ভ্রমণকথা

কড়ইতলীতে দূর পাহাড়ের হাতছানি

শাপলা বাজার মোড় পাড় হতেই ভাগ হয়ে যায় রাস্তাটি। পাল্টে যায় চারপাশের দৃশ্য । রাস্তার ওপাশে দূরে বড় বড় পাহাড়। দৃষ্টির দুই পরতেই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। একটির পেছনে আরেকটি। যেন একটি আরেকটির ছায়া। সবগুলো পাহাড় আকাশমুখী। কোন কোনটিকে ঘন মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে। সেখানে মেঘের সাথে পাহাড়ের যেন মিতালী চলছে। কোন কোন পাহাড়ে ঝুম বৃষ্টি। আবার মেঘের ফাঁক বুঝে একরাশ রোদের আলো এসে পরেছে কোনও কোনওটিতে। এক পাহাড়ে বৃষ্টি, অন্যগুলোতে তখন রোদ। এভাবে প্রতিদিন পাহাড়ের গায়ে চলে রোদবৃষ্টির খেলা। কেউ কেউ ভাবতে পারে এটি নিশ্চয়ই পার্বত্য জেলার নয়নাভিরাম কোন স্থান হবে। কিন্ত এ সব ধারণাকে তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে দেয়া যায় যদি কেউ চলে আসে হালুয়াঘাটের কড়ইতলীতে।
পাহাড় ভালো লাগা থেকে সুনীল বলেছিলেন, পাহাড় কিনবেন।  সে রকম ইচ্ছে করার দুঃসাধ্য না থাকলেও দূর পাহাড়ের ধারে যেতে কার না ভালো লাগে? পাহাড় দেখার আনন্দ পেতে কাকডাকা এক ভোরে ব্যস্ত ঢাকা থেকে চলে আসি পাহাড়ের পাদদেশের শহর হালুয়াঘাটে। খবর পেয়ে সঙ্গী হয় দুই বন্ধু। সোহরাব আর মৃদুল।
ঢাকার খুব কাছের জেলা ময়মনসিংহ। এ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলাকে ঘিরে রেখেছে মেঘালয়ের  মেঘছোঁয়া বড় বড় সব পাহাড়। মুক্ত আকাশে এখান থেকেই দেখা যায় তুরা পাহাড়টিও।
নামটি কেন হালুয়াঘাট? উত্তর জানতে দৃষ্টি ফেরাতে হবে বেশ পিছনের দিকে। ১৬৫০-১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি কোন এক সময়ের কথা। তখন দর্শা নামক নদীর ঘাট হয়ে নৌপথে এ অঞ্চলের সকল ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো। হালুয়া অর্থ চাষী। হাল চাষীরা নানা কাজে এ ঘাট ব্যবহার করত বলেই এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। অর্থ দাড়ায় হালুয়াদের ঘাট। আবার অনেকেরই এ বিষয়ে মত একেবারে ভিন্ন।  ঘাটটি হালুয়া নামক ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল বলেই নাকি এর নাম হয়েছে হালুয়াঘাট। নাম নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে কিন্তু কোন মতভেদ নেই।

    কড়ইতলী
কড়ইতলী

হালুয়াঘাটে যখন পৌছি সময় তখন সকাল সাড়ে ৯টা। একটি রিকশায় চেপে আমরা চলে আসি বাজারের শেষ প্রান্তের হোটেলে। হোটেল বয় রাসেল বেশ চটপটে। হর্ হর্ করে বলতে থাকে হালুয়াঘাটের কিছু জায়গার নাম। সূর্যপুর, পানিহাতা আর কড়ইতলী। এ জায়গাগুলো থেকেই মেঘালয়ের সব পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছের জায়গাটি কড়ইতলী।
কড়ইতলী বিডিআর ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে শেরপুরের দিকে। আর অন্যটি সূর্যপুর হয়ে ধোবাউরা উপজেলায়। এই দীর্ঘ রাস্তার একপাশের মেঘালয় সীমান্তে ছায়ার মতো ঘিরে আছে শুধুই পাহাড়। পাহাড় থেকে সীমানা অতিক্রম করে মাঝে মধ্যে দলভেদে নেমে আসে হাতি কিংবা মায়াবী হরিণ। গল্পের মতো এরকম তথ্যে আমরা ঠিক থাকতে পারি না। রওনা দেয়ার প্রস্তুতি নেই। ঠিক সে সময় রাসেল জানালো কড়ইতলীতে মিলবে না কোন দোকানপাট। অগত্যা অসময়েই খেতে হবে দুপুরের খাবার। রাসেলের কাছ থেকে জেনে নেই খাবার হোটেলের ঠিকানাটি।
বাজারের ভেতর বেশ কয়েকটি হোটেল। কিন্তু সেগুলো ফেলে আমরা চলে আসি থানার পাশে জসিমের ছোট্ট হোটেলটিতে। খানিকটা ঘরোয়া ঢঙের ছোট্ট হোটেলটিতে মিলে হাঁসের মাংস। বাড়ীর স্বাদের রান্নায় খেয়ে নেই ঝটপট। খাওয়া শেষে পান চিবুতে চিবুতে দুটি রিকশায় রওনা হই কড়ইতলীর উদ্দেশ্যে।কড়ইতলী গ্রামটি গোবরাকুড়া ইউনিয়নে, হালুয়াঘাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিমি ভেতরে।  রিকশার প্যাডেল ঘুরতেই বাজারকে পেছনে ফেলে আমরা উত্তরদিকে এগুতে থাকি। যতই সামনে যাচ্ছি ততই যেন ভালোলাগা সব দৃশ্য আমাদের ঘিরে ধরছে। রাস্তার দু’দিকে ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে নানা জাতের সবুজ গাছ। কোথাও তাল গাছ, কোথাও বা খেজুর। কোথাও বীজতলার টিয়া রঙ, কোথাওবা সবুজে সবুজ ধানক্ষেত। এভাবে ছবির পরে ছবি ফেলে আমরা সামনে এগুই।
একটি জায়গাতে  অন্য রকম এক গন্ধ। রিকশাওয়ালা জানালো এটি পাট পচা গন্ধ। তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশের ডোবার মধ্যে জনাকয়েক কৃষক পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছে। অন্য একটি জায়গায় এসে আমরা রিকশা থামাই। রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতে জমেছে হাঁটু অবধি বৃষ্টির পানি । লম্বা লম্বা পা নিয়ে সে পানিতে নিঃশব্দে মাছ ধরছে  এক ঝাঁক পাহাড়ি বক। সবুজের বুকে সাদা বক। কি যে অদ্ভুত! মনে হচ্ছিল সবুজ আঁচলে কোন শিল্পী যেন ভালবাসার তুলি দিয়ে সাদা আঁচড় বসিয়ে দিয়েছে।
গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা হয়ে আমরা চলে আসি শাপলাবাজার মোড়ে। মোড়ের দ’ুদিকে চলে গেছে রাস্তার দুটি অংশ। একটি গেছে অনেক দূরে দৃষ্টিসীমার ওপারে, সবুজ প্রান্তরে। ঠেকেছে একেবারে সূর্যপুর বাজারে গিয়ে।  আমরা ওপাশটায় এগোই না। মোড় থেকে বামদিকে  কড়ইতলীর রাস্তা। আমাদের রিকশাটি এগোয় সে পথে।

