কীর্তিমান বাঙালিজীবনকথা

তবুও হামরাতো স্বাধীন

১৯৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি মধ্যরাত। কংস, শশি, খগিন, চেল্লাসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে একদল পুলিশ। বিপদ দেখে নাগড়া বাজান সেখানকার কৃষকেরা। নাগড়ার শব্দে আশপাশ থেকে ছুটে আসেন সবাই। দীনবন্ধুসহ প্রায় ৪০০ কৃষক বাজিতপুর বেরুয়াতলীতে ঘিরে ফেলেন পুলিশদের। পুলিশও এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সাঁওতাল কৃষক শিবরাম ও সমিরউদ্দিন।

চোখ দুটো ছলছল করছে লোকটির। দৃষ্টি একদিকে নিবদ্ধ। কথা বলতে বলতে হঠাৎ নীরব হয়ে যান। আবার একসময় বলতে শুরু করেন। স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনেন ৬৫ বছর আগের ঘটনাগুলো।
তাঁর নাম দীনবন্ধু। মুখের অবয়বে এক বিপ্লবীর প্রতিচ্ছবি। বয়স ৮৬ বছর। বয়সের ভারে এখনো নুয়ে পড়েনি শরীর। দরাজ কণ্ঠে দীনবন্ধু বলেন, ‘হামার বয়স তহন ১৭ বছর। কাকু বেনি মাধবের সাথে ঘুরি বেড়াই লাল জান্টিটা কাঁধে নিয়ে। মাঝে মাঝে কণ্ঠ আকাশে তুলি স্লোগান দিই—“আধি নাই, তেভাগ চাই”, “পুলিশ জুলুম বন্ধ কর”, “নিজ খোলানে ধান তোলো”, “বেআইনি আদায় বন্ধ কর”, “লাল জান্টি কি জয়”।’
তেভাগার এই বীর এখনো বেঁচে আছেন চিরিরবন্দরের নানিয়াটিকর গ্রামে। দিনাজপুরের বন্ধু পুলক জানায় সংবাদটি। নানিয়াটিকর, তালপুকুর ও বাজিতপুর গ্রাম নিয়ে ভিয়াইল ইউনিয়ন। ১৯৪৬ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশ ও জোতদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে তেভাগা আন্দোলনকারী কৃষকদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় এই গ্রাম তিনটিতে। পুলিশের গুলিতে সেদিন নিহত হন দুই বর্গাচাষি। এটি ছিল এ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের প্রথম গুলিবর্ষণের ঘটনা। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সক্রিয় ছিলেন দীনবন্ধু রায়।
দিনাজপুর শহর থেকে আত্রাই নদীর তীরঘেঁষা মেঠোপথ আর ফসলের ধু-ধু মাঠ পেরিয়ে এক বিকেলে চলে আসি দীনবন্ধুর বাড়িতে। নানা বিষয়ে আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে।
দীনবন্ধুর বাবা ঘন্টেশ্বর রায় ছিলেন ভূমিহীন গরিব কৃষক। দীনবন্ধুসহ আধিয়ার খাটতেন জোতদারদের জমিতে। কিন্তু চাষের সব খরচ বহন করেও ফসলের আধা ভাগও তাঁরা পেতেন না। জোতদারেরা জোরপূর্বক নানা খরচ কেটে রাখত তাঁদের ভাগ থেকে। খোলানি, বরকন্দাজি, ঝাড়ুদারি, পাহারাদারি, ওজনি খরচ এবং জোতদারদের সেলামিসহ সবকিছু আদায় করা হতো আধিয়ারের ফসলের অংশ থেকে।
একসময় এই জুলুম-অত্যাচারের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠেন ভূমিহীন কৃষকেরা। দাবি তোলেন, ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ হবে তাঁদের, এক ভাগ হবে জোতদারদের।

১৯৪৬ সালের ৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের বাজিতপুরে পুলিশের গুলিতে যে জায়গায় শহীদ হন তেভাগা আন্দোলনের সৈনিক শিবরাম মাঝি ও সমির উদ্দিন সে জায়গাটি সনাক্ত করছেন বেঁচে যাওয়া তেভাগার বীর দীনবন্ধু

