আদিবাসী

ভাষা হারানোর শঙ্কায় মাহালীরা

শহরের মধ্যেই কোনো আদিবাসী গ্রাম থাকতে পারে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আদিবাসী নামটি মনে আসতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাখি ডাকা সবুজ বন, মুক্ত, লোকালয়হীন এক স্বপ্নময় সুখী মানুষদের গ্রামের ছবি। নাম শুনলেই মাদল, ঢোল, মন্দিরা আর দলবেঁধে নাচতে থাকা মেয়েদের নূপুরের শব্দ বেজে ওঠে মনে। কিন্তু সে সব কিছু নেই এই গ্রামটিতে। শব্দ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আদিবাসী সম্প্রদায়টির কথা জানায় পুলকবাবু। দিনাজপুর ডিসি অফিসের সামনেই বিশাল বড় একটি খোলা মাঠ। সবাই জানে বড় মাঠ হিসেবে। অনেকেরই ধারণা গোটা রাজশাহী বিভাগের মধ্যে অন্য কোনো শহরে এমন বড় মাঠ নেই। শীত মৌসুমে মাঠের একাংশ জুড়ে চলে মেলাসহ নানা আয়োজন। অন্য অংশে সারাবছরই চলে তরুণ ও যুবকদের খেলাধুলা। বড় মাঠের মতো গোটা জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার নানা পুরাকীর্তি ও স্থাপত্য নিদর্শন। এ জেলাতেই বহু পূর্ব থেকে বাস করছে নানা আদিবাসী সম্প্রদায়। সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিল এ আদিবাসীরা। আদিবাসী মানেই একটি সভ্যতা, একটি ভাষা আর অন্যরকম আদি সংস্কৃতির রূপকার। সে হিসেবে দিনাজপুরবাসীরা নিশ্চয়ই গর্বিত। এ রকম নানা চিন্তা করতে করতেই পৌঁছে গেলাম শহরের দক্ষিণে বড় মাঠের শেষ প্রান্তের কসবা মিশন এলাকায়। একদিকে একটি বড় গির্জা আর অন্যদিকে একটি ছোট্ট মসজিদ। এর মাঝ দিয়ে ঢালুতে নেমে গেছে সরু পথ। খানিকটা যেতেই দেখা গেল ছোট্ট মাঠের মধ্যে কয়েক মহিলা ও পুরুষ বাঁশ দিয়ে তৈরি করছে নানা জিনিস। সারা মাঠেই এলোমেলোভাবে পড়ে আছে বাঁশের নানা খন্ডাংশ। দুজন মহিলা বাঁশ দিয়ে আপন মনে বুনে যাচ্ছে বড় বড় ঝুড়ি। কাজ ছাড়া অন্যদিকে খেয়াল নেই তাদের। শিল্পী যেন আপন মনেই ডুবে রয়েছে তার শিল্পকর্মে। এক যুবতীর নাম জানা গেল স্বপ্না কিসকু। নামের টাইটেল শুনে তারা সাঁওতাল কিনা জানতে চাইলে, স্বপ্না ভুল ভাঙায়, মাহালী ভাষায় বলে, ‘আলেদো মাহালে কালালে’ অর্থাৎ আমরা আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায়।
শহরের এ এলাকাটির নাম কসবা বিশথ পাড়া। এখানেই রয়েছে আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায়ের প্রায় ২৫টি বাড়ি। জানা যায় এখানের মাহালীদের প্রত্যেকেই তাদের বাপ-দাদার আমল থেকে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। প্রত্যেকেরই জন্ম হয়েছে মাহালী খ্রিস্টান পরিবারে। আর তাই আদিবাসী হিসেবে সনাতন ধর্ম ঘেরা তাদের নানা উৎসব আর সংস্কৃতিগুলো দিনে দিনে হারিয়ে গেছে তাদের জীবন থেকে। একটি বাড়িতে ঢুকতেই ৭০ বছর বয়স্ক দাও হাজদাকে দেখা গেল বাড়ির উঠানে বসে বড় বড় বাঁশের টুকরি তৈরি করছে। উঠানের অন্য পাশে বসে আছে ১০০ ঊর্ধ্ব বৃদ্ধা জুলিয়া হেমব্রন। বয়সের ভারে কানে না শোনায় আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে শুধুই তাকিয়ে আছে সে। জুলিয়া এখন বেঁচে আছে শুধুই কালের সাক্ষী হয়ে। দাও হাজদা থেকে জানা যায় আদিবাসী