আদিবাসী

সোনারাম কাহিনী এবং অন্যান্য

সুমনা চিসিম সবার উদ্দেশে একটি ধাঁধা ছুড়ে দেন। প্রথমে গারো ভাষায়, পরে বাংলায় বুঝিয়ে দেন ধাঁধাটি।

খাসিন খাসিন মাললেংআ
মান্দি জাগাম মাননে’আ
দগা চুপপে খাটিংআ’
অর্থাৎ
হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে চলে
মানুষের পায়ের শব্দ পেলে
দরজা বন্ধ করে লুকায় সে।
ধাঁধা শুনে আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করি। কাজিম ভাই মগজ কছলান। কিন্তু তবু মাথা থেকে বের হয় না ধাঁধার উত্তরটি। কড়া পাড়ার অন্যদের অবস্থাও তাই। আমাদের যেন মগজ দোলাই দশা। তবুও উত্তর মিলে না। মুচকি হেসে সুমনাই বলেন উত্তরটি। এটি হচ্ছে ‘শামুক’।
দিনাজপুরের কড়া পাড়ায় বসে কথা চলছিল সুমনা চিসিমের সঙ্গে। এই গারো নারীর গ্রামের বাড়ি হালুয়াঘাটে। কিন্তু চাকরির সুবাদে তার দিনাজপুরে আসা। বর্তমানে তিনি স্থানীয় এক এনজিওতে কাজ করছেন। গারোদের নিয়ে তার সঙ্গে চলে নানা বিষয়ে আলাপচারিতা। কথায় কথায় সুমনা জানালেন গারোদের একটি বীরত্বের কাহিনী।
ছোটবেলা থেকেই সুমনা তার পিতা হরিপদ রিছিলকে দেখেছেন গারোদের নানা সমস্যা সমাধান করতে। তিনি রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নিতেন এবং মানুষের নানা সমস্যা শুনে সমাধান করার পরামর্শ দিতেন। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে সুমনা শুনেছেন এক গারোর বীরত্ব কাহিনী। সেই বীর ছিলেন গারোদের প্রথম রাজনৈতিক নেতা। তার নাম সোনারাম সাংমা ।
এক সময় গারোদের বসতি ছিল বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। আসামসহ বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জুড়ে। সময়ের গতিতে এসব এলাকার বেশিরভাগই গারোদের কাছ থেকে বেদখল হয়ে যায়। কিভাবে গারোরা তাদের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করল তারই কাহিনী এটি।
১৮৬৭ সাল। সোনারাম সাংমা জন্মগ্রহণ করেন রংগ্রকগ্রি গ্রামে। পরবর্তীতে তিনি আমগুড়ি গ্রামে বসবাস করেন। আমগুড়ি বর্তমান ভারতের আসাম রাজ্যে অবস্থিত। সোনারাম পড়াশুনা করেছেন প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত। সেই সময়ে গারো এলাকায় কোনো স্কুল ছিল না। ফলে বহু কষ্টে তাকে লেখাপড়া করতে হয়। সোনারাম কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে গৌহাটিতে পুলিশ বিভাগে কাজ নেন। এক সময় পুলিশের কাজ ছেড়ে তিনি কাজ করেন রোড সুপারভাইজার হিসেবে। এই কাজের বদৌলতেই গারো অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার সুযোগ ঘটে সোনারামের। তিনি গারো গ্রাম ঘুরে দেখতেন তাদের উপর অত্যাচার আর নির্যাতনের করুণ দৃশ্যগুলো।
সে সময় জমিদারগণ গারোদের জমিজমা জোর করে দখল করে নিত। আর গারোরাও তা পুনরায় দখল করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতো। এসব কারণে গারোদের পাশে না থেকে ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তা ও জমিদারগণ উল্টো তাদেরই শাস্তি দিত। গারোদের ওপর এমন অত্যাচার দেখে সোনারামের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
