জন্য মাহালীরা কবরে মৃতের শরীরে ফুল ছিটায়। অতঃপর সাড়ে তিন হাত কবরে বাঁশের মাচা দিয়ে কবর দেয়া হয়। ঘণ্টা তিনেক পর জুলিয়া হেমব্রনকেও কবর দেয়া হলো সেভাবেই।
কবর দিয়ে ফেরার পথে মানঝি আরো জানাল এক সময় নাকি মাহালী সম্প্রদায়ে মৃতদেহ দাহ করা হতো। শ্মশানে মৃতদেহ নেয়ার সময় একটি ডিম ভাঙ্গা হতো। মাহালীদের কাছে ডিম আমিষের প্রতীক। পরবর্তী জীবনে মৃতের যেন আমিষের অভাব না ঘটে সে বিশ্বাস থেকেই এই আচার। কাঠের উচ্চমূল্যসহ নানা কারণে এদেশের মাহালীরা এখন আর মৃতদেহ দাহ করে না।
মাহালী সম্প্রদায়ে মৃত্যুর পর দশ দিন ধরে মৃতের বাড়িতে পালন করতে হয় অশৌচ। এ সময় পরিবারের সদস্যদের চুল, দাড়ি কাটা একেবারেই নিষেধ। দশ দিন পর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালন করে তবেই কাটতে হয় চুল, দাড়ি।
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানকে মাহালী ভাষায় বলে ‘ভান্ডান’। ভান্ডানের আগের দিন ‘ঊমূল আদের’ অনুষ্ঠান পালন করে এরা। ঐদিন মৃতের আত্মীয়স্বজনসহ গোত্রের লোকেরা গ্রামের দুই প্রান্তে দু’টি মোমবাতি জ্বালিয়ে মৃত ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে স্মরণ করে। মোমবাতির আলো যদি একটি অপরটিকে আলোকিত করে তবে মাহালীরা মনে করে মৃত ব্যক্তির আত্মা তার পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেছে। ফলে পৃথিবীতে তার নামে আর কোনো অভিযোগ থাকে না।
খানিক চুপ থেকে মানঝি আবারো বলতে থাকেন। ভান্ডানের দিন মৃত ব্যক্তির আত্মার উদ্দেশ্যে ভোজসভার আয়োজন করা হয়।  প্রথানুসারে ঐদিন মৃতের আত্মীয়স্বজনরা চাল, হাঁস, মুরগি, শূকর ইত্যাদি ভোজের সামগ্রী নিয়ে আসে মৃতের বাড়িতে। মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে করা হয় বিশেষ প্রার্থনা। ভোজের সময় খাবারের থালায় মৃতের উপস্থিতি লক্ষ্য করে মাহালীরা। এরা মনে করে ঐদিন মৃত ব্যক্তি শেষবারের মতো খাবার খেতে পৃথিবীতে আগমন করে।
কথা বলতে বলতে আমরা আবারো চলে আসি মাহালীপাড়াতে। বড় একটি পাকুরগাছের নিচে আয়েশ করে বসে পরে গোত্রের মানঝি, দাও হাজদা, জয়নিকা হেনব্রমসহ কয়েকজন। আমরাও শরীরটাকে হেলে দেই গাছের ছায়া।হেমব্রম বা হাজদা অর্থ কি? এ রকম প্রশ্নে সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে। খানিকটা ভরকে যাই আমরা। কিন্ত দাও হাজদা উত্তর দিতে থাকায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই মাহালীরা মনে করে তাদের গোত্রের সঙ্গে পেশার সম্পর্ক আছে। সে কারণেই এক সময় সরেন গোত্রের লোকেরা সিপাহী সৈনিকের কাজ করত বলে তাদের বলা হতো সরেন সিপাহী। একইভাবে কিস্কু গোত্রের লোকেরা রাজপাট চালত বলে তাদের বলা হতো কিস্কুরাজ। মুরমু গোত্রের লোকেরা পুরোহিতের কাজ করত বলে তাদের মুরমু ঠাকুর বলা হতো। হেমব্রমরা কুমার বা দেওয়ানের কাজ করত। বাস্কে গোত্রের লোকেরা বিনিময় প্রথার মাধ্যমে ব্যবসা করত। হাঁজদা ও টুডু গোত্রের লোকেরা লোহার জিনিস তৈরি করত এবং উৎসবের সময় বাদ্যযন্ত্র বাজাত। এসব বিশ্বাস ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে মাহালীদের জীবন থেকে। পূর্বে মাহালীদের ৩৪টি গোত্র পরিচয় থাকলেও বর্তমানে শুধুমাত্র হেমব্রম, হাঁজদা, বাস্কে, মুরমু, টুডু, সরেন, বেসরা, মার্ডি, কিস্কু গোত্রগুলোই টিকে আছে।
পূজা পার্বণের কথা উঠতেই জয়নিকা হেমব্রম জানাল ‘সিঞ বোঙ্গা’ বা সূর্যদেবী পূজার কথা। ঐতিহ্যগতভাবে মাহালীরা সূর্যের উপাসক। এ সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বারো বছর অন্তর গ্রামের মঙ্গলের জন্য সূর্যিদেবীর পূজা করে থাকে। সাধারণত বৈশাখ মাসে এ পূজা করতে হয়। এ সময় মাহালীরা জাহের থান বা প্রার্থনার স্থানে সূর্যিদেবীর উদ্দেশ্যে বলি দেয়। অতঃপর বলির মাংস রান্না করে সকলকেই খাওয়ায়। একই সঙ্গে চলে হাড়িয়া বা চুয়ানি খাওয়া।
