ভ্রমণকথা

সেতু থেকে সেতু দেখা

দুই বছর পরেই স্টেশনটির বয়স হবে ১০০ বছর। ব্রিটিশ আমলের ইট-সুরকির লাল দালান। চারপাশে সবুজ বৃক্ষরাজি। স্টেশনটি আর দশটির মতো নয়। টিকিট কাউন্টার, ওয়েটিং রুমসহ অন্যান্য কক্ষ সমতলে। আর ট্রেনে উঠতে হয় স্টেশন থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে গিয়ে। আঁকাবাঁকা সিঁড়ি উঠে গেছে উপরের দিকে। এটি অনেকটাই দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি স্টেশনগুলোর মতো। দুই দিকে উঁচু উঁচু গাছ। হঠাৎ ঝিকঝিক্ শব্দে ছুটে আসে একটি ট্রেন। ট্রেনের গতিতে দোল খায় গাছের ডালপালা। দেখতে অন্য রকম লাগে।

স্টেশনে খানিকটা বিরতি। অতঃপর ছুটে চলা। চোখের সামনেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। যেন লোহার সুড়ঙ্গ পথ। হর্ন বাজিয়ে ট্রেনটি ছুটে চলে সে পথে। পাকশী রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছিলাম দৃশ্যগুলো। মনে হচ্ছিল লাল রঙের লোহার টেস্টটিউবের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে ট্রেনটি।
06গত বছরের কথা। শীত তখনও শেষ হয়নি। দিনটি ছিল শুক্রবার। দুই বন্ধু মিলে এসেছি ঈশ্বরদীর এক বন্ধুর বাড়িতে। অচেনা জায়গায় দিনভর ঘোরাঘুরি আর আড্ডাবাজি করে কাটাব। তেমনই পরিকল্পনা।
বন্ধু শামীমের বাড়ি ঈশ্বরদী। তার কাছে মুঠোফোনে শুনেছি ঈশ্বরদীর নানা গল্প। তাই জুয়েলসহ সিদ্ধান্ত হয় সেখানে যাওয়ার। রাত ১১টার বাসে শ্যামলী থেকে রওনা হই আমরা। বাসের নামটিও বেশ, ‘ঈশ্বরদী এক্সপ্রেস’।
ঈশ্বরদীতে যখন পা রাখি তখন কাকভোর। হালকা কুয়াশার চাদরে যেন জড়িয়ে আছে প্রকৃতি। বাস থেকে নেমেই থ হয়ে যাই। চারপাশে সিক্ত মনছোঁয়া এক দৃশ্য। চেনা দৃশ্যের অচেনা স্বাদ। ক্রিংক্রিং বেলের শব্দে খেয়াল ফিরে পাই। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি রিকশায় সোজা চলে আসি শামীমদের বাড়িতে।
ক্লান্তি কাটাতে ঘণ্টাদুয়েক ঘুম। অতঃপর নাশতা সারা। পদ্মার নানা পদের মাছের তরকারির সঙ্গে চলে খিচুড়ি। এক কাপ গরম চা খেয়ে ঢেঁকুর তুলি। পরে দুটি মোটরসাইকেলে বেরিয়ে পড়ি আমরা।

ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখার ইচ্ছে বহুদিনের। একই সঙ্গে দেখব লালন সেতুটিও। তাই আমরা চলে আসি পাকশীতে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশ দিয়ে প্রথম আসি পাকশী রেলস্টেশনে।
স্টেশনে দাঁড়িয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ভেতর দিয়ে রেল যাওয়ার দৃশ্য অন্য রকম লাগে। ট্রেনটি হারিয়ে যেতেই আমরা চলে আসি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের একেবারে নিচে, চর পড়া জমিতে। সেখানে এক ধরনের ভালো লাগা ভর করে মনে। চোখের সামনে দুটি সেতু। একটিতে শুধু রেল চলে অন্যটিতে যান। দুটিই পদ্মার ওপর হয়ে মিশে গেছে লোকালয়ে। দুটিই কুষ্টিয়া আর ঈশ্বরদীর মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করেছে। নিচ থেকে সেতু দুটিকে একসঙ্গে দেখতে বেশ লাগে।
02হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। জুয়েল আর শামীম গেল কোথায়? খোঁজ করতেই দেখা মেলে। দূরে পদ্মার পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে তারা। আমিও এগোই। কাছে যেতেই জুয়েল গান ধরে, ‘এই নদীতে সাঁতার কাইটটা বড় হইছি আমি, এই নদীতে আমার মায়ে কলসিত নিত পানি’। পদ্মার জলে পা ডুবিয়ে আমরাও গানের সঙ্গে সুর মিলাই।
নদীর ঘাটে দুটি নৌকা বাঁধা। চোখ পড়তেই দেখি একটিতে ঘোমটা টেনে বসে আছেন এক নববধূ। পা ধুয়ে বর নৌকায় উঠতেই মাঝি লগি টেনে নৌকা ভাসায়। নবদম্পতি বেড়াতে এসেছিল কোন আত্মীয়ের বাড়িতে। কয়েকজন যুবতী পাড়ে দাঁড়িয়ে বিদায় জানায় তাদের। আমরাও চেয়ে থাকি নৌকার পানে।
চোখের সামনে থেকে একসময় হারিয়ে যায় নৌকাটি। যুবতীরাও ফিরতে থাকে আপন ঘরে। শামীম জানায়, লালন সেতু থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর পদ্মার রূপ দেখতে নাকি অন্য রকম লাগে। শুনেই লোভ হয়। লুফে নেই প্রস্তাবটি। যেতে যেতে শামীমের মুখে শুনি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরির ইতিকথা।
১৮৮৯ সালের কথা। আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার জন্যই পরিকল্পনা হয় পদ্মার ওপর ব্রিজ নির্মাণের। ব্রিজ তৈরির দায়িত্ব পড়ে ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইল্সের ওপর। তিনি ১৯০৯ সালে সার্ভে শুরু করেন। ১৯১০-১১ সালে পদ্মার দুই তীরে ব্রিজ রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মিত হয়। এভাবে প্রায় ২৪ হাজার শ্রমিক দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৫ সালে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। সে সময়কার ভাইসরয়ের নামেই নামকরণ হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’। ৫ হাজার ৮০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ব্রিজটি নির্মাণে খরচ হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ টাকা।
কথায় কথায় টোলঘর পেরিয়ে আমরা চলে আসি লালন সেতুর ঠিক ওপরে। সেতুর মাঝামাঝি আসতেই মোটরসাইকেল থামিয়ে আমরা দেখি চারপাশের দৃশ্য। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশটায় যেতেই চোখ বড় হয়ে ওঠে। শামীমের কথাই ঠিক। সেতু থেকে সেতু দেখা। সত্যি অন্য রকম ভালো লাগা দোল খায় মনে।
জুয়েল দেখছিল নিচের পদ্মার রূপ। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠে বলে, ‘দেখ দেখ অদ্ভুত দৃশ্য’। আমরাও তাকাই নদীর পানে। নদীপথে দূর থেকে আসছে বালুভর্তি নৌকা। একটি নয়। প্রায় পঞ্চাশের অধিক। একটির পেছনে আরেকটি। অনেকটা পিঁপড়ের মতো। দু-একটা আবার পালতোলা। দেখতে বেশ লাগছিল। পালতোলা নৌকা তো দেখাই দায়। আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি দৃশ্যগুলো। শামীম জানাল বর্ষায় পদ্মার রূপ নাকি আরও বদলে যায়। তখন চারপাশ পানিতে থৈ থৈ করে। ফলে নদীপাড়ের দৃশ্যগুলোও বদলে যায়। মনে মনে ঠিক করে ফেলি সে রকম সময়ে আসব আরেকবার।
সূর্যটা একেবারে মাথার ওপর। পেটবাবাজি খানিকটা অশান্ত। তাই আমরা ছুটি ঈশ্বরদীর পথে। দূর থেকে দেখি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আর পদ্মাকে। ক্ষণে ক্ষণে বদলে গিয়ে দৃষ্টির সীমা থেকে একসময় হারিয়ে যায় সব দৃশ্য।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক যুগান্তরে, প্রকাশকাল: ১৮ নভেম্বর ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button