ভ্রমণকথা

চল কেনে বাহে শঙ্খবাণী মেলাত

ওপাশে ভারতের রাধিকাপুর, এপাশে দিনাজপুরের রামচন্দ্রপুর গ্রাম। একদিন এপাশ-ওপাশ ছিল না। তখনো মেলা বসত। সেই ৩০০ বছর আগে থেকে শঙ্খবাণী মেলা বসে রামচন্দ্রপুরে।
বন্ধু শামীমের বাড়ি দিনাজপুর সদরে। আমরা গিয়েছিলাম গত বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি। কান্তজিউ মন্দির, রামসাগর, মাতাসাগর, সুখসাগর দেখার ইচ্ছা। আর তক্কে তক্কে আছি এক রাতে সাঁওতালদের ঝুমটা নাচ দেখব। শঙ্খবাণী মেলার কথা জানতামই না। নাশতার টেবিলে শামীম বলল।
পঞ্জিকা মতে, বৈশাখের প্রথম মঙ্গল অথবা শনিবার বিরলের রামচন্দ্রপুরে বসে এ মেলা। বসেও এমন এক বটের ছায়ায় বয়স যার শতাধিক। অতি প্রাচীন এক কালো পাথরের মূর্তি আছে মেলার মাঠে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মূর্তিটিকে পূজা দেয়। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মেলাপাগল মানুষ দলে দলে পথে নামে। আশপাশের লোকালয় থেকে তো আসেই; অন্যান্য জেলা থেকেও ভিড় জমায় মানুষজন। আশা পূর্ণ করার মেলা এটি।

মেলাকে ঘিরে চলছে এক ধরণের আচার
মেলাকে ঘিরে চলছে এক ধরণের আচার

অটোবাইকে করে রওনা হয়ে যাই। মেঠোপথে কাঁঠালপাকা রোদে চলেছি গরম জিলাপি, পাঁপড় খেতে আর পুণ্যার্থীদের দেখব বলে। সবুজ ধানী জমি চারধারে। বরেন্দ্র অঞ্চলের ধানক্ষেত ধ্যাড়ধ্যাড়ে নয়। ধাপে ধাপে ওপরে উঠেছে, আবার নেমেছে, আবার উঠেছে। বাতাসের দোলায় ঢেউ ওঠে সবুজে।
রাস্তার পাশে একটি লিচুবাগান। গাছগুলোর কোঁকড়া পাতা ঘাড় অবধি নেমে এসেছে। ছোট ছোট লিচুতে ভরা। শামীম জানাল, বিরলের মাদ্রাজি আর বোম্বাই লিচুর দারুণ কদর। মে-জুনে লিচু ভাঙা হয়। তখন নাকি অন্য রকম দেখায়। আসতে হবে একবার।
চলি্লশ মিনিটের মধ্যেই পেঁৌছে গেলাম ভারাডাঙ্গি বাজারে। বাকি পাঁচ কিলোমিটার পথ যেতে হবে মহিষের গাড়ি বা ভ্যানে। আমরা মহিষের গাড়ি ধরি। কাঠের চাকা ক্যাচ আওয়াজ তুলছে। দুলুনি লাগে শরীরে, মনেও।

সূর্য দুপুর ছুঁলে আমরা মেলায় হাজির হই। বাহারি জিনিসপত্র নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। খেলনার দোকানগুলোতে ভিড় বেশি। খেলনাগুলো বাঁশ আর কাঠের তৈরি। কয়েকজন বসেছে শাঁখা আর কাচের চুড়ি নিয়ে। মেলার মাঝখানটায় মাটির তৈরি খেলনা, কাঁসার প্রদীপ আর তালের পাখা নিয়ে বসেছেন একজন। একপাশে রঙিন কাপড় টানিয়ে বসেছে কয়েকটি মিষ্টির দোকান। হ্যাঁ, গরম জিলাপি পাওয়া যাচ্ছে এখানে। আমরা হামলে পড়ি। মাঠের একপাশে একটি ছোট মন্দির, এটিই শঙ্খবাণীর। মানসী দিতে যারা এসেছে তাদের হাতে পাতায় মোড়ানো ধূপ-সিঁদুর। অনেকে ছোট ছোট রুপা বা স্বর্ণের পাদুকা নিয়ে এসেছে শঙ্খবাণীকে দেবে বলে। পূজারি ফগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জানান, এক রাজা ছিলেন। একটি মাত্র মেয়ে তাঁর। অতি আদরের। নাম শঙ্খবাণী। একদিন প্রাসাদের পাশ দিয়ে এক শাঁখারি যাচ্ছিল। শঙ্খের শাঁখা দেখে মেয়ের মন উতলা হলো। কিনে ফেলল শখ করে। কিন্তু সে যে কুমারী! রটে গেল খবর। রাজা গেলেন রেগে। পারলে মারেন আর কি! শঙ্খবাণীর খুব মন খারাপ হলো। দিঘিতে ঝাঁপ দিয়ে মরল। এর কিছুদিন পরই নাকি দিঘিতে কালো পাথরের একটি মূর্তি ভেসে ওঠে। সেই থেকে এই পূজা_শঙ্খবাণী। লোকরা বিশ্বাস করে শঙ্খবাণী মানত পুরা করেন। এর মধ্যে ঢোল বেজে উঠলে খালি গায়ের চার যুবক কবুতর নিয়ে নাচতে শুরু করে। দেবতা নাকি ভর করেছে!
মেলার একটি হোটেলে খিচুড়ির সঙ্গে কবুতরের গোশত খেয়ে দুপুর ভরাই। বিকেলে মেলা আরো জমে। কেউ কেনাকাটা করে, কেউ বাতাসা ছোড়ে, কেউবা নাচে ঢোলের বোলে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে ৩ এপ্রিল ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

3 Comments

  1. Excellent!!! I have shown this to my High school seniors to give them a better understanding of the world they live in and applied it directly to our economics class. Great job. Looking forward to more economics based shows. Thank you!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button