ভ্রমণকথা

নীল সাগরের সাদা টিপ

সকাল ঠিক ৮টা। সুপারভাইজার চেঁচিয়ে ডাকে ‘এক নম্বর ঘাট’। ঘাটটি দেশের একেবারে শেষ প্রান্ত টেকনাফে। সেখান থেকেই এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজটি ছেড়ে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে।নারকেল-জিঞ্জিরাখ্যাত সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখব বলে চার বন্ধু মিলে রওনা হয়েছি। জনপ্রতি ৬০০ টাকায় আসা-যাওয়ার টিকিট নিয়ে ডেকে উঠে বসি। পেটে টান পড়লে বাংলাকলা আর রুটি মেরে দিই।হুইসেল বাজিয়ে সকাল সাড়ে ৯টায় যাত্রা করে জাহাজটি। পাশের ঘাট থেকে ছাড়ে আরো দুটি জাহাজ_কেয়ারী সিন্দাবাদ ও ঈগল-২। কিছুক্ষণ পাল্লা দিয়ে সিন্দাবাদ যায় সবার আগে। আমরা দুই নম্বরে চলতে থাকি।টেকনাফের সবুজ পাহাড় আর নাফ নদ পেরিয়ে জাহাজগুলো এগিয়ে চলে সমুদ্রপানে। মোহনার কাছে যেতেই আমাদের জাহাজটি দুলে ওঠে। একদল যুবক দেখি এর মধ্যেই গান ধরেছে। সাগরের ঢেউ এসে লাগছে তাঁদের গলায়।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা সমুদ্রে ভাসার পর তীরের দেখা পেলাম। আমরা কলম্বাস হয়ে উঠি, ওই যে, ওই যে…নারকেল গাছ, ওইটা ছেঁড়াদ্বীপ ইত্যাদি। ধীরে ধীরে জাহাজটি দ্বীপের নিকটবর্তী হয়। আরে, দ্বীপটি দেখি এগিয়ে আসছে! নীল পানি কেটে কেটে। প্রবালগুলোর তাড়া বুঝি বেশি। সমুদ্রের জলে নাইবে বলে তর সইছে না। জেটিতে বাঁধা আছে বড় বড় ট্রলার। লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে তাদের মাথায়।

আমরা থাকব দুদিন। সে রকমই পরিকল্পনা। পূর্ব দিকের সৈকত থেকে দেখব সূর্যোদয় আর পশ্চিম সৈকত থেকে সূর্যাস্ত। আসার আগে পূর্ণিমার দিনক্ষণও গুনেছি।
জাহাজ থেকে নেমে ঘাটের হোটেলগুলোর কাছে আসতেই দেখি, অনেকে ঢুকে পড়ছেন। তাঁরা প্যাকেজে এসেছেন_আসা, খাওয়া ও যাওয়া। সব মিলিয়ে পাঁচ ঘণ্টা। নানা রকম সামুদ্রিক মাছ ভাজা হচ্ছে বড় কড়াইয়ে। চেনা মাছ রূপচাঁদার সঙ্গে কালিচাঁদা, বোল কোরাল, নাক কোরাল আর চিংড়িও আছে।

আমরা থাকব সীমানা পেরিয়ে রিসোর্টে। ঢাকা থেকে বন্দোবস্ত (বুকিং ও অগ্রিম টাকা) করে এসেছি। নিরিবিলি রিসোর্টটি কোনারপাড়ায়। দ্বীপের পশ্চিম দিকের সৈকত পাড়ে। ভ্যানে গিয়ে তারপর কিছুটা হাঁটতে হয়। কটেজগুলো দ্বীপের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই। কাঠ আর ইট মিলিয়ে অন্য ঢংয়ের। রিসোর্ট এলাকার ভেতরে একটা ছোট পদ্মপুকুর আছে। কাঠের উঁচু মাচায় টেবিল বসানো হয়েছে। খেতে খেতে সমুদ্র দেখা যায়।
রুমে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুই পাশের বড় জানালায় দেখি নীল আকাশ। ঝিরঝিরে বাতাসে নারকেল গাছের পাতা নড়ার শব্দ। পাখির ডাক আর ঢেউয়ের শব্দ নীরবতাকে আরো নিবিড় করে। অন্য রকম লাগে।

সেন্টমার্টিনের জেটিতে সূর্যোদয়
সেন্টমার্টিনের জেটিতে সূর্যোদয়

এদিকে পর্যটকের ভিড় কম। প্রতিবছর ঢাকা চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা এখানে ঘুড়ি উৎসব করে। বালিময় পথে পা পড়তেই চোখে পড়ে আল্পনাখচিত পথ। সামুদ্রিক কাঁকড়া মাটি তুলে

মনের আনন্দে তৈরি করেছে এমন শিল্পকর্ম। সৈকতের তীরটি ঘিরে রেখেছে সবুজ কেয়া ফলের গাছ। ভাটার টানে পানি সরে গেলে বিচের সামনে ভেসে ওঠে পাথরের মতো নানা ধরনের বড় প্রবাল।
রিসোর্টের ম্যানেজার কামরুল ভাই। জানালেন, প্রবাল বা কোরাল এক ধরনের জীবিত কীট, যা সাগরের তলদেশে বিচিত্র বর্ণ তৈরি করে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সাগরে ডোবা একটি প্রবাল প্রাচীর আছে। ধারণা করা হয়, এটি মালয়েশিয়ার উপকূলের প্রবাল প্রাচীরেরই একটি অংশ। এই দ্বীপে প্রায় ৬০ প্রজাতির প্রবাল আছে। হামিদ ভাই (কাজী হামিদুল হক) ও সালমান নাকি দেখেছে। সাগরতলে ছবি তোলার উপযোগী ক্যামেরা আছে ওদের। কামরুল ভাই আরো বললেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে বসতি শুরু হয় ১৫০ বছর আগে। মিয়ানমার থেকে একদল জেলে এসে বসতি গেড়েছিলেন । এখানকার মানুষের প্রধান পেশা সাগরে মাছ ধরা। সন্ধ্যা হলেই জেলেরা নৌকা বা ট্রলার নিয়ে চলে যান সাগরে। সারা রাত মাছ ধরেন। সকাল বেলা সাগরতীরেই চলে মাছের বিকিকিনি।
সূর্য ডুবে গেলে চাঁদের আশায় বসে থাকি প্রবালের ওপর। একসময় অদ্ভুত এক রুপালি আলো ছড়িয়ে পড়ে চরাচরে। অদ্ভুত এক মোহময়তা তৈরি হয়। সমুদ্রের পানিতে চাঁদ দেখা চাট্টিখানি কথা নয়।
ঘড়িতে ৯টা বাজলে জোয়ার আসে। ফেরার পথে দেখা নূর আলমের সঙ্গে। সে পরিবেশবাদী এনজিওকর্মী। জোয়ারের সময় সৈকতের এই অংশে গ্রিন ও অলিভ টার্টল পাড়ে উঠে আসে। এগুলো নাকি দশাসই হয়, একেকটির ওজন দেড়-দুই মণ। নূর আলম এদের ডিম সংগ্রহ করে। ৫৫ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে তা সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে যায়। রাত ৯টার পর উপকূলের বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া হয়, যেন কাছিমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। রিসোর্টে ফিরে দেখি, মাঠের মধ্যে আগুন জ্বালানো হয়েছে। বারবিকিউ হচ্ছে। আমরা চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসি। খাই, গাই আর নাচি। পরদিন ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার ভাবনা নিয়ে ঘুমাতে যাই।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে ২০ ডিসেম্বর ২০১০

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button