আদিবাসী

মহৎজাতি মুন্ডা পাহান

কখনো কখনো বৃষ্টি গ্রামের সহজ সরল লোকদের এক নিমেষেই ভিজিয়ে দিচ্ছে, আবার পরক্ষণেই ঠাঁ ঠাঁ রোদে শুকিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। ভাদ্রমাসে বৃষ্টি পড়ার সময় দূর থেকে যে কারোরই মনে হবে যেন বিশ্ব বিধাতা তার প্রিয় পৃথিবীর সবুজ বাগানগুলোকে নিজ হাতে গোসল করাচ্ছেন। বৃষ্টির ফোটা উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে গেলাম ভেনতারার মোড়ে। মোড়ের চারদিকে বিশাল আকৃতির শত শত মেহগনি গাছের ছায়া-ঢাকা নীরবতা। মেহগনির অন্যরকম প্রাণ জুড়ানো শীতল ছায়া যে কোনো পথিককেই একটু বিশ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। মোড় থেকে বাম পাশে কিছুটা পথ এগুলেই রাস্তার ডানে সুবজ শালবন। এই বিশাল শালবন ঘেঁষে গড়ে উঠেছে আদিমানুষের গ্রামগুলো। তেমনি একটি ছোট গ্রামের নাম গোদাবাড়ী। এক সময় এখানের শালবনটি ছিল আরো গহীন। আর বনই ছিল আদিবাসীদের প্রাণ। গোদাবাড়ী গ্রামটিতে গায়ে গায়ে লাগানো ধূসর মাটির ঘরগুলোর একটিতে সময়ের সাক্ষী হয়ে দিন কাটাচ্ছেন ৯০ বছর বয়স্ক এক আদিবাসী। নাম মাঠু পাহান। কাঁপা কাঁপা গলায় নাগরী ভাষায় গ্রামটি ও তার জীবনের আদিকথাগুলো জানালেন তিনি। বলল, ‘এগলে জঙ্গল রই, জঙ্গল ভাইনকে ঘর বাইধি।’ ঘরে প্রবেশ করেন মাঠু পাহানের বড় ছেলে হরিস পাহান। এই গ্রামেরই মন্ডল সে। নানা কথার ফাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন নিজের জাতিসত্তাটিকে। মানকি মুন্ডা নয় এ গ্রামের সকলেই আদিবাসী মুন্ডা পাহান।
মাঠু পাহানের তিন ছেলের মধ্যে চৈতন্য ও পরিমল দেশ স্বাধীনের পর পরই চলে যায় ভারতে। তাদের জন্য মাঠুর মন কাঁদে। তারা কেমন আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে মাঠু তা জানে না। সীমান্তের কালো কাঁটা তারের বেড়া শুধু দেশকে নয়, এই আদিবাসী পরিবারটিকেও করেছে বিভক্ত। মাঠু জানান, ব্রিটিশ আমলেরও পূর্ব থেকে তারা দিনাজপুরের এই গ্রামটিতে বাস করছে। এসেছে ভারতের ছোটনাগপুর থেকে। মাঠু পাহানের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই সব দিনগুলোর কথা। শিকার করাই ছিল সে সময়ে আদিবাসী মুন্ডা পাহানদের প্রধান কাজ। এরা দল বেঁধে শিকারে বের হতো গহীন বনে। পূর্বপুরুষদের রীতি মেনে এখনো শিকারে বের হওয়ার তিনদিন পূর্বে এরা দলবেঁধে শিকারের পরিকল্পনা করে। আর গোত্রের মহিলাদের ‘হাড়িয়া’ তৈরির প্রস্তুতি নিতে তাদের ভাষায় বলে, ‘হাড়ি রাখন, দম আসি দিন নিকলো বই।’ মুন্ডা পাহানদের বিশ্বাস শিকারে বের হওয়ার আগে শিকারি ভূতকে সন্তষ্ট করতে পারলে অধিক শিকার মিলবে। তাদের ভাষায়, এটি ‘ধুমন উরায়ে’। তাই শিকারের দিন বের হওয়ার পূর্বে গ্রামপূজার স্থানে মাটিতে ও গাছে সিন্দুর (সিদুর) দিয়ে শিকারি ভূতের কাছে এরা মানত করে। হরিস পাহানের ভাষায়, ‘মানতি করলে পাবই, ঘুরকে লেয়ে আসওবই’। এখনো আদিবাসী মুন্ডা পাহানদের  শিকারের একমাত্র অস্ত্র তীর-ধনুক। তারা বলে, ‘শিকার- তীর ধনুক লেকে মারা যায়েলা।’ গহীন বনে এক সময় নানা প্রজাতির শিকার মিললেও দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পাহানদের প্রিয় শিকারগুলো। তবুও মুন্ডা পাহানদের পছন্দের শিকারগুলোর মধ্যে এখনো আছে ‘মুসা’ (বড় ইঁদুর), লারেয়া (গাছে থাকা এক ধরনের জন্তু), চুটিয়া (ছোট ইঁদুর), ঘুগু, মায়না (ময়না), লাম্ভা (খরগোশ), কেরকেটা, পেঁচা, হকসা (বড় পাখি বিশেষ), দুনদু প্রভৃতির। আদিবাসীদের শিকারের উপযুক্ত সময় চৈত্র-বৈশাখ মাস। দলবেঁধে শিকার করে প্রথমে শিকারি ভূতকে দেয়া মানতের শিকার বলি দেয়া হয়। অতঃপর শিকারগুলো গোটা গ্রামের পরিবারগুলোর মধ্যে পরিমাণ মতো বণ্টন করে দেয় এরা। গোত্র বা দলের মধ্যে এই সমবণ্টন রীতিই সভ্য সমাজের জন্য অনুকরণীয়। আর এ কারণেই শত দারিদ্র্যের মাঝেও যুগ যুগ ধরে টিকে থাকছে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো। শিকার খাওয়ার সঙ্গে ধুমধামের সঙ্গে চলে হাড়িয়া খাওয়া, চলে ‘ঝুমের নাচ’।শিকারে যতই আনন্দ থাকুক না কেন অন্যান্য আদিবাসীদের মতোই ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক এই তিন মাস মুন্ডা পাহানদের কাটাতে হয় সীমাহীন কষ্টের মাঝে। এ গ্রামেরই খোকা  পাহান জানায়, তাদের পূর্ব পুরুষদের সময় আবাদি জমি কম ছিল ফলে তখন অভাব ছিল বেশি। এখন আবাদি জমি বেশি থাকায় তাদের কাজের সুযোগ বেড়েছে। ফলে তাদের ধারণা আগের তুলনায় ভালোই আছে তারা। স্বল্প চাহিদার এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে যা ভালোথাকা আধুনিক সমাজের কাছে তা চরম দুর্ভিক্ষ।
অভাবের এই তিন মাস পাহান গ্রামটির অধিকাংশ নারীই বেরিয়ে পড়েন জঙ্গি কান্দার (আলু) সন্ধানে। বন থেকে দুই ধরনের জঙ্গি আলু সংগ্রহ করে তারা। এর মধ্যে ‘পেন্টি কান্দা’ সব সময় খাওয়া গেলেও ‘গেঠি কান্দা’ তেঁতো হওয়ায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় খেতে হয়। এই গেঠি কান্দা নিয়ে মুন্ডা পাহানদের মধ্যে নানা কল্পিত গীত চালু আছে। ভারতীর ভাষায়,‘মায়ে বেটি বোনে গেল, গেঠি কান্দা খড়ি লে ল, বোঝা ভইর কাঠি বান্ধ’। এই সময়টাকে আদিবাসী গ্রামের পুরুষরা টাকার জন্য ঘুরতে থাকে মহাজনদের বাড়ি বাড়ি। আর মহাজনরা এখনো আদিবাসীদের দুঃসময়ের সদ্ব্যবহার করে। কমরেটে মহাজনদের কাছ থেকে আগাম মজুরি এনে পরিবার চালায় পাহানসহ এ অঞ্চলের আদিবাসীরা। তিন মাস পর যখন ফসল কাটার সময় হয় তখন বাজারে দৈনিক মজুরি যত টাকাই হোক আদিবাসীরা মহাজনদের জমিতে কাজ করে আগের রেটে। টংক, তেভাগা ও সাঁওতাল বিদ্রোহসহ এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিবাদে আদিবাসীদের সংগ্রামী অংশগ্রহণ থাকলেও  ‘মহাজন’ নামটি এখনো আদিবাসীদের জীবনের দীর্ঘশ্বাস হয়েই টিকে আছে।