সেদিনকার সংঘর্ষের ঘটনাটির বর্ণনা দেন দীনবন্ধু। সময়টা ছিল আমন ধান কাটার। আন্দোলনকারী কৃষকেরা নতুন ধান জোতদারের খোলানে না তুলে নিজ খোলানে তোলেন। এতে খেপে যান স্থানীয় জোতদার যোগেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী, রাজেন্দ্র নাথ চৌধুরী ও দেবেন্দ্র নাথ চৌধুরী। তাঁরা মামলা করে তালপুকুর দক্ষিণপাড়ার কংস, শশি, খগিন, চেল্লাসহ বহু কৃষকের বিরুদ্ধে।
কোথাও কোনো বিপদ হলেই কৃষকেরা সে সময় নাগড়া বাজাতেন। নাগড়ার শব্দে চারপাশ থেকে ছুটে আসতেন সবাই। ১৯৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি মধ্যরাত। কংস, শশি, খগিন, চেল্লাসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে একদল পুলিশ। বিপদ দেখে নাগড়া বাজান সেখানকার কৃষকেরা। নাগড়ার শব্দে আশপাশ থেকে ছুটে আসেন সবাই। দীনবন্ধুসহ প্রায় ৪০০ কৃষক বাজিতপুর বেরুয়াতলীতে ঘিরে ফেলেন পুলিশদের। পুলিশও এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সাঁওতাল কৃষক শিবরাম ও সমিরউদ্দিন।
অধিকার আদায়ের জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এ দেশের কৃষকেরা তেভাগা আন্দোলন করলেও দীনবন্ধু মনে করেন কৃষকদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। স্বাধীন দেশে এখনো ধনী-গরিবের ব্যবধান বিস্তর। জোতদারেরা রয়ে গেছে নাম পাল্টিয়ে বিভিন্ন নামে।
দেশের রাজনীতি বিষয়ে দীনবন্ধু বলেন, ‘রাজনীতি কই? রাজনীতি তো দেহি না।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘একসময় হামরা ভালো মাইনষের পরামর্শে চলতাম। এহন সবাই নিজেরে ভালো মানুষ মনে করে।’
স্বার্থ ছাড়া মানুষ এখন কারও কাছে আসে না। তাই দীনবন্ধু মুচকি হেসে বলেন, ‘তেভাগার সময় নাগড়া বাজালেই সবাই দল বেঁধে ছুটে আসত। এহন চোখের সামনে মানুষ বিপদে পড়লেও কেউ এগিয়ে আসে না।’
তিনি বলেন, ‘কারও সাথে কারও মেলামেশা নেই। ও বড়লোক হবে, আমি হব না? এ নিয়েই চলে হিংসা, বিদ্বেষ আর শত্রুতা।’
শত অনিয়ম আর অব্যবস্থার মধ্যেও দেশ নিয়ে আশার আলো দেখেন দীনবন্ধু। তিনি বলেন, ‘তবুও হামরা তো স্বাধীন, কোনো ভিনদেশি নেই মাথার ওপর।’
বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে বুকভরা আশা এই বীরের। তিনি মনে করেন, এরাই আনবে সত্যিকারের পরিবর্তন। তালপুকুর গ্রামের যুবকদের উদ্যোগে শহীদ শিবরাম ও সমিরউদ্দিনের স্মরণে কয়েক বছর আগে এখানে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। সে থেকে জানুয়ারির ৪ তারিখকে এখানে পালন করা হয় তেভাগা দিবস হিসেবে। প্রতিবছর ওই অনুষ্ঠানে সম্মান জানানো হয় দীনবন্ধুকে। যুবকেরা আগ্রহ নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চায় তেভাগার সংগ্রামের কাহিনিগুলো।
ছেলে নীরাঞ্জনের সংসারে বয়স্কভাতার টাকায় কোনো রকমে কেটে যাচ্ছে দীনবন্ধুর জীবন। নিজের জন্য কোনো চাওয়া নেই; শুধু চান, দেশটা অন্য রকম হোক। যে দেশে ধনী-গরিবের ব্যবধান থাকবে না, একজন পাশে থাকবে আরেকজনের, রাজনীতি হবে দেশের জন্য, মানুষের জন্য—সেই সুখী দেশের স্বপ্ন দেখেন তেভাগার এই বীর।
ফেরার পথে চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল দীনবন্ধুর মুখখানি। মনে শুধু ভাবনা আসে, ‘দীনবন্ধু কি দেখে যেতে পারবেন তাঁর স্বপ্নের দেশটিকে?’

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক প্রথমআলোতে, প্রকাশকাল: ৩০ মে ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button