মাহালীরা তাদের নামের শেষে ৭টির মতো টাইটেল ব্যবহার করে। হেমব্রন, মুরমু, কিছকু, হাজদা, মারডি প্রভৃতি। এদের এক টাইটেলের ছেলেমেয়েদের মাঝে বিয়ে নিষিদ্ধ। মাহালীরা মনে করে এদের এক টাইটেলের পূর্ব পুরুষ ছিল একজন। তাই এক টাইটেলের ছেলেমেয়েদের রক্ত একই। বাইরে থেকে দাও হাজদার সামনে কিছু বাঁশের অংশ এনে ফেলল তার স্ত্রী ফিলোমিনা মারডি। সে জানায়, পূর্ব পুরুষদের আমল থেকেই আদিবাসী মাহালীরা বাঁশের কাজের সঙ্গে যুক্ত। কিনে আনা  মাকলা বাঁশ কেটে প্রথমদিন মাহালীরা ছোট সাইজ করে বিড়াই তৈরি  করে। এটিকে ‘বিতি’ বলে। এরপর এই বিড়াই থেকেই তৈরি করা হয় বাঁশের ধামা (ঢালি), টুপলা (বাঁশের তৈরি ছোট বাটি বিশেষ), চেঙ্গারি, বিনি, হাটা (কুলা), টুকরি প্রভৃতি। মাহালীরা কেন শুধুই বাঁশের কাজ করে। দাও হাজদা জানায় এ কাজে স্বাধীনতা আছে। হয়ত এ কারণেই তাদের পূর্ব পুরুষরা এ পেশায় যুক্ত ছিল। পূর্ব পুরুষদের পেশা হওয়ায় তারাও ধরে রেখেছে বাঁশের কাজকে।সাঁওতালদের মতো আদিবাসী মাহালীরা তাদের গোত্রের প্রধানকে ডাকে মাঝি হারাম বা মহত বলে। এ ছাড়াও রয়েছে জগ মাঝি ও গডেত। সনাতন ধর্ম মতে মহতকে গোত্রের প্রত্যেকটি পরিবারের জন্য বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হলেও মাহালীরা ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হওয়ায় এখন নিজেদের ঝগড়া বিবাদ মীমাংসা ও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ছাড়া মহতের আর তেমন কোনো দায়িত্ব নেই। এখানকার মাহালী গোত্রের মহত আব্রাহাম হাজদা জানায় তাদের পূর্ব পুরুষরা এসেছে ভারতের দুমকা থেকে। এক সময়ে এক মহাল থেকে অন্য মহালে ঘুরে বেড়াত বলেই আদিবাসী এই সম্প্রদায়টির নাম হয়েছে মাহালী।
খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণের পর থেকেই মাহালী জাতির ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, বিশ্বাস, আচার ও ঐতিহ্য আজ অবলুপ্ত প্রায়। আদিবাসী মাহালীরা হারিয়ে যাচ্ছে অন্য একটি জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির মাঝে। মহত জানায়, তাদের ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে খ্রিস্টান হিসেবে, আদিবাসী মাহালী হিসেবে নয়। আবার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাছেও থাকছে না তাদের সম্মানটুকু। খ্রিস্টানদের কাছে তারা শুধুই আদিবাসী।
ধর্মান্তরিত হলেও আদি কিছু বিশ্বাস এখনো রয়েছে মাহালীদের মাঝে। গোত্রের মহত জানায়, বাড়িতে কারো বমি বা পেটের ব্যাধি হলে মাহালীরা বলে ‘হই নাম করকে’ অর্থাৎ বাতাসে পেয়েছে। আর এই বাতাস থেকে মুক্তি পেতে তখন ডাকা হয় ‘জান গুরু’ বা  ওজাকে।  