জীবনকথা

‘কান্তজীর মন্দিরের ইতিহাস- কথক’

রাত ফুরোলেই স্নানযাত্রা। তাই মন্দিরের চারপাশ ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। বাহিরে চলছে দোকান তোলার কাজ। মিষ্টির দোকানিরা এরইমধ্যে দোকান তুলে প্রসাদসামগ্রী আর নানা ধরণের মিষ্টি সাজিয়ে বসেছেন। স্থানীয় ঢেপা নদীতে  স্নান সেরে সকলেই পূজা দেবেন মন্দিরে। তাই মন্দিরকমিটির লোকদের যেন ব্যস্ততার শেষ নেই।
১৬ জুনের মধ্য বিকেল। এ বছরই প্রথম বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির দেখতে। মন্দিরের ভেতরে দর্শনার্থীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আগতরা মুগ্ধ হয়ে দেখছেন ৩০০ বছরের পুরনো টেরাকোটা শিল্পের অপূর্ব সুষমামন্ডিত মন্দিরটিকে। কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে তুলছেন ছবি।
হঠ্যাৎ আমাদের দৃষ্টি পড়ে মন্দিরের ভেতরের জটলার দিকে। ধুতি পরিহিত এক লোককে ঘিরে জমেছে জটলাটি। লোকটির বয়স যে সত্তরের অধিক, ভাঁজখাওয়া শরীরই তা বলে দিচ্ছে। হাতে একটি লম্বা পাটখড়ি। কান্তজীর মন্দিরের টেরাকোটায় লুকানো ইতিহাস নাকি শোনাবেন তিনি। তা জেনে আমরাও দাঁড়িয়ে যাই অন্যদের সাথে।
প্রথমে মন্দিরের সম্মুখ অংশের ডানদিকের নিচে ঘোড়া, পালকী আর নৌকা খচিত টেরাকোটা দেখিয়ে তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘এই যে বাবা ঘোড়া, পালকী, নৌকা দেখা যাছে এইডা কোন সময়ত’। কোন উত্তর না পেয়ে নিজেই উত্তরে বলেন, ‘এইডা মোগল বাদশা আকবরের সময়ত। তিনি তখন বিশ্বের হেড ছিলেন’।
মন্দির গড়ার ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি হড়হড় করে বলতে থাকেন দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথের কথা। প্রাণনাথ স্বপ্নে আদেশ পান কৃষ্ণ মন্দির গড়ার। তিনি তখন অনুমতির জন্য যান দিল্লীর সম্রাট আকবরের কাছে। তার ভাষায়, ‘উনি তখন মন্দির করার হুকুম দেন। দান সাহায্য করেন’। শুরু হয় কান্তজীর মন্দিরের কাজ। তিনি বলেন, ‘১৭০৪- এ শুরু, ১৭৫২- তে শেষ। ৪৮ বছর লাইগছে এই মন্দিরডা কইরতে’। প্রাণনাথ মন্দিরের কাজ শুরু করলেও তা শেষ করেন তার পোষ্য পুত্র রামনাথ।
এভাবে লোকটি কান্তজীর মন্দিরের টেরাকোটা দেখিয়ে ভিন্ন এক ঢঙে শোনান মোগল সম্রাট আকবরের ইতিহাস, রামায়ন আর মহাভারতের গল্পগুলো। গল্পে ডুবে আমরাও খানিক হারিয়ে যাই স্মরণীয় সব অতীত ইতিহাসের মাঝে। গল্প বলা শেষ হতেই ভিড় কমে যায়। আমরা আলাপ জমাই এই ইতিহাস – কথকের সাথে। নাম দিনেশ চন্দ্র রায়। বাড়ি পাশের নয়াবাদ গ্রামে। থাকেন মন্দিরেই। তার ভাষায়, ‘আঠার বছর ধরি মন্দিরত থাকি কুমিটি মাধ্যম’। দিনেশের ঠাকুরদাদার নাম ছিল প্রেমদাশ সরকার। টেরাকোটা দেখে ইতিহাস বলাটা শিখেছেন তাঁর কাছ থেকেই। সেটিও প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। দিনেশ বলেন,‘এগুলো হামার ঠাকুরদাদা থাকি শিখা’।