কড়ইতলীর দিকে যতই এগুচ্ছি ততই আমাদের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন স্বপ্নময় দেশে যেন আমরা চলে এসেছি। স্বর্গীয় পরশ নিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে চারপাশে। দৃষ্টির সামনে পাহাড়গুলো যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। গায়ে গায়ে লাগানো উঁচু -নিচু সব পাহাড়।
মৃদুলের এসএলআরের শব্দ যেন থামছেই না। রাস্তার পাশেই ফসলের মাঠ। গোটা মাঠেই ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত গারো নারীরা। একজন গারো নারীর সাথে কথা হয় আমাদের। নাম জানালো বন্যা রংমা। এ সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বিশ্বাস নারীর হাতে রোপিত গাছ থেকে অধিক ফসল মিলে। তাই হাঁটু অবধি কাদায় নেমে আর্শিবাদের পরশ দিয়ে  চারা রোপন করছে তারা।
পাহাড় দেখতে দেখতে আবিস্কার করি মাঠের পাশে একটি ছোট্ট খালের। তার ওপরে বাঁশ বিছিয়ে তৈরী করা হয়েছে একটি সাঁকো বিশেষ।  এ পথেই যাতায়াত করে আদিবাসী আর বাঙালিরা। কথা হয় কিরিত তিছিম নামের এক গারো যুবকের সঙ্গে। সে জানালো খাল মনে হলেও এটি আসলে পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি  ছোট্ট নদী। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের জলরাশি নিয়ে এটি আছড়ে পড়ে কংস নদীর বুকে। আর সে সময় ভেসে যায় দু’পাড়ের লোকালয়।
আমাদের চোখের সামনেই পাহাড় থেকে উড়ে আসে বকের ঝাঁক। বকের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখি দূর পাহাড়ে মেঘ ঝরছে। খানিক পরেই বাতাসের ধাক্কায় মেঘ যেন ধেয়ে আসে আমাদের দিকে। আমরা পিছু হটি। সে সুযোগে এক পসলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় আমাদের শরীরটাকে। ভেজা শরীরে পাহাড়ের দিকে তাকাতে দেখি অন্য দৃশ্য। গোটা পাহাড়ে কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়া উড়ছে। মনে হচ্ছে  পাহাড়ের বুকে যেন কষ্টের আগুন লেগেছে। স্থানীয়রা জানালো প্রচন্ড গরমের পর অল্প বৃষ্টি হলেই পাহাড়ে এ রকম ধোঁয়ার মতো বাষ্প ওঠে। এখান থেকেই দেখা যায়, মেঘে ঢাকা তুরা পাহাড়টি। কিন্ত সবাই জানালো সে দৃশ্য দেখতে আসতে হবে শরতে।
এখানে ক্ষণে ক্ষণে বদলায় দূর পাহাড়ের রূপ। কড়ইতলীতে বসে আমরা সেগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখি। বিকেল হতেই নানা ঢঙের মানুষদের আনাগোনা বেড়ে যায়। নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে গারো নারীরা। আমরাও মিশে যাই কড়ইতলীর মানুষদের মাঝে। মজে যাই দূর পাহাড়ের হাতছানিতে।

ছবি: মৃদুল আহমেদ

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে যুগান্তরে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ও  সচলায়তন ব্লগে

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

  1. Impressive site, the only thing I noticed is that your on-page SEO could use a little bit of fixing up and then you would be achieving a high position in google almost immediately! Have you tried out the SEOPressor plugin? It’s incredibly effective and simple to operate. Get it here. Just figured I’d share. All the best to you.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button