৭ বছর কাজ করার পর ১৮৮৯ সালে তিনি সরকারি কাজ ছেড়ে দেন। তিনি ভাবতেন সরকারি কাজ করে গারো জাতিকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। চাকরি ছেড়ে সোনারাম গারোদেরকে তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন করে তুলতে থাকেন। এভাবে এক সময় তিনি গারোদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি গারোদের বিষয়ে মূল চারটি দাবি চিহ্নিত করেন এবং জনমত গড়তে থাকেন। যেমন : ১. ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তাগণ গারোদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দিত এবং বিনা বেতনে কাজ করাত। এটা বন্ধ করতে হবে ও বেতন দিয়ে কাজ করাতে হবে। ২. গারোদের চাষাবাদের জমিজমা গারোদের সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার জোরপূর্বক রিজার্ভ ফরেস্ট করার পরিকল্পনা নিচ্ছিল। সোনারাম ভাবতেন এটি বন্ধ করতে হবে ও গারোদের কাছে ফিরিয়ে আনতে হবে। ৩. গারোদের জমিজমা জমিদাররা লিখিয়ে নিত। যা অন্যায় এবং তা বন্ধ করতে হবে ও ফিরিয়ে আনতে হবে। ৪. গারো এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে অন্যায়ভাবে গারোদের শাস্তি দিচ্ছিল। তা দ্রুত বন্ধ করতে হবে।সোনারাম আর সাংমা গারোদের সংগঠিত করতে গ্রামে গ্রামে যেতে লাগলেন এবং ১৮৯৯ সাল থেকে সংগ্রাম শুরু করেন। লুপ্ত হওয়া বা দখল হওয়া জমিগুলি উদ্ধার, অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়ার প্রতিবাদ, জমিদার কর্তৃক জমি দখল প্রতিরোধ করা ও রিজার্ভ ফরেস্ট করা থেকে বিরত থাকার জন্য ১৯০০ সালে সিনখারি গ্রামে জড়ো হয় হাজার হাজার গারো। তারা সভা করে বারবার সরকারের কাছে তাদের দাবিদাওয়া লিখিতভাবে জানাতে থাকে।
প্রবল চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার দাবিদাওয়া আংশিক মেনে নেয়। ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ সরকার রিজার্ভ ফরেস্ট না করা ও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ না করানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। পরবর্তীতে সোনারাম সাংমা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর অন্য দুটি দাবি পূরণ করার আগেই ১৯১৬ সালে আগস্ট মাসের ২৭ তারিখে সোনারাম মারা যান। আজও নানা দাবি আদায়ে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গারোরা উজ্জীবিত হয় সোনারামকে স্মরণ করে।
আমরা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম সোনারামের বীরত্বের কাহিনী। সোনারামের গল্প শেষ হতেই সুমনা জানালেন গারোদের দল বিভক্তির কথা। গারো সমাজ মোট ১৩টি দলে বিভক্ত। দলগুলো হলো  আওয়ে বা আখাওয়ে, আবেং, আমং, রূগা, চিবক, চিসক, দোয়াল, মাচ্চি, কচ্চু, আতিয়াগ্রা, মামাবেং, চিং এবং মেগাম। এই ১৩টি দল ছাড়াও আরো সাতটি ছোট গারো দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। গারো দলগুলোর আচার, ভাষা ও জীবনযাপনেও রয়েছে ভিন্নতা। সুমনার মতে, এক সময় গারো পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বসবাসের ফলেই গারো দলগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