খোকা পাহান জানায়, অভাবের এই তিন মাসেই তাদের পালন করতে হয় ‘করমা’ আর ‘দুর্গা পূজা’। এখানের পাহান সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা সনাতন ধর্ম পালন করলেও অন্যান্য জাতিগুলো হতে এরা আলাদাভাবে বেশি ধর্মীয় আচারের প্রতি আকৃষ্ট। পূজার কথা উঠতেই খোকা নিবিষ্ট মনে গেয়ে ওঠেন, ‘কে কে যাবেন গংগম স্থানে, হামু যাব ঠাকুর দর্শনে’। খোকার শেষ হতেই পাশ থেকে করমাপূজার গান ধরেন কৈলাশ পাহান। ‘আমার বন্ধু সওদাগর, নদীর কূলে বান্দে ঘর- বন্ধু হে, উজানে ভাইটানে দুটি ঘর।’ মাঝ পথে গান থামিয়ে হেসে হেসে কৈলাশ বলে, ‘হাড়িয়া না খেলে গিত নেহি নেকলে লা’।
এ গ্রামের মন্ডল বলতে থাকে পাহানদের বিয়ের পর্বগুলোর কথা। বিয়ের কিছু  কিছু পর্ব অন্যান্য আদিবাসী জাতি সত্তার সঙ্গে মিলে গেলেও বেশ কিছু আচার মুন্ডা পাহানদের একান্তই নিজস্ব। এদের বিয়েতে এখনো বর পক্ষ মেয়েকে পণ হিসেবে দেয় ১২ টাকা। এছাড়াও প্রথা অনুসারে মেয়ে পক্ষের জন্য দিতে হয় ৫টি শাড়ি আর ‘সাজ দৌড়ি’। সরিষার তৈল, ৫ কেজি চাল, কিছু খাবার তৈল, হলুদ, মরিচ ও অন্যান্য মসলা, ছাতু একত্রে বাঁশের ডালায় সাজিয়ে দেয়াকে পাহানরা ‘সাজ দৌড়ি’ বলে। অবিশ্বাস্য হলেও মুন্ডা পাহানদের বিয়েতে আসা বরপক্ষের সকলকে পা ধুইয়ে কনের বাড়িতে প্রবেশ করানো হয়। তাদের ভাষায় এটি ‘গড় হাত ধুয়া’। অতঃপর  বড় চালনে থাকা তালের পাখা, এক ছড়ি কলা, দুধ, আতপ চাল, লাড়–, গুড়, পান, ঘাস ও প্রদীপ প্রভৃতি থেকে প্রদীপ জ্বালিয়ে ও গুড় খাইয়ে বরকে বরণ করে নেয় মেয়ের মা, খালা আর ফুপুরা। পাহানরা একে বলে ‘বরকে চুমাহান’ পর্ব। পরে সাজানো মারোয়ার (বাড়ির উঠানে পাতা ও কলাগাছ দিয়ে সাজানো স্থান বিশেষ) কাছে উভয়পক্ষের ম-ল বা মহতের উপস্থিতিতে বর ও কনে একটি শিলপাটার উপর দাঁড়িয়ে পরস্পর পরস্পরকে সিন্দুর (সিদুর) পড়ায়। এটিই আদিবাসী মুন্ডা পাহানদের বিয়ের মূল পর্ব।
নানা দুঃখ, কষ্ট ও অভাবের মধ্যে এভাবেই কেটে যাচ্ছে এ অঞ্চলের আদিবাসী মুন্ডা পাহানদের জীবন। পূর্বপুরুষদের সনাতন ধর্ম পালনকারী এই পাহান গ্রামটির বাইশটি পরিবারের কাছে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব এসেছে নানাভাবে,  নানা সময়ে। অভাবের মাঝেও ভবিষ্যৎ আর্থিক সচ্ছলতা, বিনা মূল্য চিকিৎসাসেবা, ছেলেমেয়েদের নিশ্চিত জীবনের প্রলোভন এসেছে বহুবার। খ্রিস্টান মেম সাহেবদের পদধূলিও পাহান গ্রামটিতে পড়েছে বার কয়েক। কিন্তু নিজেদের জাতিধর্ম ত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে গ্রামের সবাই। খোকা পাহানের ভাষায়, ‘জাত ধ্বংস করমু না’। নিজেদের সনাতন ধর্মের প্রতি এভাবেই মুন্ডা পাহানরা রয়েছে অবিচল। ধর্ম বিশ্বাসের পাশাপাশি পাহানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে মিথ্যা বললে পাপ হয়। আর পাপ হলে চোখ বা হাত পা নষ্ট হয়ে যাবে। যে জাতির বিশ্বাসে মিথ্যার প্রচলন নাই তারা নিঃসন্দেহে মহৎ জাতি। সত্যিই মহৎ জাতি আদিবাসী মুন্ডা পাহানরা।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৮ অক্টোবর ২০০৯

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button