ভ্রমণকথা

সবুজ পাহাড় আর সোমেশ্বরীর চর

সোনালি-লাল বালুপথ। পাশ দিয়ে ফিতের মতো সোমেশ্বরী বয়ে চলেছে। স্রোত এখন কম, ভরা বর্ষায় ফুলে ওঠে। তবে সোমেশ্বরীর চর এখন ফুলে ফুলে ভরা। চিকন ডাটায় ভর দিয়ে সাদা সাদা কাশেরা অবিরাম বাতাসে ঢেউ তোলে। আকাশ পড়ে নদীর গায়। তুলো তুলো পাহাড় নদীর জলে ভাসে। চরের ওপারে আবার সত্যিকারের পাহাড় ছড়ানো, সবুজে মোড়া। সবচেয়ে বড় পাহাড়ের চূড়াটি মেঘে মাখামাখি। আকাশ ঝা ঝা নীল। তুলা মেঘ ছুটে চলেছে – কবি কালিদাসের চিঠি পৌঁছাতে হবে বুঝি!
পূজার ছুটি ছিল। বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের বন্ধু সুমন আটাশজনের বড় দল বেঁধে ফেলল। বিরিশিরিসহ আরো সব জায়গা ঘুরবে। সকাল সাতটায় মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে হাজির হওয়ার এলান জারি করল। বাস ছাড়বে সাড়ে সাতটায়।
পাঁচ ঘণ্টা লাগল নেত্রকোনার শুকনাকুড়ি যেতে। যানগুলো বুঝি ছুটি কাটাতে গিয়েছে তাই জট পাইনি কোথাও। তবে রাস্তার সে কী অবস্থা! মনে হলেও কান্না পায়। শুকনাকুড়িতে পৌনে এক ঘণ্টা লাগল বিরিশিরির ওয়াইএমসিএর বিশ্রামাগারে পৌঁছাতে। পেটের তখন ত্রাহি অবস্থা। সাফসুতরো হয়ে খাবার ঘরে ঢুকলাম। ভাজি, ডাল আর দেশি মুরগির গোশত-অমৃত ঠেকল।
দলের ব্যবস্থাপক করা হয়েছে রবিকে। ব্যস্ততায় বেচারা ত্রস্ত। গলায় ভার চাপিয়ে বলল, ‘শার্প চারটায় রওনা দিব। কেউ লেট করলে পস্তাতে হবে।’ সুমন ছবি তোলার কাজ নিয়েছে। ‘ভাইয়া আমার একটা’ বলতেই আর রেহাই নেই – একটু ডানে সরো, ঘাড় সোজা করো, মুখটাকে পাঁচের মতো করে রেখো না ইত্যাদি বলছে আর ক্লিক করছে। ইঞ্জিনচালিত বড় একটি নৌকা ঠিক করাই ছিল। বিরিশিরি ঘাট থেকে ভেসে যাই সোমেশ্বরীতে।
সবাই যেন শরতরূপে বিভোর হয়েছিল। সুমন বসেছিল নৌকার মগডালে। সোমেশ্বরীর প্রেমকাহিনী শোনাচ্ছে মেয়ে বন্ধুদের – প্রেম না পেয়ে সোমেশ্বরী কেঁদেছিল অঝোরে। সেই কান্না নাকি এই নদী হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে! আমি ভাবি, আজকালকার মেয়েদের এসব শুনিয়ে কাত করা যায়? নৌকা এগোতে থাকে। পথ দেখাচ্ছে গোপাল, মঞ্চ নাটকে নিবেদিতপ্রাণ। মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আমাদের সঙ্গে চলেছে। মিনিট ২০ চলার পর পাহাড়গুলো কাছে চলে এল, হাতের কাছে বলতে গেলে। গম্ভীর রবি আবেগ রুধিতে নারি, চেচিয়ে বলে, ইয়াহু, অদ্ভুত। সুমন গল্পে সুবিধা করতে না পেরে ক্যামেরা টিপে চলেছে। নদীর জল ঝকঝকে যাকে বলে স্বচ্ছতোয়া।
চরটা ক্রমেই এগিয়ে এল। গোপাল বলে, এই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। বর্ষায় লুকিয়ে যায়, শরতের গোড়াতেই ভেসে ওঠে। চরে কাশের সংখ্যা অসংখ্য। আইনাল মাঝি নৌকা ভেড়ান চরে। বৃষ্টি আর শারমিন ছুট লাগায়। অন্যরাও বাদ যায় না। ছেলেরা ফুটবল নিয়ে এসেছে। খেলতে লেগে যায়। মেয়েরা কাশছাড়া হয় না। এমন সুন্দরের মায়া ছাড়ানো সত্যি কঠিন। সুমনের সঙ্গী হয়ে মেয়েদের খুঁজতে বের হই। চরের শেষ প্রান্তে বৃষ্টি আর শারমিনের দেখা পাই। এখান থেকে পাহাড়টা একেবারে কাছে। হাতে কাশফুল নিয়ে দুই বান্ধবী পাহাড় দেখায় মজেছে। তাদের হাসাহাসিতে একটু একটু পাহাড়ের স্তব্ধতা ভাঙে। আমরা পেছন থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। ঘোর ভাঙাতে ইচ্ছে করে না।
সূর্যটার ডুব দেওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। ওপারের গ্রামের পেছনে লুকাতে শুরু করেছে। আকাশে আবির ছড়িয়ে সোমেশ্বরীকে আকুল করে তুলল। রঙ মাখল সেও। সবাই চরের একপাশে জড়ো হয়ে সূর্যাস্ত দেখি। আস্তে আস্তে আশ্বিনের চাঁদ মাথা তুলল। চরের চরাচর বদলে গেল অল্প সময়ের মধ্যে। কিছুক্ষণ একে অন্যকে দেখে আমরা আবার ছোটাছুটি শুরু করি। গায়ে বালু লাগিয়ে নামি নদীর জলে। জোছনামাখা জলে সাঁতার কাটার অনুভূতি একদম আলাদা -একবার মুখ তুলে আকাশ দেখি আবার রূপা জলে গা ডুবিয়ে দিই। অপার্থিব লাগে আশপাশ। ডুবাডুবি করে ক্লান্ত হয়ে নৌকায় উঠি। সামিয়ার কণ্ঠ মিঠা, ‘আজ জোছনারাতে সবাই গেছে বনে’ ধরল সবার চাপাচাপিতে। আমাদের ভেসে যেতে সময় লাগল না।

ছবি : মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালের কন্ঠে অন্য কোনোখানে পাতায় ১৬ অক্টোবর ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

  1. : লেখাটা দারুন হয়েছে। যদিও ভালবেসে সুমিস্ট বাঁশ আমাকে উপহার দেয়া হয়েছে। লেখাকে আকর্ষনিয় এবং আনন্দপাঠের উপেযোগী করার লক্ষে এইরকম…বাঁশ খাওয়া যায়। বন্ধু বলে বলছি না, ভাল ছবি এঁকেছিস। শুভ কামনা রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button