কীর্তিমান বাঙালি

ভাষাসৈনিক শিল্পী ইমদাদ হোসেন : এক বাঙালি নক্ষত্র

শিল্পী ইমদাদ হোসেনের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ নভেম্বর চাঁদপুরে। বাবার নাম মজিদ বক্স, মায়ের নাম সাবেদুন নেসা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। পারিবারিক আবহই তাঁর মধ্যে শিল্পী হওয়ার প্রেরণা সঞ্চার করেছিল।তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জে পৈত্রিক বাড়ীতে। স্কুলের লেখাপড়াও সেখানেই।

প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ইমদাদ হোসেন  ১৯৪৮ সালে ভর্তি হন তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজে (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে ইমদাদ হোসেন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে কেরানীগঞ্জে দাঙ্গা প্রতিরোধে অনন্য ভূমিকা রাখেন। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে মিছিলে তিনিও ছিলেন প্রথম সারিতে। তিনি ছিলেন ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। ২০ ফেব্রুয়ারি সারা রাত তিনি সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে থেকে পোস্টার-ব্যানার লেখার কাজ করে পরদিন সমাবেশে অংশ নেন।

১৯৫৩ সালে তিনি ছাত্র অবস্থাতেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকাসহ নানা ধরনের কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে ‘ভিবজিওর’ নামের একটি বাণিজ্যিক চিত্রকলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ওই বছরের ২১ নভেম্বর তিনি মামাতো বোন মনোয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম মনোয়ারা বেগম বকুলি। তার চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিন ছেলেই চারুকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণকারী শিল্পী।
কর্মজীবনে ইমদাদ হোসেন অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে শিল্পী হিসেবে এশিয়ান ফাউন্ডেশন, ইস্ট পাকিস্তান ডিজাইন সেন্টার, সুইডিশ-পাক ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার প্রজেক্ট, পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের প্রধান ডিজাইনার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে কাজ করেন। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ‘মুক্তধারা’ নামের একটি প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে তোলেন।নানা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ চালিয়ে যান ইমদাদ হোসেন। ১৯৬১ সালে ছায়ানট প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই শিল্পী ইমদাদ হোসেন ছিলেন সংগঠনটির একজন সক্রিয় সদস্য।
তিনি ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। পটুয়া কামরুল হাসানকে সভাপতি ও তাঁকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় ‘চারুশিল্পী সংস্থা’। এই সংগঠন থেকে প্রকাশিত হয় বড় বড় পোস্টার-ব্যানার। মুক্তিযুদ্ধের সময় কেরানীগঞ্জে তাঁর বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল।
ইমদাদ হোসেন নিজে সরাসরি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও বাম রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তাঁর বাড়িতেই পার্টির গোপন সভা হতো এবং আত্মগোপনকারী নেতারা তাঁর ঢাকার ভাড়া বাসায় বা গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিতেন।
১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন। বিটিভির বর্তমান লোগোটি তাঁরই করা। ১৯৭৬ সালে বিসিকের ডিজাইন সেন্টারে যোগ দেন এবং ১৯৯১ সালে এখান থেকেই অবসর নেন। পরে তিনি কাজ করেছেন কালার স্ক্যান লিমিটেডের উপদেষ্টা হিসেবে।
বিসিকের ডিজাইন সেন্টারে কাজ করার সময় প্রধান নকশাবিদ হিসেবে তিনি দেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্প মেলাকে শহরাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ঢাকায় বৈশাখী মেলা, বসন্ত মেলা ও যশোরে মধূমেলার আয়োজন করেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের থেকে তাঁতিদের বাঁচাতে বিসিকের উদ্যোগে তাঁতবস্ত্রের মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
শিল্পী ইমদাদ হোসেন চারুশিল্পে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো, দৈনিক জনকণ্ঠ আজীবন সম্মাননা, চারুশিল্পী সংসদের সম্মাননাসহ বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন।

১৩ নভেম্বর ২০১১, রবিবার,  তিনি ইন্তেকাল করেন।

তথ্য ও ছবি  : সংগৃহীত

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button