গারোদের মধ্যে আবেংরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশের গারো এলাকাসমূহের প্রায় অধিকাংশ এলাকাতেই আবেং দলের গারোদের বসবাস। সুমনা জানাল তার পরিবারও আবেং দলের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আমং দলের গারোদের নিয়ে প্রচলিত আছে একটি ধারণা। উত্তর ব্রহ্মদেশ হতে আগত অহোম রাজারা যখন আসাম দখল করে তখন কামরূপ এলাকা হতে কোচরা প্রাণভয়ে পশ্চিমে কুচবিহার অঞ্চলের দিকে পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক কোচ সোমেশ্বরী নদী পাড়ি দিতে পারে না। ফলে তারা পূর্বতীরে গারোদের আশ্রয় লাভ করে। সময় কাটতে থাকলে গারোদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। কালক্রমে তারা গারোদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। গারো ও কোচদের মধ্যে এই মিশ্র বিবাহের বংশধররাই পরবর্তীকালে গারোদের আমং দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গারো পাহাড়ের সোমেশ্বরী নদীর অববাহিকায় বাঘমারা হতে সিজু পর্যন্ত এবং বাংলাদেশের কলমাকান্দা অঞ্চলে আমং গারোদের বসবাস। এরা শিক্ষায় ও আর্থিক দিক দিয়ে অন্যদের থেকে বেশ উন্নত।
মেঘালয়ের ভোগাই নদীর উভয় তীরে এবং বাংলাদেশের দুর্গাপুরে রূগা দলের গারোদের বাস। অন্যদিকে চিবক দলের গারোরা নিতাই নদীর উভয় তীরের গারো পাহাড় অংশে এবং বাংলাদেশের হালুয়াঘাট অঞ্চলে বসবাস করে। গারো পাহাড়ের মধ্যাঞ্চলে সোমেশ্বরী নদীর উজান অববাহিকায় এবং বাংলাদেশের দুর্গাপুর ও ধোবাউড়ায় দোয়াল দলের গারোদের বাস।
সুমনা চিসিম জানালেন অবাক করা এক তথ্য। যে দলটির কারণে গারো নামের প্রচলন ঘটেছে বাংলাদেশে সে দলের কোনো গারো নেই। এরা হচ্ছে গারা  গানচিং। সংক্ষেপে এদের গারা নামে অভিহিত করা হয় এবং কালক্রমে তা সমগ্র গারো সম্প্রদায়কে গারোতে পরিণত করে। এছাড়া গারোদের আওয়ে, চিসক, মাচ্চি, কচ্চু, আতিয়াগ্রা, মামাবেং দলের কোনো গারোর বসবাস এদেশে নেই।
গারোদের দল নিয়ে নানা কথার জালে আমরা জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। পাশে বসা বন্ধু কাজিম জানতে চাইল ছোট সাতটি গারো দলের নাম। সুমনা হরহর করে বলতে থাকেন নামগুলো- ব্রাক, শমন, গ-ায়, গালনেং, মালং, জারিয়াদং প্রভৃতি।
সুমনা জানালেন এক সময় গারোদের মধ্যে দুটি গোত্রের প্রচলন ছিল। গোত্র দুটি সাংমা ও মারাক। পরবর্তীকালে এদের মধ্যে মোমিন, শিরা, আরেং প্রভৃতি গোত্রেরও প্রচলন হয়। গোত্রের নামকরণের ক্ষেত্রেও রয়েছে এক একটি ঘটনা। এগুলো আজো গারো সংস্কৃতির অংশ। তেমনই একটি ঘটনার কথা বললেন সুমনা।
‘মারাক’ গোত্রের প্রচলন হয় একজন দৃঢ় চরিত্রের গারো নারী থেকে। কোনো এক সময় গারো সমাজে ছিল এক রূপসী যুবতী। তার রূপে তার মাসতুতো ভাইয়ের পাগলপর অবস্থা। নানা ভাবে সে তাকে প্রেম নিবেদন করে, বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তবুও যুবতীর মন পায় না। ন্যায়পরায়ণ ও সচ্চরিত্রের অধিকারিণী  সেই যুবতী বারবার তাকে ফিরিয়ে দেয়। অবশেষে সেই মাসতুতো ভাই যুবতীর আশা ত্যাগ করে। যুবতীর এমন দৃঢ়চেতার পরিচয় পেয়ে তার সমাজের লোকেরা তাকে ‘মারাক্’ নামে সম্বোধন করেন। মারাক শব্দের অর্থ দৃঢ় মহিলা। কালক্রমে যুবতীটি ‘মারাক’ নামেই অভিহিত হন। পরবর্তীতে এভাবে তার বংশধররাও মারাক নামে পরিচয় লাভ করে।
গল্প আর কাহিনী শুনতে শুনতেই বেলা পড়ে যায়। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা ডুবডুব। আমরা ফিরতি পথে। লোকালয়ের পথে নামতেই মন থেকে ক্রমে হারিয়ে যায় গারোদের সকল কাহিনী। হারায় না শুধু গারোদের বীর সোনারামের নামটি।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে  ২০ অক্টোবর ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button