মন্দিরে কী কাজ করেন? প্রশ্ন করতেই উত্তরে বলেন,‘হামার কাজ দানের গরু-বাছুর দেখাশুনা,মন্দির পয় পরিষ্কার, গেইট খোলা আর বন্ধ রাখা’। কয়জন কাজ করেন? তিনি বলেন,‘কুমিটির মাইধ্যমি থাকি নয়জন। সরকারী বেতন একজন পুরাকীর্তি জাদুঘর আন্ডার’। বেতন কেমন? খানিকটা চুপ থেকে উত্তর, ‘এইডার তেমন বেতন নাই। খাবার- দাবার, দান-প্রণাম, বকশিশ এলাই। কুমিটি দেয় মাসে দেড়শ’।
দিনেশ কোন জাতপাতে বিশ্বাসী নন। তার ভাষায়, ‘ধর্ম ক্ষেত্রে দুটা জাত। নারী পুরুষ কহ আর বাপ মা কহ।’ তিনি বলেন,‘সনাতন ধর্মের মানুষ কহে ভগবান, ইসলামের মানুষ কহে আল্লাহ, খ্রীস্টান ধর্মে কহে গড ঈশ্বর, আসলে উনি একজনই- সৃষ্টিকর্তা। একেক জনে একেক নামে ডাকি উদ্ধার হয়’। দিনেশ বিশ্বাস করে মন্দিরে মিথ্যা বলা যায় না। তার ভাষায়, ‘ধর্ম জায়গা,ধর্মস্থ কথা’।
দেশ নিয়ে তার নানা ভাবনার কথা জানান দিনেশ। তার বিশ্বাস দেশ চলছে স্বরসতী ও লক্ষ্মীর কৃপায়। নানা অভাব অভিযোগ থাকলেও এ দেশ নিয়ে অনেকের মতো হতাশ নন এই ইতিহাস- কথক। পরাধীনতার কষ্ট আর একাত্তরের স্মৃতি এখনও গেঁথে আছে তার মনে। তাই বুকভরা আশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘হামরা তো মাথা খাড়া করি দাঁড়াইছি’।
ইতিহাস শুনে আগতরা খুশি হন কিনা? প্রশ্ন করতেই দিনেশ বলেন,‘যাক ভালো লাগে তাক মন দিয়ে শুনে। যার ভালো লাগে না তায় এদিক ওদিক ঘুরাফেরা করে।’
বকশিশের কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘দেয় কাহো কাহো। আমার মনখুশি যদি কেউ দেয় তাহলে গ্রহণ করি। নিজ থেকে চাহি না।’
আগ্রহ নিয়ে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা জানান দিনেশ। তার ভাষায়, ‘দেশে তহন সরকার ছিল না’। সেনাবাহিনীর এক বড় কর্মকর্তা এসেছিল মন্দির দেখতে। দিনেশ তাকে  টেরাকোটা ধরে ধরে শোনান গোটা ইতিহাস। কেমন লেগেছে তখন? এমন প্রশ্নে তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘ভালো লাগিছে, তয় ভয়ও লাগিছে’।
কান্তজীর মন্দির দেখতে এসে অনেকেই মন্দিরের ওপরে উঠতে চান। হাতদিয়ে ধরতে চান প্রাচীন টেরাকোটাগুলো। কেউ আবার কোনই বিধি নিষেধই মানতে চান না। শিক্ষিতদের এমন আচরণে দিনেশ ব্যথিত হন। আফসোসের সুরে তিনি বলেন, ‘এইটা পুরাতন জিনিস। দৈনিক হাজার হাজার লোক আসে। সবাই যদি ধরাধরি করে তাইলে তো ভাঙ্গি শেষ।’
কথা থামিয়ে দিনেশ এবার মনোযোগ দেন আপন কাজে। আমরাও ফিরতি পথ ধরি। ফেরার পথে চোখের সামনে বার বার ভেসে ওঠে কান্তজীরের টেরাকোটা আর ইতিহাস- কথক দিনেশের মুখখানি।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে  ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

4 Comments

  1. খুব ভালো লিখেছে। দিনেশদা’র গল্প খুব পরিচিত। আবার নতুন করে শুনতে ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button