দাও হাঁজদা জানলো দেবী মনসার কথা। মনসার শক্তিতেই একসময় মাহালীরা সাপে কাটা রোগী ভালো করত অনায়াসে। এখনো মন্ত্র পড়ে সাপের বিষ নামাতে পারে এ গোত্রের মানঝি আব্রাহাম। কি ভাবে বিষ নামাতে হয়? প্রশ্ন করতেই আব্রাহাম উচ্চ কণ্ঠে পড়তে থাকে মন্ত্র;
‘কারিকুলমু আলেক ডার
চৌদ্দ সাপিনীর চর্বি মার
মানুষকে খায়-
হাড়ে কুড়ে বিষ নাই
কি কি সাপতো নাম।
গমা, গোফলা চিতিচুয়া, চিতি চিমটিয়া
জলপিড়ে জলপিড়ায় গরু আত্রে গেয়ানি
কালিদো কালি নিচিন কালি
কেবল উরদাই, কেবল মুরদাই’।
ভাদ্র মাসে করতে হয় মনসা পূজা। এ পূজায় ঘরের বাইরে মনসা দেবীর মূর্তি তৈরি করে তার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হয়। আর কোন পূজা বা উৎসব আছে কিনা? প্রশ্ন করতেই দাও হাঁজদা প্রায় এক নিশ্বাসে বলতে থাকে কারমা, গারয়া, মাঘসিম, শারুল, জিতিয়া, এরক্, লবান প্রভৃতি।
শিশুর জন্মকালীন সময়ে আদিবাসী মাহালীরা জন্মস্থানে অন্য কোনো গর্ভবতী নারী ও যুবতী মেয়েদের প্রবেশ করতে দেয় না। শিশুর জন্ম হওয়া মাত্রই তাকে শুকনো কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। অতঃপর মায়ের জরায়ু থেকে গর্ভফুল  বের না হওয়া পর্যন্ত দাই শিশুর নাড়ি কাটেন না। ছেলে সন্তান হলে মাহালীরা বাঁশের টুকরো ছাল বা তীরের ধারালো অংশ দিয়ে নাড়ি কাটে। এরা বিশ্বাস করে তীরের ধারালো অংশে নাড়ি কাটলে ছেলে সাহসী ও নির্ভীক হবে। আর বাঁশের ছাল দিয়ে নাড়ি কাটলে ভবিষ্যতে ছেলেটি মাহালীদের আদি পেশা বাঁশ-বেতের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। আর মেয়ে শিশুর নাড়ি কাটা হয় শুধুই শামুকের খোলসের ধারালো অংশ দিয়ে।
ক্রমেই আমাদের গল্প জমে ওঠে। জয়নিকা জানাল বিয়ে নিয়ে মজার সব তথ্য। মাহালীদের বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটি হয় তিন দিনব্যাপী। এক সময় এ অনুষ্ঠান চলত ৭ থেকে ৯ দিন পর্যন্ত। আলাদাভাবে বর-কনের বাড়িতে হয় গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। মাহালীদের ভাষায় এটি ‘শুনুম শাসাং ওজক্’। গায়ে হলুদ দেয়ার পর থেকে বর বা কনে বাড়ির বাইরে যেতে পারে না। আত্মীয়স্বজন  বর-কনেকে  হলুদ দেয় গান গাইতে গাইতে। বলতে বলতেই গায়ে হলুদের একটি গান ধরে জয়নিকা :
‘খুদি গুড়া বাবা পুষে বাড়হাইলাম
বছরও দিনে বাবা হেরিগেল’
গানের অর্থ : ছোটবেলা থেকে চাল খুদ খেয়ে বড় হলে, আর এখন তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে।
গায়ে হলুদের পর বিয়ের মূল পর্ব শেষে হয় নববধূ বরণ পর্বটির সঙ্গে। মাহালীরা একে ‘বাহু পরছ্যও আদের’ বলে। এ অনুষ্ঠানে বরের মা একটি ডালায় আমপাতা, দূর্বাঘাস, কিছু ধান নিয়ে নববধূকে গুড় বা মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেয়।
আবার বরের বাড়িতে ভোজের দিনে আত্মীয়স্বজনেরা উপহার নিয়ে আসে। উপহার প্রদানের অনুষ্ঠানকে মাহালীরা ‘বাঁধাপণ’ বলে। বাঁধাপণ হিসেবে দেয়া হয় সংসারের কাজে ব্যবহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। বাঁধাপণ দেয়ার পদ্ধতিটি বেশ অন্যরকম। প্রবীণ ব্যক্তিকে যখন বর-কনে ডান হাত মুঠিবদ্ধ করে মাথায় হাত ছুয়ে ডবক্ (প্রণাম) করে তখন ঐ ব্যক্তি আশীর্বাদস্বরূপ উপহার তুলে দেয় বর-কনের হাতে। উপহার প্রদানকারী যদি বর-কনের ছোট হয় তাহলে সে বর-কনেকে ডবক্ করে।
সন্ধ্যা নামতেই মাহালীপাড়ার সবাই চলে যায় নিজ নিজ ঘরে। মৃতের বাড়িতে বেজে ওঠে শঙ্খ আর উলুধ্বনি। নির্ঘুম চোখগুলো জেগে থাকে নানা স্মৃতিচারণের ধমকা বাতাসে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button