অধিকাংশ ওজাই এখন হাতুড়ে ফলে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হলে  চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন  হয় এরা। আদিবাসী মাহালী সম্প্রদায়ে নবজাতকের জন্মের ৯ বা ১১ দিনের দিন যখন নাভি পড়ে ঐ দিন পালন করতে হয় বিশেষ আচার। মাহালী ভাষায় এই দিনটিকে বলে ‘কামানী’। ঐ দিন বাড়িতে ডাকা হয় নাপিতকে। নাপিত এসে গোত্রের পুরুষদের চুল ও দাড়ি কামিয়ে দেয় আর মেয়েদের কানি আঙ্গুলের নখ ঘষে দেয় ক্ষুর বা ব্লেড দিয়ে। মাহালীদের বিশ্বাস, এতে গোত্রের সবার শুদ্ধি ঘটে। এ ছাড়াও মাহালীদের নবজাতকের নামকরণের অনুষ্ঠানকে বলে ‘বাত্তিশ মা’। এদের যে কোনো অনুষ্ঠানে চলে চুয়ানি আর হাড়িয়া খাওয়া। দাও হাজদা জানায়, পূর্ব পুরুষদের অধিকাংশরাই বাঁশের কাজ করে থাকলেও কেউ কেউ কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাই অগ্রহায়ণ মাসে প্রথম ফসল কাটার দিন অন্য আদিবাসীদের মতোই এরা পালন করে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। মাহালী ভাষায় এটি ‘নবান’। এ দিন নতুন চালের ভাতের সঙ্গে রান্না করা হয় নয় পদের তরকারি। নবান উৎসবের কোনো গান আছে কিনা জানতে চাইলে দাও হাজদা বলে, ‘মাহালী ভাষাতে কোনো শিরিন বানোয়া’ অর্থাৎ মাহালী ভাষায় কোনো গান হয় না।
মাহালী গ্রামের একটি ঘরে দুটি বাচ্চা নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল জয়নিকা  হেমব্রনকে। বাচ্চারা লেখাপড়া করে কিনা জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়নিকার বলে, ‘অভাব’ বাচ্চাদের পড়াতে পারি না। সে জানায়, বহু আগে থেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণকারী মাহালী সম্প্রদায় এক সময় নানা সুবিধা পেলেও বিদেশি সাহেবরা চলে যাওয়ায় এখন মিশন থেকে তেমন সহযোগিতা পায় না। একটি বাঁশ দিয়ে দুই দিনে ১৫টি ঝুড়ি তৈরি করে তা ২৫/- দরে বিক্রি করে যে লাভ হয়, তা দিয়েই কোনো রকমে চলছে মাহালী পরিবারগুলো।
ফিলোমিনা মারডি থেকে জানা যায়, এ দেশের আদিবাসী মাহালীরা হারিয়ে ফেলছে তাদের মায়ের ভাষাটুকু। বর্তমানে এ গ্রামের মাহালী ছেলেমেয়েরা বলতে পারে না তাদের নিজেদের মাহালী ভাষা। এ নিয়ে প্রতিটি মাহালী পরিবারের বড়দের মনে প্রতি মুহূর্ত কষ্টের খেলা চলে। যে ভাষায় মাহালী মায়েরা গল্প শোনাত তারই প্রিয় সন্তানটিকে। সে ভাষা আজ হারাতে বসেছে তারা। ফিলোমিনা বলে, ‘নিতো মাহালী ভাষা লয় বান দায়েক উ’ অর্থাৎ মাহালী ভাষা টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি। কষ্টবোধ নিয়ে গোত্রের মহত বলে, ‘মাহালী ভাষা টিকোরা চেষ্টা হইও’ অর্থাৎ মাহালী ভাষা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা উচিত।
বাংলাভাষী আমি, আরেকটি জাতির মাতৃভাষা হারানোর কষ্টবোধ নিয়ে ফিরছি মাহালী গ্রাম থেকে। এই সভ্যতায় নিজেকে যে সভ্য ভাবছি তার জন্য মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলাম আদিবাসী মানুষগুলোকে। একটি জাতি মানে একটি সভ্যতা। একটি ইতিহাস। বাঙালি জাতি একসময় নিজের মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে  মাতৃভাষা। কিন্তু স্বীকৃতি কি পেয়েছে আদিবাসীদের ভাষাগুলো। আমরা কি পারি না তাদের ভাষাগুলোকে মর্যাদা দিতে। হয়তো পারি। পারা না পারার দোলায়  শহরের কোলাহলে মন থেকে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায় আদিবাসী মাহালীদের মুখগুলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ১৪ জানুয়ারি ২০১০

 

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button